কর্জে হাসানায় অর্থনৈতিক বিপ্লব

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন | Feb 02, 2020 04:33 pm
কর্জে হাসানায় অর্থনৈতিক বিপ্লব

কর্জে হাসানায় অর্থনৈতিক বিপ্লব - ছবি : সংগ্রহ

 

ঋণ দেয়া ও নেয়ার রেওয়াজ আদিকাল থেকে মানবসমাজে প্রচলিত। ঋণের বিনিময়ে সুদ গ্রহণ, প্রদান ও নানা সুবিধা ভোগ করার নিয়ম ছিল স্বীকৃত প্রথা। ভারতবর্ষ, আরব, রোমান ও পারস্য সভ্যতায় এমন প্রথার নজির দেখা যায়। সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের আগমনের পর ঋণের বিনিময়ে উপঢৌকন, সুদ ও অন্যান্য ‘সুবিধা’ প্রদান ও গ্রহণে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। এই নিষেধাজ্ঞা ছিল বৈশ্বিক প্রথার বিরুদ্ধে উন্মুক্ত চ্যালেঞ্জ। বিনা সুদে ও বিনা লাভে ঋণ প্রদান ‘কর্জে হাসানা’ বা উত্তম ঋণ নামে পরিচিতি লাভ করে। জনকল্যাণ, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন এর মুখ্য উদ্দেশ্য। সুদনির্ভর ‘ক্ষুদ্রঋণ’ মূলত ব্যবসা, আর ‘কর্জে হাসানা’ মানবসেবা, ইবাদত ও পুণ্যকর্ম। ক্ষুদ্রঋণ নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বাড়ে। অন্য দিকে কর্জে হাসানার ক্ষেত্রে এর গ্রহীতা যৌক্তিক কারণে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরিশোধের সময় বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা আছে। এতে পুণ্য বৃদ্ধি পায় দারিদ্র্য মূলত জাতীয় অভিশাপ ও বিশ্বব্যাপী একটা চ্যালেঞ্জ। সম্পদের অসম প্রতিযোগিতায় কিছু ভাগ্যবান মানুষ কোটিপতি হয়ে যায় এবং বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে বঞ্চিত থাকে। দারিদ্র্য সামাজিক কল্যাণকে বাধাগ্রস্ত করে এবং এতে অপরাধপ্রবণতার সূচক হয় ঊর্ধ্বমুখী। ভূমিহীন ও প্রান্তিক পরিবার মানবাধিকার, পর্যাপ্ত খাবার, বিশুদ্ধ খাবার পানি, বস্ত্র, আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও স্যানিটেশনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এর পেছনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সামর্থ্যরে সীমাবদ্ধতা, পালাক্রমে ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, লুটপাট, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ বিদ্যমান।

২০০৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ১.২৯ বিলিয়ন। এর মধ্যে ৪০০ মিলিয়ন ভারতে এবং ১৭৩ মিলিয়ন চীনে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৬৩ মিলিয়ন অর্থাৎ ছয় কোটি ৩০ লাখ। এর মধ্যে পল্লী অঞ্চলে ২৯ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতেন। সুশাসন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ, শ্রমের বাজার সৃষ্টির নিশ্চয়তা দারিদ্র্য প্রভৃতি থাকলে সহনীয় মাত্রায় পৌঁছতে বেশি দিন লাগবে না।

আদিকাল থেকে সমাজে দারিদ্র্য ছিল এবং বর্তমানেও আছে। সমাজের প্রান্তিক চাষি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও বিত্তহীন জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাদের আত্মনির্ভরশীল করা মানবসেবা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পুঁজিবাদী বিশ্বে দারিদ্র্যকে পুঁজি করে ব্যবসা করার প্রবণতা বেশ লক্ষণীয়; যার আধুনিক নাম ‘সামাজিক ব্যবসা’ ও ‘ক্ষুদ্রঋণ’। পুঁজিপতিরা এনজিওর মাধ্যমে এসব অর্থলগ্নি করে থাকে। এর নেপথ্যে অবশ্য ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য জড়িত। পুঁজির যারা মালিক, তারা বিনা উদ্দেশ্যে এক পয়সাও বিনিয়োগ করে না। বিত্তশালীরা ইসলামী বিধিবিধান মেনে জাকাত, সাদাকাহ ও কর্জে হাসানা প্রদান করলে সমাজের অবহেলিত ও দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষ নিজ পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হবে। জাতীয় উৎপাদনে তারা নিজেদের কর্মশক্তি নিয়োজিত করতে পারবে।

সামাজিক নির্দেশনা, ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি, আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলোকে শত্তিশালী করে অভাবের তাড়না থেকে মুক্তি প্রদানের পথ- কর্জে হাসানা বা সুদমুক্ত ঋণ। কর্জে হাসানা ইবাদত এবং মানবতার পুণ্যময় কল্যাণ। মহানবীর সা: ভাষ্য অনুযায়ী, দানের চেয়ে ঋণ প্রদানের গুরুত্ব বেশি। দানের সওয়াব ১০ গুণ আর ঋণ প্রদানের সওয়ার ১৮ গুণ। বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ট্রাস্ট বিনা সুদে ছোট ও মাঝারি আকারের ঋণ দিয়ে অসহায় পরিবারকে আত্মনির্ভরশীল করার পথ দেখাতে পারে।
কর্জে হাসানা হতে পারে দারিদ্র্যবিমোচনের ব্যাপকভিত্তিক শক্তিশালী মডেল।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিপর্যায়ে কর্জে হাসানা চালু থাকলেও তা আজো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করেনি। এ ক্ষেত্রে কিছু অপরিহার্য নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। যেমন- কর্জে হাসানা হতে হবে সম্পূর্ণরূপে বন্ধকহীন, দু’জন গ্যারেন্টর থাকবেন, যারা ঋণগ্রহীতাকে সত্যায়ন এবং তার ব্যবসায় মনিটর করবেন। ব্যবসায়ের পরিকল্পনা তৈরিতে ব্যাংক বা ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ সহায়তা দেবেন এবং ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করা হবে। ঋণের পরিমাণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবেন, তবে সাধারণত তা ১০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা হতে পারে। ঋণের মেয়াদ ২৪ মাস থেকে পাঁচ বছর হতে পারে। কিছু খাতে কর্জে হাসানা বা সুদমুক্ত ঋণ সুফল বয়ে আনতে পারে।

যেমন পোশাক তৈরি, এমব্রয়ডারি, কিচেন ব্যবস্থাপনা, খাদ্য তৈরি, মোটরসাইকেল মেকানিক, অটোমেকানিক, হাঁস-মুরগির খামার, মৎস্যচাষ, কম্পিউটার সফটওয়্যার, ওয়েল্ডিং, কাঠের সরঞ্জাম তৈরি, ছাগল পালন প্রভৃতি। অসচ্ছল পরিবারের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাঋণ দিলে নিরক্ষরতা দূরীভূত হবে। কর্জে হাসানায় কোনো ধরনের সুদ, সার্ভিস চার্জ, লোন প্রসেসিং ফি, মুনাফা, জরিমানা প্রভৃতি থাকবে না। নির্ধারিত মেয়াদের ভেতরে মূল টাকা ফেরতযোগ্য। ঋণগ্রহীতা ইচ্ছা করলে ঋণের পুরো অর্থের ১ শতাংশ ইন্স্যুরেন্স করতে পারবেন শরিয়াহ পরিচালিত যেকোনো ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে। তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়, স্বেচ্ছাধীন। ইন্স্যুরেন্স করা হলে ব্যবসার ক্ষতি, দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে।

‘ক্ষুদ্রঋণ’ ও ‘দারিদ্র্যবিমোচন’ সাম্প্রতিক সময়ের খুব আলোচিত পরিভাষা। অভাবগ্রস্ত মানুষের দারিদ্র্যকে কাজে লাগিয়ে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে লাভজনক ব্যবসা পরিচালনার নাম ‘ক্ষুদ্রঋণ’। কিন্তু এর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন তো হয়ই না, বরং তৃণমূল পর্যায়ে সুদের বিস্তৃতি ঘটে, তৈরি হয় ‘নতুন কাবুলিওয়ালা’।

কয়েক বছর আগে ডেনমার্কের সাংবাদিক টম হাইনমান কর্তৃক নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত ‘ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদ’ (Caught in Micro Debt) নামক প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে, ‘ক্ষুদ্রঋণ’ দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যর্থ এবং দারিদ্র্যবিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নে ক্ষুদ্রঋণের ইতিবাচক ভূমিকা নেই। বাংলাদেশের হতদরিদ্র মানুষ ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে এর ৬৭ শতাংশই ব্যয় করে অনুৎপাদনশীল খাতে, যা দারিদ্র্যবিমোচনে কোনো ভূমিকাই রাখে না। তাই ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব নয়। সম্প্রতি দেশের দুর্যোগপ্রবণ আট জেলার খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) পরিচালিত জরিপের প্রতিবেদনে এ তিক্ত সত্য ফুটে উঠেছে। এ দেশের দুর্যোগপ্রবণ রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় এ জরিপ চালানো হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত, এ জরিপ প্রতিবেদনে ‘দারিদ্র্যবিমোচনে দরিদ্র ব্যক্তিদের সম্পদ প্রদানের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, হতদরিদ্র ব্যক্তিদের ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশই ঋণগ্রস্ত। এদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ দেনাগ্রস্ত শুধু স্থানীয় মুদি দোকানগুলোর কাছে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ২৯ শতাংশ হতদরিদ্র চিকিৎসা বাবদ খরচ করে এবং তাদের ১৭ শতাংশ দৈনন্দিন খাবার কেনে। এ ছাড়া ক্ষুদ্রঋণের ১৩ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় মৃতের সৎকার, বিয়ে ও বিচ্ছেদের মতো পারিবারিক অনুষ্ঠান এবং জরুরি সঙ্কট মোকাবেলায়। হতদরিদ্রের ঋণের উৎস সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬০ শতাংশ মানুষ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ঋণ নেয়। দাদনের ঋণ নেয় ১০ শতাংশ। এ ছাড়া ১৪ শতাংশ গ্রামীণ ব্যাংক থেকে, ৭ শতাংশ ব্র্যাক থেকে, ১২ শতাংশ বিভিন্ন এনজিও থেকে ও মাত্র ১ শতাংশ সাধারণ ব্যাংক থেকে।

বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্যবিমোচন করে না; বরং সামন্তসমাজের ভূমিদাসের মতো এ যুগের মানুষকে একধরনের ঋণদাসে পরিণত করছে। দারিদ্র্যবিমোচনের এ পথ অনুসরণ করার ফলে আমাদের উন্নতির কোনো দিশা আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার মধ্যেই সংখ্যালঘুর ধনী ও সংখ্যাগরিষ্ঠের গরিব হওয়ার প্রক্রিয়া নিহিত। এই গরিব করা ও গরিব রাখার ব্যবস্থা বহাল রেখে গরিবদের ঋণ দিয়ে ও উচ্চ হারে সুদ নিয়ে কিভাবে গরিবি মোচন হবে? এই অস্বাভাবিক ও বিকৃত চিন্তাকেই আমরা সদলবলে লালন করে আসছি।’

আলোচনা থেকে এটি স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, সুদনির্ভর ক্ষুদ্রঋণ নয়, বরং সুদমুক্ত কর্জে হাসানা দারিদ্র্যবিমোচনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তখন সুখ ও সচ্ছলতায় আলোয় আলোকিত হতে পারে দারিদ্র্যপীড়িত পরিবার। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভাবকে পুঁজি করে ব্যবসা করা কোনো মহৎকর্ম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। এশিয়া, আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মুসলিম ট্রাস্টগুলো কর্জে হাসানার মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। বাংলাদেশের বিত্তশালীরা এ বিষয়ে এগিয়ে আসবেন- এটাই সবার ব্যাপক প্রত্যাশা।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ওমর গণি এমইএস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us