জিনের আছর : কুরআনের ভাষ্য

ড. জিহাদ খান | Feb 08, 2020 05:38 pm
জিনের আছর : কুরআনের ভাষ্য

জিনের আছর : কুরআনের ভাষ্য - ছবি : সংগ্রহ

 

প্রতিটি ধর্মগ্রন্থে জিন-ভূত ইত্যাদির আছরের ব্যাপারে অনেক বর্ণনা রয়েছে। বাইবেলে ঈসা আ:-এর জিন বা প্রেতাত্মা তাড়ানোর এত ঘটনা রয়েছে যে, মনে হবে ঈসা আ:-এর জিন তাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো কাজ ছিল না। কুরআন এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কুরআনে জিনের আছর বা জিন তাড়ানোর ব্যাপারে সরাসরি একটি আয়াতও নেই। কুরআন ঈসা আ:- এর অনেক মুজিজা বর্ণনা করেছে। যেমন- মৃতকে আল্লাহর হুকুমে জীবন দান, অন্ধকে দৃষ্টি দান, কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য দান ইত্যাদি। কিন্তু কুরআন একটিবারও ঈসা আ: কর্তৃক জিন তাড়ানোর কথা বর্ণনা করেনি। যারা জিনের আছরের পক্ষে কথা বলেন, তারা রূপক অর্থে ব্যবহৃত কুরআনের একটি আয়াতকে দলিল হিসেবে পেশ করে থাকেন যা আমরা একটু পরে আলোচনা করব।

জিনের আছর বা ভর করা
জিন মানুষের শরীর ও মন দখল করেছে, এগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে, এটা বোঝানোর জন্য জিনের ‘আছর’, ‘ভর করা’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়। ইংরেজিতে possession এবং আরবিতে আল মাসসু বা আসু সরউ শব্দ ব্যবহার করা হয়। ‘জিনের আছর’ বলতে বোঝানো হয়, এক বা একাধিক জিন মানুষের শরীরে প্রবেশ করে তার শরীরের আংশিক বা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তখন মানুষ যা কিছু করে থাকে তা জিন দ্বারা হয়ে থাকে। তখন মানুষের নিজস্ব কোনো ইচ্ছা বা শক্তি থাকে না। অর্থাৎ জিনের প্রভাবে একজন নামাজি নামাজ পড়া ও কুরআন তিলাওয়াত ছেড়ে দিতে পারেন, অন্য মানুষকে আঘাত করতে পারেন, জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে পারেন ও অসামাজিক আচরণ করতে পারেন। জিনের প্রভাব গুরুতর হলে মানুষ গাছের আগায় বা টিনের ঘরের চালে উঠে যেতে পারে কিংবা মানুষ সম্পূর্ণ পাগল হয়ে যেতে পারে ইত্যাদি। কোনো কোনো তাফসিরকারক বা যারা জিনের আছরে বিশ্বাস করে, তারা কুরআনের অনেকগুলো আয়াতের বিপরীতে রূপক অর্থে ব্যবহৃত একটি আয়াতকে জিনে ভর করার দলিল হিসেবে পেশ করে থাকেন। এই আয়াত ও তার তাফসির আলোচনা করা যাক।

‘যারা সুদ খায় তারা কিয়ামতে এমনভাবে দণ্ডায়মান হবে বা কবর থেকে উঠবে, ঠিক সেই লোকটির মতো যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দিয়েছে’ (সূরা বাকারা-২৭৫)।

Those who consume interest cannot stand [on the Day of Resurrection] except as one stands who is being beaten by Satan into insanity.

এর আধুনিক তাফসিরে বলা হয়েছে, আরবরা পাগল বা দেওয়ানাকে মাজনুন অর্থাৎ জিন বা প্রেতগ্রস্ত বলত। কোনো ব্যক্তি পাগল হয়ে গেছে, এ কথা বলার প্রয়োজন দেখা দিলে তারা বলত, অমুককে জিনে ধরেছে। এ প্রবাদটি ব্যবহার করে কুরআন সুদখোরকে এমন এক ব্যক্তির সাথে তুলনা করেছে, যে বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে গেছে। অর্থাৎ বুদ্ধিভ্রষ্ট ব্যক্তি যেমন ভারসাম্যহীন কথা বলতে ও কাজ করতে শুরু করে, অনুরূপভাবে সুদখোরও টাকার পেছনে পাগলের মতো ছুটে ভারসাম্যহীন কথা ও কাজের মহড়া দেয়। নিজের স্বার্থপর মনোবৃত্তির চাপে পাগলের মতো সে কোনো কিছুই পরোয়া করে না। তার সুদখোরির কারণে কোনো কোনো পর্যায়ে মানবিক প্রেমপ্রীতি, ভ্রাতৃত্ব ও সহানুভূতির শিকড় কেটে গেল, সামষ্টিক কল্যাণের ওপর কোনো ধরনের ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ল এবং কতগুলো লোকের দুরবস্থার বিনিময়ে সে নিজের প্রাচুর্যের ব্যবস্থা করল, এসব বিষয়ে তার কোনো মাথা ব্যথাই থাকে না। দুনিয়াতে তার এ পাগলপারা অবস্থা। আর যেহেতু মানুষকে আখিরাতে সেই অবস্থায় ওঠানো হবে, যে অবস্থায় সে দুনিয়াতে মারা গিয়েছিল, তাই কিয়ামতের দিন সুদখোর ব্যক্তি এক পাগল ও বুদ্ধিভ্রষ্ট লোকের আকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করবে’ (তাফহীমুল কুরআন : দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা : ১৭৮-১৭৯)।

আল্লামা রশিদ রিদা, সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ, মাওলানা সদরুদ্দিন ইসলাহী, মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, ইংরেজিতে অনূদিত চারটি তাফসিরের তাফসিরকারকদের প্রত্যেকেই ওই আয়াতটিকে একইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তারা কেউই এই আয়াতটিকে জিনের আছরের পক্ষের দলিল হিসেবে বর্ণনা করেননি। ইবনে কাসির ও তাবারি ওই আয়াতটিকে মৃত্যু-পরবর্তী অবস্থার অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কাজেই এই আয়াতটিকে জিনের আছরের পক্ষের দলিল হিসেবে পেশ করা যেতে পারে না। এই আয়াতটিকে যদি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা হয়, তা হলেও জিনের আছরের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ এই আয়াতটিতে শয়তানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর যারা জিনের আছরে বিশ্বাস করেন, তারা এইটুকু অন্তত বিশ্বাস করেন যে, শয়তান মানুষের ওপর আছর করতে পারে না।

কিয়ামতের দিন জিন বা শয়তান নিজেই তার অক্ষমতা বা আছরের কথা এভাবে ঘোষণা করবে : ‘তোমাদের ওপর আমার তো কোনো জোর ছিল না। আমি এ ছাড়া আর তো কিছু করিনি, শুধু এটাই করেছি যে, তোমাদের আমার পথে চলার জন্য আহ্বান করেছি। আর তোমরা আমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছ। এখন আমাকে দোষ দিও না, তিরস্কার করো না, নিজেরাই নিজেদের তিরস্কার করো, ইতঃপূর্বে তোমরা আমাকে যার সাথে শরিক করেছ, নিশ্চয়ই আমি তা অস্বীকার করছি’ (সূরা ইবরাহিম-২২)।

উপরের আয়াতটিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, যা আলোচনার দাবি রাখে। এখানে শয়তান জাহান্নামে তার অনুসারীদের উদ্দেশে বক্তব্য পেশ করছে। সে বলছে, দুনিয়ার জীবনে জাহান্নামে যাওয়ার যোগ্য লোকদের ওপর সে কোনো বলপ্রয়োগ করেনি বা শক্তি খাটায়নি। অথচ যারা জিনে ভর করাকে বিশ্বাস করেন তারা বলে থাকেন, যে অবস্থাগুলোতে মানুষ তার রবের স্মরণ থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ হয়ে যায় তখন জিন ভর করে। জাহান্নামিরা আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ ছিল বলেই তো ‘জাহান্নামের যোগ্য’ হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, আল্লাহর মুমিন বান্দা তো দূরের কথা, কাফির-মুশরিকদের ওপরও শক্তি খাটানো বা ভর করার ক্ষমতা রাখে না জিন। আর এ রকম হলে তারা কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহ তায়ালার কাছে ফরিয়াদ করত, তারা নিজেরা ভালো হতে চেয়েছিল, কিন্তু জিন বা শয়তান তাদের মনের এবং দেহের ওপর প্রভাব বিস্তার করে তাদের বিপথে নিয়ে গেছে। ভর বা আছর করার ক্ষমতা থাকলে শয়তান এটিকে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগাত মানুষকে আল্লাহ তায়ালার পথ থেকে দূরে রাখার জন্য। তাই শয়তান পরিষ্কারভাবে বলেছে, মানুষকে সে শুধু আহ্বান করেছে মাত্র, এর চেয়ে বেশি ক্ষমতা তার ছিল না।

জিনের ভর করার বিশ্বাস মানুষকে আস্তে আস্তে শিরকের দিকে নিয়ে যায়। আবদুল কাদের জিলানি রহ: বলেন, ‘যা কিছু সৃষ্ট, তা দুর্বল। এরা মানুষের ক্ষতি কিংবা উপকার করতে পারে না। যার ওপর তুমি নির্ভর করো সে তোমার ইলাহ; যার কাছে ভয় ও আশা পোষণ করো সে তোমার মাবুদ। স্মরণ রেখো, যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে লাভ-ক্ষতির কারণ মনে করে, সে আল্লাহর গোলাম নয়, সে হচ্ছে ওই শক্তির গোলাম যার হাতে ওই ক্ষমতা আছে বলে সে মনে করে।’

এ কথাটি আল্লাহ তায়ালা কুরআনে এভাবে উল্লেখ করেছেন- ‘আর মানুষের মধ্য থেকে কিছু লোক জিনদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করত। এভাবে তারা জিনদের অহঙ্কার আরো বাড়িয়ে দিয়েছে’ (সূরা আল জিন-৬)।

এর তাফসিরে বলা হয়েছে- ‘ইবনে আব্বাস রা: বলেছেন, জাহেলি যুগে আরবরা যখন কোনো জনমানবহীন প্রান্তরে রাতযাপন করত তখন উচ্চস্বরে বলত, আমরা এ প্রান্তরের অধিপতি জিনের আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ কোনো জায়গায় পানি ও ঘাস ফুরিয়ে গেলে যাযাবর বেদুইনরা তাদের একজন লোককে আরেকটি জায়গা খোঁজার জন্য পাঠাত যেখানে পানি ও ঘাস পাওয়া যেতে পারে। সে মোতাবেক নতুন জায়গায় পৌঁছে অবস্থান নেয়ার আগে চিৎকার করে বলত, আমরা এ প্রান্তরের মালিকের আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যাতে আমরা এখানে সব রকম বিপদ থেকে নিরাপদ থাকতে পারি।’ তাদের বিশ্বাস ছিল, প্রত্যেক জনমানবহীন জায়গা কোনো না কোনো জিনের দখলে আছে। তার আশ্রয় প্রার্থনা ছাড়া কেউ সেখানে অবস্থান করলে সে জিন তাদের উত্ত্যক্ত করবে বা অন্য জিনদের লেলিয়ে দেবে। সূরা আল জিনে ঈমান আনয়নকারী জিনরা এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেছে। তাদের কথার অর্থ হলো- এ পৃথিবীর খলিফা বা প্রতিনিধি মানুষ। তারাই যখন উল্টো আমাদের ভয় করতে শুরু করেছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমাদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে শুরু করেছে, তখন আমাদের জাতির লোকদের মস্তিষ্ক বিকৃতি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের গর্ব-অহঙ্কার, কুফরি, জুলুম-অত্যাচারের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে গেছে এবং গোমরাহির ক্ষেত্রে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে গেছে’ (তাফহীমুল কুরআন : খণ্ড-১৮, পৃষ্ঠা-৬৮)।

জিনের ভর করা অর্থাৎ মানুষের মন ও দেহের ওপর জিনের শক্তি প্রয়োগের ধারণার মাধ্যমে কিভাবে ক্রমান্বয়ে শিরকের বিস্তার ঘটে, তা নানা উপমা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বর্ণনা করেছেন- ‘এ সত্ত্বেও লোকেরা জিনদের আল্লাহর সাথে শরিক বানিয়ে নিলো; অথচ তিনিই (আল্লাহই) তাদের সৃষ্টি করেছেন’ (৬ আল আনয়াম : ১০০)। এ আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে- ‘অর্থাৎ তারা নিজেদের কল্পনা ও অনুমানের সাহায্যে এ সিদ্ধান্ত করে বসেছে যে, এ বিশ্ব জাহানের পরিচালনা এবং মানুষের ভাগ্যের ভাঙা-গড়ায় আল্লাহর সাথে আরো অনেক গোপন সত্তার শরিকানা আছে। তাদের মধ্যে কেউ বৃষ্টির দেবতা, কেউ ফসল উৎপাদনের দেবতা, কেউ ধনদৌলতের দেবী, কেউ রোগের দেবী এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ ধরনের আরো বিভিন্ন দেব-দেবী বিরাজ করছে। ভূত-প্রেত, শয়তান, রাক্ষস ও দেব-দেবী সম্পর্কিত নানা ধরনের অর্থহীন বিশ্বাস দুনিয়ার বিভিন্ন মুশরিক জাতির মধ্যে গড়ে উঠেছে’ (তাফহীমুল কুরআন : খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-১২৪)।

‘সেই আল্লাহই তোমাদের রব, রাজত্ব তাঁরই। তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য যাদেরকে ডাকছ তারা তো একটি তুচ্ছ জিনিসের (খেজুরের বিচির ওপরের পাতলা আবরণ) অধিকারীও নয়। তাদের ডাকলে তারা তোমাদের ডাক শুনতে পায় না এবং শুনলেও তোমাদের কোনো জবাব দিতে পারে না এবং কিয়ামতের দিন তারা তোমাদের শিরক অস্বীকার করবে’ (সূরা ফাতির : ১৩-১৪ )। ইতঃপূর্বে আমরা দেখেছি, শয়তান মানুষের ওপর জোর খাটানোর কথা এবং শিরক অস্বীকার করেছে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us