রেফ্রিজারেটর সেকাল-একাল-আগামী

শাহীন চৌধুরী ডলি | Feb 23, 2020 01:07 pm
রেফ্রিজারেটর সেকাল-একাল-আগামী

রেফ্রিজারেটর সেকাল-একাল-আগামী - ছবি : সংগ্রহ

 

খাদ্য সংরক্ষণের বিষয়টি সবসময়ই একটা সমস্যা হিসেবে বিবেচিত ছিল। যখন থেকে ফসল কাটা শুরু হয় এবং ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলো নষ্ট হয়ে যেতে থাকে, তখন থেকেই মানুষ রেফ্রিজারেটরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। রেফ্রিজারেটর আবিষ্কারের আগে লোকজন তাদের খাবার সামগ্রী সংরক্ষণ করতে কম তাপমাত্রায় ভালো রাখার চেষ্টায় বরফ, তুষার এবং ভূগর্ভস্থ স্টোরেজ ব্যবহার করত।

কৃত্রিমভাবে খাদ্য-পানীয় ঠাণ্ডা করে সংরক্ষণ করার একটি জনপ্রিয় যন্ত্র রেফ্রিজারেটর। এতে থাকে তাপনিরোধক কম্পার্টমেন্ট এবং একটি হিট পাম্প যা ফ্রিজের ভেতর থেকে তাপ বাইরে বের করে দেয়। ফলে চারপাশের পরিবেশের তাপমাত্রার চেয়ে ফ্রিজের অভ্যন্তরের তাপমাত্রা অনেক কম থাকে। উন্নত বিশ্বে খাদ্য সংরক্ষণে অপরিহার্যভাবে রেফ্রিজারেশন করা হয়। কোনো আবদ্ধ স্থানের তাপমাত্রা যখন আশেপাশের তাপমাত্রা থেকে কমিয়ে শীতল করা হয়, এই শীতল করার পদ্ধতিকে রিফ্রিজারেশন বলে।

রেফ্রিজারেটরের কম তাপমাত্রা এর ভেতরে থাকা খাবারের অণুজীবের বৃদ্ধিকে ধীর করে দেয়। ব্যাকটেরিয়া কম প্রজনন করে ও কম ছড়ায়। সে কারণেই খাদ্য সহজে পচে না। যে খাবারগুলো স্বাভাবিক তাপমাত্রায় খারাপ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেগুলো নি¤œ তাপমাত্রায় ভালো রাখে রেফ্রিজারেটর। পচনশীল খাদ্য সংরক্ষণের জন্য সবচেয়ে অনুকূল তাপমাত্রা হলো তিন থেকে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফ্রিজার গলনাঙ্কের চেয়ে কম তাপমাত্রা বজায় রাখে। সিঙ্গেল এবং ডাবল ইউনিট ফ্রিজার ও রেফ্রিজারেটর বাজারজাত করা হয়। রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার বিভিন্ন আকারের হয়। এগুলো সাধারণত লিটারে পরিমাপ করা হয়। সবচেয়ে ছোট মডেলের মধ্যে আছে চার লিটার। বড়মাপের মধ্যে বিভিন্ন আকার ও ধারণক্ষমতাসম্পন্ন রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার পাওয়া যায়।

রেফ্রিজারেটরের অতীত
রেফ্রিজারেশনের অতীত ইতিহাস বেশ পুরনো। রেফ্রিজারেশন শুরু হয় ১৭৫০ দশকের মধ্যভাগে। ১৮০০ শতকের প্রথমভাগে তা আরো উন্নত হয়। ১৮০৪ সালে, প্রথম কার্যকর জলীয়বাষ্প-কম্প্রেশন রেফ্রিজারেটর সিস্টেম তৈরি করা হয়। বাণিজ্যিকভাবে প্রথম বরফ তৈরির কল উদ্ভাবিত হয় ১৮৫৪ সালে। সর্বপ্রথম ১৯১৩ সালে ঘরে ব্যবহারের উপযোগী রেফ্রিজারেটর তৈরি করা হয়। ১৯২৩ সালে ফ্রিজিডিয়ার কোম্পানি প্রথম স্বয়ংসম্পূর্ণ একক ফ্রিজ তৈরি করে। ১৯২০ সালে ফ্রেয়ন আবিষ্কারের পর ’৩০-এর দশকে রেফ্রিজারেটর বাজারজাত হয় এবং বাজার প্রসারিত হয়। ১৯২৭ সালে প্রথম জেনারেল ইলেকট্রিক রেফ্রিজারেটর বাজারজাত করে। বেশির ভাগ বাসায় উপরের অংশে ফ্রিজার ও নিচের অংশে রেফ্রিজারেটর এরূপ স্টাইলের মডেল ব্যবহার শুরু হয় ১৯৪০-এর দশকে।

রেফ্রিজারেটরের বর্তমান
আমরা আজকাল যে রান্নাঘর ব্যবহার করি, তা অতীতের তুলনায় অনেক আধুনিক। একটা শোবার রুম, ড্রয়িং রুমের সাথে সমান গুরুত্ব দিয়ে বাড়ি বা ফ্ল্যাটের রান্নাঘরকে নান্দনিক সাজে সাজানো হয়। বিজ্ঞানের আশির্বাদপুষ্ট আধুনিক রান্নাঘরে রেফ্রিজারেটর একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র। আমাদের ব্যস্ততা যত বাড়ছে আমরা তত বেশি রেফ্রিজারেটরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। সপ্তাহের ছুটির দিনে অথবা অন্য কোনো সুবিধাজনক সময়ে শপিং করে দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য রেফ্রিজারেটরের বিকল্প নেই। প্রয়োজন অনুযায়ী খাবারগুলো বিভিন্নভাবে প্যাকেটজাত করে ক্যানে, আবদ্ধ বক্সে, বোতলে, পলিথিনে মুড়িয়ে, খোলা অবস্থায় খাবার ফ্রিজে রেখে নিশ্চিন্ত থাকি। কাঁচা ও রান্না করা খাবার দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার অংশ ব্যবহার করা হয়।

নতুন প্রযুক্তি, যেমন- স্মার্ট ফ্রিজ এবং টাচ অ্যাক্টিভেটেড ট্যাপ দূষণের মাত্রা অনেক কমিয়ে এনেছে। বেশির ভাগ গৃহস্থালি রেফ্রিজারেটর, রেফ্রিজারেটর-ফ্রিজার ও ফ্রিজারে জলীয়বাষ্প সঙ্কোচনচক্র ব্যবহৃত হয়। বর্তমান রেফ্রিজারেটরগুলোতে অটো ডিফ্রস্টিং পদ্ধতি আছে এবং ফ্রিজের পাল্লায় ঠাণ্ডা পানি ও বরফের জন্য ডিসপেন্সার আছে। ফ্রিজ ও কম্প্রেসারে ক্ষতিকারক এইচএফসি গ্যাস ফেজ আউট প্রকল্প বাস্তবায়নে জাতিসঙ্ঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপি কাজ শুরু করেছে। আধুনিক সময়ের রেফ্রিজারেটর প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো রেফ্রিজারেটর প্রস্তুতে গ্রিন হাইড্রোকার্বন টেকনোলজির ব্যবহার নিয়ে কাজ করছে। এই প্রযুক্তিতে পরিবেশবান্ধব রেফ্রিজারেটর ব্যবহারে পরিবেশে লাখ লাখ টন কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ বন্ধ করা সম্ভব হবে।

প্রতি বছর বিশ্বে দুই বিলিয়নেরও বেশি রেফ্রিজারেটর
বিশ্বজুড়ে রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার তৈরির এর ফলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় ৪০০ মিলিয়ন টন খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে, যা বিশ্বের খাদ্য ঘাটতি পূরণে এবং খাদ্যনিরাপত্তায় ভূমিকা রাখছে। প্রযুক্তির উন্নয়নে গ্রাহক পর্যায়ে ব্যবহৃত রেফ্রিজারেটরে ১৫ বছর আগের চেয়ে বর্তমানে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত কম বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে।

ভবিষ্যতের রেফ্রিজারেটর
ভবিষ্যতের রেফ্রিজারেটর কেবল নষ্ট হওয়া থেকে খাবারের অপচয়ই রোধ করবে না, সেই সাথে স্বাস্থ্যকর পুষ্টির সম্ভাবনা বাড়াবে। সিমেন্সে নতুন ক্যামেরা সংযোজিত প্রযুক্তির ব্যবহারে দুটি ক্যামেরা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা ফ্রিজে থাকা সামগ্রীর ছবি নেবে- যখন একটি দরজা খোলা হবে এবং অপর দরজাটি বন্ধ থাকবে, তখন ফোনে চিত্রগুলো প্রেরণ করবে। এতে রেফ্রিজারেটর ব্যবহারকারীর জন্য অনেক সুযোগ বেড়ে যাবে, যেমন- লাঞ্চের সময় কর্মক্ষেত্রের ডেস্কে বসে আপনার রাতের খাবারের পরিকল্পনা করতে পারবেন। আপনি ফ্রিজ স্টকটিতে চেক ইন করতে আপনার অ্যাপটি ব্যবহার করে সন্ধ্যার জন্য সহজেই আপনার মেনুর পরিকল্পনা করতে পারবেন। আর একটি ব্যাপার হচ্ছে- আপনি যদি গ্রোসারিতে কেনাকাটা করতে যান, আপনার ভুলো মনের জন্য ফ্রিজে কী মজুদ আছে বা নেই ভুলে যান; তবে আপনি অ্যাপসটি অ্যাক্সেস করতে পারবেন এবং এর মাধ্যমে কী কম আছে তা সার্চ করে বের করতে পারবেন। আপনার কী কিনতে হবে তা সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন। এই অ্যাপ্লিকেশনটি আপনার মজুদ থাকা আইটেমগুলোর উপর ভিত্তি করে স্বাস্থ্যকর বিকল্প আইটেমগুলোর প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে দেবে। এতে আপনার আইটেমগুলো বাছাই করে কিনতে সুবিধা হবে।

অ্যাপের সাথে সংযুক্ত ক্যামেরাসহ রেফ্রিজারেটর অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় এ ধরনের রেফ্রিজারেটর ক্রয় করার সাধ্য সাধারণ ক্রেতাদের থাকবে না। সাশ্রয়ী মূল্যে বাজারে বিকল্প রেফ্রিজারেটর তো আছে এবং থাকবেও। যাদের কম বাজেট, তারা স্মার্ট ফ্রিজক্যামের মতো প্রযুক্তিসহ ক্যামেরা ফ্রিজে সংযোজন করতে পারবেন। এই প্রযুক্তিগুলো যত এগিয়ে যাবে, আমাদের জীবন তত সহজ হবে। আগামী দিনের ফ্রিজের সেন্সরে ব্যকটেরিয়া নিয়ন্ত্রক সেন্সর অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ফ্রিজে রাখা খাবারের নির্দিষ্ট আইটেমগুলোতে উপস্থিত ব্যকটেরিয়ার পরিমাণ অ্যাপটিতে দৃশ্যমান হবে। এটি কেবল খাবারের বর্জ্য হ্রাস করবে না, আপনি যে খাবারগুলো গ্রহণ করবেন, সেগুলো শুদ্ধ রেখে আপনার স্বাস্থ্য ভালো রাখায় ভূমিকা রাখবে।

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ফ্রিজে নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে। গড়নে ও গঠনে স্বাতন্ত্র্য আনা হচ্ছে। রেফ্রিজারেটর কেনার আগে এর স্থায়িত্ব, ধারণক্ষমতা, আকার, ডিজাইন, বিদ্যুৎসাশ্রয়ের সুবিধা ও প্রযুক্তির ওপর জোর দিতে হবে। ভালো মানের কম্প্রেসারের রেফ্রিজারেটর টেকসই হয়। ফ্রিজ কেনার আগে ঘরের আকারের কথা মনে রাখা জরুরি। ভালো ওয়ারেন্টি দেয়া ভালো ব্রান্ডের ফ্রিজ কেনাই উত্তম। ফ্রিজের সাথে স্টেবিলাইজারের ব্যবহার ফ্রিজকে বৈদ্যুতিক গোলযোগে নিরাপদ রাখে। বর্তমানে প্রস্তুতকৃত প্রায় প্রতিটি ভালো ব্রান্ডের ফ্রিজে ইনভার্টার এবং অটো স্টেবিলাইজার প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে ফ্রিজ বিদ্যুৎসাশ্রয়ী হয় এবং বৈদ্যুতিক গোলযোগেও ঝুঁকিমুক্ত থাকে।

ফ্রস্ট ও নন-ফ্রস্ট দুই ধরনের ফ্রিজ থেকে ফ্রিজ বেছে নিতে ফ্রিজটি কোথায় থাকবে শহরে নাকি গ্রামে, এ ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। গ্রামে প্রায়ই টানা কয়েকঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। সে ক্ষেত্রে ফ্রস্ট ফ্রিজ ব্যবহার করা ভালো। সিমেন্স, স্যামসাং, শার্প, এলজি, হিটাচি, কনকা, র‌্যাংগস, ক্যালভিনেটর তোশিবা, ইন্ডিসিট, এরিস্টোন, ওয়ার্লপুল, ইলেকট্রা, সিঙ্গার, ওয়ালটনসহ বহু কোম্পানির রেফ্রিজারেটর এবং ফ্রিজার বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। ফ্রিজ ব্যবহারে সচেতন হতে হবে, নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। ফ্রিজের ভেতরের তাপমাত্রা সঠিকভাবে সেট করলে ভালো হয়। নিয়মিত ফ্রিজের সাথে সংযুক্ত বৈদ্যুতিক লাইন চেক করতে হবে। কোন খাবার কত দিন কত তাপমাত্রায় ভালো থাকে, তা জেনে বুঝে খাবার সংরক্ষণ ও গ্রহণ করতে হবে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us