গ্রেট জেনি মসজিদ

খালিদ মাহমুদ | Feb 23, 2020 03:10 pm
গ্রেট জেনি মসজিদ

গ্রেট জেনি মসজিদ - ছবি : সংগ্রহ

 

আফ্রিকা বলতেই আমাদের চোখে কেমন একটি পশ্চাৎপদ জনপদের ছবি ভেসে ওঠে। মরুপ্রবণ এই মহাদেশের একটা বড় অংশই অবশ্য বাস্তবে দুঃখ, জরা, অভাব, ব্যাধি আর কান্নাপীড়িত বিপন্ন জনপদ। সেই সাথে আছে গায়ের চামড়ার রং বিবেচনায় একধরনের বর্ণবাদী বৈষম্যের থাবা। তবে পৃথিবী সবসময়ই যে একরকম ছিলো তা নয়। একটা সমৃদ্ধ অতীত হয়তো তাদেরও ছিলো। অমাবস্যার অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া এই জনপদেরও ইতিহাসের পৃষ্ঠা ওল্টালে ধুসর ছবির মত ভেসে উঠতে পারে শিল্প সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের সোনালী অধ্যায়। মধ্য আফ্রিকার ছোট দেশ মালির জেনি শহরের বানি নদীর তীরে গ্রেট জেনি মসজিদ অন্তত তেমনই সম্ভাবনা জানিয়ে রাখে যা কিনা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর শিল্পকলার নিদর্শন হয়ে এখনও তাক লাগিয়ে দিচ্ছে সমসাময়িক বিশ্লেষক আর গবেষকদের। ভ্রমণে আসা পরিব্রাজকদের চোখের বিস্ময় এ স্থাপনাকে আজ অবধি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মাটির স্থাপনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

‘জেনি’ শহর হিসেবে খুব বড় নয়। উত্তর পশ্চিম কোণের কিছু অংশ ছাড়া বাকীটা চারদিক দিয়ে নদী কিংবা জলাভূমিতে ঘেরা। ছোটখাটো দ্বীপের আকার ধারন করেছে। দ্বীপটাকে যদি পূর্ব-পশ্চিমে ভাগ করা হয় তাহলে পূর্ব অংশের ঠিক কেন্দ্রীয় অবস্থানে গ্রেট জেনি মসজিদের অবস্থান। মসজিদটি বানি নদীর বন্যাপ্রবণ সমতল এলাকায় খানিকটা উঁচু ভিত্তির উপরে বসানো। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তৎকালীন সমাজ বিপ্লবের এই কেন্দ্রটির সূচনা হয়। ভিন্ন দর্শন এই মাটির ভবনকে সুদানো-সাহেলিয়ান স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত করেন গবেষকরা। বর্তমানে যে কাঠামো দেখা যায় তা আসলে ১৯০৭ সালের পুনঃনির্মিত।

মসজিদের প্রথম ইতিহাসের অস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায় আবদ আল সাদীসের ইতিহাস গ্রন্থ তারিখ আল সুদানে। মসজিদের সময়কাল ১৩শ শতাব্দীতে হবে যখন আব্বাসীয় এবং তৎপরবর্তী উসমানিয়া খেলাফতের ব্যাপক বিস্তার ঘটে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। অন্য অনেক এলাকার মতো আফ্রিকাতেও ছড়িয়ে পড়ে নতুন বিশ্বাসের স্রোতে। ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য আগত আরব বণিকরা তাদের ব্যবসায়িক কাজের সাথে সাথে তাদের জীবনবোধকেও ছড়িয়ে দেন স্থানীয় অধিবাসীদের মাঝে।

অনুপম চরিত্রের মানুষগুলোর সংস্পর্শে এসে স্থানীয় অধিবাসীরা মুগ্ধ ও আলোকিত হন। এরই ধারাবাহিকতায় ১২ শ' সালের প্রথমদিকে তৎকালীন মালির শাসনকর্তা কানবুরুর ইসলাম গ্রহণ ছিলো একটি বড় ধরনের বিপ্লব। তিনি নিজের রাজকীয় প্রাসাদ ছেড়ে দেন মসজিদ হিসেবে ব্যবহারের জন্য। আর এটাই আসলে মসজিদের সূচনা। প্রাসাদের অবকাঠামোতে কিছু পরিবর্তন আনা হয় মসজিদ হিসেবে ব্যবহারের জন্য। এই পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত থাকে পরবর্তী শাসকদের সময়েও। পর্যায়ক্রমে মিনার এবং সীমানা প্রাচীর যুক্ত হয়। ফরাসী পর্যটক রেনে ক্যালি ১৮২৮ সালে যখন জেনি ভ্রমণে আসেন পুরাতন এবং ভগ্নদশার মসজিদটি তখনো ধ্বংসস্তুপের আকারে টিকে আছে। রেনে ক্যালির বর্ণনায় পাওয়া যায় জেনিতে দুটো বড় তবে অনুচ্চ টাওয়ারের সমন্বয়ে একটি মসজিদ আছে যা সমসাময়িক স্থাপত্যের বিচারে একটু ভিন্নতর। এটি যদিও অনেক বড় তবে একেবারেই সাধারণ হাতে নির্মিত হয়েছে। হাজারো চড়ুই পাখি আস্তানা বানিয়েছে একে ঘিরে। ফলে অসহ্য দুর্গন্ধ এড়াতে সাধারণ মানুষ মসজিদের সামনের ছোট উঠোনেই বেশিরভাগ সময় নামাজ আদায় করে। রেনে ক্যালির ভ্রমণের দশ বছর আগে ১৮১৮ সালে ফুলানী উপজাতি নেতা সেকু আমাদু লব্ব তদানীন্তন শাসনকর্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং এক পর্যায়ে শহরটি দখল করেন। ধারনা করা হয়, সেকু আমাদু মসজিদের দুরবস্থা দেখে এটিকে মেরামতের চিন্তা বাদ দিয়ে বরং ফেলে রাখেন। বার্জেইস বলেন, সেকু আমাদু আসলে নতুন করে আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পুরাতন মসজিদের পূর্বপাশে অবস্থিত কানবুরুর নতুন প্রাসাদ ভেঙে নতুন মসজিদের ভিত্তি গড়ে ওঠে। আশেপাশের কাছাকাছি আরো কিছু ছোট মসজিদকেও এ সময় বন্ধ করে দিয়ে নতুন মসজিদটিকে কেন্দ্রীয় মসজিদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেকু আমাদুর সময়ে অযত্নের শিকার হয়ে পুরাতন মসজিদের অবশিষ্ট ধ্বংসস্তুপ অতীতের গর্ভে হারিয়ে যায়। এই ভগ্ন মসজিদের বর্ণনাই রেনে ক্যালির ভ্রমণচিত্রে লিপিবদ্ধ হয়েছিলো।

লুই আরকিনার্ডের নেতৃত্বে ফরাসী বাহিনী ১৮৯৩ সালে ডিজনী দখল করে। ঠিক এর পরপরই ফরাসী সাংবাদিক ফেলিক্স ডুবো শহরটি ভ্রমণ করেন এবং সেকু আমাদুর মসজিদ সম্পর্কে বর্ণনা দেন। ঐ সময়কার একটি ভূমি নকশাও আঁকেন যার মাধ্যমে তিনি ঐ মসজিদের অবয়ব কেমন ছিলো তার একটি প্রচ্ছন্ন ধারনা দেয়ার চেষ্টা করেন। সেসময় আদি মসজিদের মূল অংশটি কবরস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিলো। ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত দ্য মিস্ট্রিয়াস টিম্বুকটুতে মসজিদের যে বর্ণনা দেয়া হয়, তাতে বোঝা যায় বর্তমান মসজিদের সামনে স্থানীয় নেতাদের যে কয়েকটি সমাধি দেখা যায় মূল মসজিদ এই সীমানা পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এই মসজিদের উচ্চতা অনেক কম ছিলো এবং কোনও মিনারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

তবে মসজিদ স্থানান্তরের বিষয়টি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের অনেকেই পছন্দ করেননি। ১৯০৬ সালে ফরাসী ঔপনিবেশিক প্রশাসন যখন সেকু আমাদুর মসজিদের বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ নেয় তখন স্থানীয় অধিবাসীরা বরং সুলতান কানবুরুর সময়কার আদি অবস্থানে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা সেই প্রস্তাব করেন। শেষ পর্যন্ত মূল মসজিদের স্থলে পুনরায় মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। সেকু আমাদুর মসজিদ ব্যবহৃত হতে থাকে মাদ্রাসা হিসেবে। ইসমাইলা ত্রাওরির স্থাপত্য নকশায় তৈরী হওয়া এই মসজিদটিই আসলে বর্তমান সময়ের গ্রেট জেনি মস্ক।

১৯০৭ সালে মতান্তরে ১৯০৯ সালে মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ২৪৫ ফিট লম্বা বাহুর বর্গাকৃতির একটি ভিত্তির উপরে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই ভিত্তি সাধারণ ভূমি লেভেল থেকে প্রায় নয় ফুট উঁচু। বানি নদীর বন্যা থেকে বাঁচার জন্য এই ব্যবস্থা। চতুর্দিকে ছয়টি আলাদা সিড়ি দিয়ে এই উঁচু ভিত্তির ওপর ওঠা যায়। সিড়িগুলো সুঁচালো ফলক (পিনাকলস) দিয়ে অলংকৃত। ভবনের উত্তর দেয়ালে প্রধান প্রবেশ পথ। নির্মাণ ত্রুটির জন্যই হোক আর জায়গার সহজলভ্যতার অভাবে হোক মসজিদের নকশা একদম সমকোণে করা যায়নি। চতুর্দিকের পরিসীমা একটু ট্যাপিজিয়াম ধাঁচের হয়ে পড়েছে।

ভৌগোলিক কারণে আফ্রিকার কিবলা হচ্ছে পূর্ব। পুরো প্রকল্পের পূর্ব অংশ হচ্ছে মূল মসজিদ আর পশ্চিম অংশ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ উঠোন মসজিদের পরিভাষায় যেটিকে ‘শান’ বলা হয়। এই অভ্যন্তরীণ উঠোন ৬৫ ফুট প্রশস্ত এবং ১৫০ ফুট লম্বা। খিলান ও জানালা সমৃদ্ধ গ্যালারি দিয়ে তিনদিক ঘেরা। পশ্চিম গ্যালারি মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট। অপরদিকে মূল মসজিদের আকার ৮৫ ফুট এবং ১৬৫ ফুট। পূর্ব দিকের কেবলমুখী দেয়ালের পুরুত্ব তিন ফিট। এই দেয়াল মজবুত করার জন্য আঠারোটি পায়ার মত সংযুক্ত করা হয়েছে যার প্রত্যেকটির মাথায় একটি করে পিনাকেল। বাক্স আকৃতির তিনটি টাওয়ার দেয়াল থেকে একটু বের হয়ে মিনারে পরিণত হয়েছে। মাঝের মিনার ৪৩ ফুট উঁচু। মিনারের বর্ধিত অংশে মেহরাবের অবস্থান। নামাজ ঘরের তিনটি মিনারই মেহরাব সমৃদ্ধ। এদের মধ্যে কেন্দ্রীয় অবস্থানে থাকা মেহরাবে ইমাম নামাজের জন্য দাঁড়ান। মেহরাবের ছাদের একটি সরু ঘুলঘুলি দিয়ে মেহরাবের মিনারের উপর তলায় একটি ছোট রুমের সাথে দৃশ্য সংযোগ তৈরী করা হয়। কেন্দ্রীয় মেহরাবের ডানপাশের অপেক্ষাকৃত ছোট মিনারে মিম্বর অবস্থিত যেখানে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেব শুক্রবারের খুতবা দেন।

উত্তর দক্ষিণ বরাবর প্রলম্বিত কোণাকৃতির খিলানসমৃদ্ধ নয়টি দেয়ালের উপর ভর দিয়ে বসানো হয়েছে মসজিদের ছাদ। ভিতরে প্রায় নব্বইটি থাম রয়েছে। এতবেশি থাম হবার কারণে মসজিদের ভেতরে কয়েকটি করিডোর এবং আলাদা আলাদা হলের মত তৈরী হয়ে গেছে। তাছাড়া মাটির দেয়াল হবার কারণে খুব বেশি জানালা দেয়ার সুযোগ হয়নি। তাই অনেক সময়ই দৃষ্টি আটকে যায়। দেয়ালের উচ্চতা ভেদে দেড় থেকে দুই ফুট পুরুত্ব পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় হলের মেঝে এখনো পাকা করা হয়নি। চাইলে একদম জুতা পায়েই ভিতরে হেঁটে যাওয়া যায়। দুটো সিঁড়ি সরাসরি ছাদে উঠে গেছে। এর একটি মসজিদ হলের দক্ষিণ-পশ্চিম কর্নারে এবং অপরটি উত্তর দেয়ালে প্রধান প্রবেশপথ সংলগ্ন। দ্বিতীয়টিতে মসজিদের বাইরে থেকে সরাসরি প্রবেশ করতে হয়। ছাদের উপরে ছোট ছোট ছিদ্র ছিদ্র আছে যার মুখে মাটির কলসির মত পাত্র বসানো এবং এর মুখ ঢাকা। গরমের সময়ে ভিতরের বাতাস বের করার জন্য প্রয়োজনে এর মুখ খুলে দেয়া যায়।

মসজিদের পূর্ব দেয়ালের সামনের খোলা চত্বরে দুজন বিখ্যাত ব্যক্তির সমাধি আছে। দক্ষিণের বড় সমাধি ১৮ শতাব্দীর বিখ্যাত ইমাম আমানি ইসমাইলিয়ার। ফরাসী ঔপনিবেশিক শাসনামলে মসজিদের পূর্ব পাশে একটি পুকুর ছিলো যেটি পরে ভরাট করে মাঠ সম্প্রসারণ করা হয়। এখানে এখন সাপ্তাহিক বাজার অনুষ্ঠিত হয়। ১৯০৭ সালের পরে আর কোন পরিবর্তন হয়নি, শুধু ১৯৯০ সালে দুটো আলাদা তোরণ সংযোজন ছাড়া। যদিও এটি নিয়মিত সংস্কার করা হয় তবু সেই ১৯০৭ সালে তৈরী হওয়া বহিঃদেয়ালে খুব সামান্যই পরিবর্তন এসেছে শুধু মেহরাব সংযোজন ছাড়া। মূল মসজিদে মেহরাব বলতে দেয়াল থেকে একটু বাড়তি অংশ ছিলো। এটা দেখতে অনেকটা উত্তর দেয়ালে প্রধান গেটের খিলানের মতো মনে হতো। দেয়াল নির্মাণের সময় চেষ্টা করা হয় পুরনো হারিয়ে যাওয়া মসজিদের ভগ্নাবশেষ অনুসরণ করে যতটা সম্ভব বহিঃসীমানা ঠিক রাখা। তবে ভিতরের ছাদের জন্য থাম ও ভারবাহী দেয়ালগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী ডিজাইন করা হয়।

গ্রেট জেনি মসজিদ আফ্রিকার স্থাপত্য চরিত্রে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। পরিব্রাজক রেনে ক্যালি এবং সাংবাদিক ফলিক্স ডুবো’র বর্ণনায় মসজিদের বিবরণ থাকলেও এর স্থাপত্য ও নির্মাণ শৈলী সম্পর্কে খুব বিস্তারিত তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায় না। বর্তমান অবকাঠামোর নির্মাণ সময়কালে মালি ফরাসী ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন ছিলো। সঙ্গত কারণেই এই স্থাপনার সাথে ফরাসী স্থাপত্যের একটা সংযোগ তৈরী হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে মসজিদের কিবলা দেয়ালের সাথে যে তিনটি উচ্চ টাওয়ার সংযুক্ত আছে তা আসলেই মসজিদের আদি স্থাপত্যের কোন পরিচয় বহন করে কিনা তা নিয়ে শিল্প গবেষকদের বেশ মতভেদ আছে। অনেকেই অভিযোগ করতে থাকেন পুনঃনির্মাণকালে পুরনো মসজিদের আসল চেহারা হারিয়ে যায়। এই অলংকরনের ধরন বরং মন্দিরের অঙ্গসজ্জার সাথে অনেক বেশি মিলে যায়। বিশেষ করে নতুন ভবনের দেয়ালে যে সূঁচালো কোন সংযোজন করা হয়েছে তা বারোক মন্দিরে ¯্রষ্টার উদ্দেশে নিবেদনের চিহ্ন প্রকাশ করে। ১৯১০ সালে ফেলিক্স ডুবো যখন পুনরায় মসজিদ পরিদর্শনে আসেন তখন মসজিদের এই চেহারার পরিবর্তন দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েন। তার দৃষ্টিতে এটি ছিলো একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ ।

ফরাসী নৃ-তত্ত্ববিদ মাইকেল লেইরি ১৯৩১ সালে মালি ভ্রমণ করে বলেন নতুন যে মসজিদ হয়েছে তা দেখেই বোঝা যায় এটা ইউরোপিয়ানদের কাজ। তিনি আরো বলেন, স্থানীয় জনগণ এত বিরক্ত যে এর পরিচ্ছন্নতা কাজে তাদের আগ্রহ নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক সময় শাস্তির ভয় দেখিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে। অপরদিকে জেন লুইস বার্জেইসের মতে কিছু অভ্যন্তরীণ খিলান ছাড়া বাকী স্থাপনায় দৃশ্যত কোন ফরাসী প্রভাব নেই। তাছাড়া খিলানগুলোও একদম বহিরাগত নয় বরং আফ্রিকার নিজস্ব ধরন মেনে তৈরী হয়েছে। এভাবে কেউ কেউ একে আফ্রিকান স্থাপত্য বলে মেনে নেয়ার চেষ্টা করলেও বাস্তবতা হচ্ছে মসজিদের বাহ্যিক দর্শনে ফরাসী স্থাপত্যের ছাপ যতটা স্পষ্ট মুসলিম স্থাপত্য ততটাই উপেক্ষিত মনে হয়।

জেনি মসজিদের দেয়াল রোদে পোড়া ইট এবং বালু ও এঁটেল মাটির মিশ্রণে তৈরী মসলার সাহায্যে প্রস্তুতকৃত। এর উপরে মাটির সাহায্যেই পলেস্তারা লাগানো হয়, ফলে মোটামোটি মসৃন চেহারা তৈরী হয়। দেয়ালের উপরের দিকে সারা গায়ে পাম গাছের গুড়ি বের করা থাকে। স্থানীয় ভাষায় এর নাম ’টরল’। মসজিদের দেয়াল থেকে প্রায় দুই ফুট লম্বা পর্যন্ত এগুলো বের করে রাখা হয় যার ফলে মসজিদের দেয়ালে দৃশ্যমান বিশেষ ধরনের প্যাটার্ন তৈরী করে। এছাড়া মেরামতের সময় স্ক্যাফোল্ডিং হিসেবে কাজ করে। বাঁশ, কাঠ দিয়ে মাচা বানানোর প্রয়োজন পড়ে না। তবে গাছের আড়া ব্যবহার করার মূল কারণ হিসেবে ধারনা করা হয় ভবনের স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য বিম হিসেবে ব্যবহার করে মাটির দেয়ালের ফাটল যতটা সম্ভব কমানো।
মাটির মসজিদ মালির মুসলিম সমাজের ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সাথে দিনযাপনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। জেনি মসজিদ এখন কেবলই মসজিদ বা ধর্মীয় স্থাপনার পরিচয় ছাপিয়ে গর্ব ও নিজস্বতার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। ফরাসী ঔপনিবেশিকরা যখন প্রথম মাটির এই স্থাপনা দেখে তখন একধরনের দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে যায় এটি অস্থায়ী ভিত্তিতে তৈরী হয়েছে কিনা তাই ভেবে। কারো কারো ধারনা ছিলো হয়তো অর্থাভাবে ভালো নির্মাণ উপকরণে স্থায়ী কিছু হচ্ছে না এবং এজন্য তারা অর্থ সহায়তা দেয়ার প্রস্তাব দেয়।

কিন্তু স্থানীয় অধিবাসীরা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। বস্তত ফরাসী বিপ্লব ও ঔপনিবেশিক জৌলুসের বিপরীতে এই মাটির স্থাপনা তাদের অস্তিত্বের চিহ্ণে পরিণত হয়েছে। মসজিদে নামাজ আদায়ের পাশাপাশি প্রতিবছর এর মেরামত উৎসবে অংশ নিতে পারাটা তাদের জন্য উত্তম ও সম্মানজনক কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রতিবছর বর্ষাকালের শেষে স্থানীয় অধিবাসীরা একটি উৎসবের আয়োজন করে যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মসজিদের মেরামত কাজে সকলের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরী করা। দলমত নির্বিশেষে সবাই একটি আনন্দময় ধর্মীয় উৎসবে মেতে ওঠে। সব বয়সের মানুষ একত্রিত হয়, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে গান, খাওয়া দাওয়া হয় তবে উৎসবের সবচেয়ে কাজের দিক হচ্ছে কয়েকদিন আগে থেকেই মসজিদের মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ এবং কাজের উপযোগী করা। বরকতের আশায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকেও এ কাজে যুক্ত করা হয়। মুরব্বীরা মসজিদের সামনের চত্বরে বসে দেখভাল করেন। যুবক বয়সীরা বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে কাজে নেমে পড়েন। প্রথমে আস্তর প্রস্তত করা হয়। আস্তরের একসাথে শুকানো যায় না বরং ধাপে ধাপে তৈরী করা এবং শুকাতে হয়। দেয়ালের উপরের অংশে আস্তর লাগানোর জন্য যুবক শ্রেণি ভবনের গায়ে চড়ে এবং নিচে থেকে মসলা তুলে দেবার জন্য অন্যরা কাজ করে। জনপদের মহিলারাও বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করে। কে কার আগে আস্তর মসলা পৌছাতে পারে তা নিয়ে আনন্দঘন দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।

১৩ শতাব্দীতে জেনি সুদানী ব্যবসায়ীদের অন্যতম ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হয়। সম্ভবত প্রথম যখন মসজিদ তৈরী হয় তখন থেকেই সামাজিক ও ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে এর প্রসার ঘটতে থাকে। ১৫-১৬ শতাব্দীতে জেনি মুসলিমদের মিলনমেলা হয়ে ওঠে এবং পুরো আফ্রিকায় ইসলামের বিস্তারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সময় মূল মসজিদটি পরিচালিত হতো তখনকার সময়ের আফ্রিকার খুব গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক শিক্ষাকেন্দ্র কর্তৃক।

দেশ বিদেশের পর্যটকরা জেনির অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে বড় মসজিদে ভ্রমণ করেন। ১৯৯৬ সালে ভোগ ম্যাগাজিন মসজিদের অভ্যন্তরে ফ্যাশন শো এর শ্যুটিং করে। তবে ম্যাগাজিনে প্রকাশিত মডেলদের সংক্ষিপ্ত পোষাকের ছবিতে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। এ ঘটনার সূত্র ধরে মসজিদে অমুসলিমদের প্রবেশাধিকার সংকুচিত হয়ে পড়ে। ২০০৬ সালের ২০ জানুয়ারি ইউনেস্কো থেকে পাঠানো একটি হেরিটেজ গবেষণা টিম মসজিদের কাঠামোর স্থায়ীত্ব পরীক্ষার জন্য ছাদের একটা অংশ ভেঙে দেখছিলো। তবে একদল অচেনা মানুষদের পবিত্র মসজিদের ছাদে এমন কার্যক্রমে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে ভুল বোঝাবোঝি হয় এবং ব্যাপক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে তারা দ্রুত নেমে যান। কিন্তু এই উত্তেজনাকর সময়ে মসজিদের পাখাগুলো একদল দুস্কৃতকারী খুলে নিয়ে শহরে পালিয়ে যায়। উত্তেজিত জনগণ সাংস্কৃতিক দলকে সামনে পেয়ে তাদেরকে দোষী মনে করে। তারা সাংস্কৃতিক মিশন ও শহরের মেয়রের বাসভবনে হামলা করে এবং মসজিদের ইমাম ও তার ভাইয়ের চারটি গাড়ি ভাংচুর করে। নিহত হবার ঘটনাও ঘটে। এভাবেই জেনির স্থানীয় অধিবাসীরা ঐতিহ্যবাহী মসজিদের সাথে আবেগের সম্পর্ক তৈরী করে নিয়েছে।

মালিতে আরো কিছু মসজিদ আছে যা গ্রেট জেনি মসজিদের চেয়েও পুরাতন তবে নির্মাণশৈলী এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে গ্রেট মসজিদটিই জেনি শহর এবং পুরো মালির জন্য বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। মালির জাতীয় প্রতীকে জেনি মসজিদ স্থান পেয়েছে। জেনি মসজিদের মর্যাদা মালির আশেপাশের অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৩০ সালে দক্ষিণ ফ্রান্সের ফ্রেজুস শহরে জেনি মসজিদের একটি বাস্তব প্রতিলিপি তৈরী হয়। সিমেন্ট দিয়ে তৈরী করে মেটে রংয়ের আস্তর করে মূল মসজিদের সাথে সাদৃশ্য আনা হয়। ধারনা করা হয় শীতকালীন মহড়া উপলক্ষে যেসব পশ্চিম আফ্রিকান ঔপনিবেশিক সৈন্যকে এখানে অবস্থান করতে হতো তাদের নামাজের জায়গা হিসেবে এটি তৈরী করা হয়। ২০০৫ সালে সাহারা সিনেমায় মালির ঐতিহ্য হিসেবে এই মসজিদ প্রদর্শিত হয়। ১৯৮৮ সালে মসজিদসহ পুরো জেনি শহরটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us