মুসলিম জাতির অনন্য বৈশিষ্ট্য

মাওলানা জাফর আহমাদ | Feb 27, 2020 03:08 pm
মুসলিম জাতির অনন্য বৈশিষ্ট্য

মুসলিম জাতির অনন্য বৈশিষ্ট্য - ছবি : সংগ্রহ

 

‘আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী জাতিতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা দুনিয়াবাসীদের ওপর সাক্ষী হতে পারো এবং রাসূল সা: হতে পারেন তোমাদের ওপর সাক্ষী’ (সূরা বাকারা-১৪৩)।

গোঁড়ামি ও চরমপন্থা শব্দ দুটি সামনে আসলে বনি ইসরাইল জাতির ইতিহাস হৃদয়úটে ভেসে উঠে। এ জাতির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল গোঁড়ামি ও চরমপন্থা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বনি ইসরাইলদের হিদায়াতের জন্য অসংখ্য নবী ও রাসূল পাঠিয়েছিলেন এবং পৃথিবীবাসীর নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করে আল্লাহ তায়ালা তাদের ইতিহাসকে অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে বনি ইসরাইল! আমার সেই নিয়ামতের কথা স্মরণ কর, যা আমি তোমাদের দান করেছিলাম এবং এ কথাটিও যে আমি দুনিয়ার সমস্ত জাতির ওপর তোমাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলাম’ (সূরা বাকারা-৪৮)। পৃথিবীর ইতিহাসের এক দীর্ঘকালব্যাপী তারা এ নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু গোঁড়ামি ও চরমপন্থার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদেরকে নেতৃত্বের আসন থেকে অপসারিত করে মধ্যমপন্থী জাতি হিসেবে উম্মতে মুহাম্মদ সা:-এর হাতে নেতৃত্বের দণ্ড তুলে দিলেন।

আল কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় ইসরাইল জাতির গোঁড়ামির ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। তাদের গোঁড়ামির ইতিহাসে বহু ঘটনা মানবতার জন্য অনন্তকাল উজ্জ্বল দিকনির্দেশনা লাভের দীপশিখা হিসেবে কাজ করবে।’ আল কুরআনের ইতিহাসে পৃথিবীর ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর ধ্বংসের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো চরমপন্থা অবলম্বন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘পূর্ববর্তী ইবরাহিমের জাতি এবং আদ, সামুদ ও নুহের জাতিসমূহ এবং মাদায়েনবাসী ও মুতাফিকাতধারীদের ইতিহাস কি তারা জানে না? তাদের কাছে নবীরা সুস্পষ্ট নির্দেশমালা নিয়ে এসেছিলেন। আল্লাহ তাদের ওপর জুলুম করেননি, বরং তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছিল। পক্ষান্তরে ঈমানদার নারী-পুরুষরা পরস্পরের মিত্র ও সহযোগী। তারা ভালো কাজের আদেশ করে ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে’ (সূরা তাওবা-৭০-৭১)।

ইসলাম ভারসাম্য নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। জীবনের প্রতিটি অধ্যায় ও বাঁকে ভারসাম্যপূর্ণ নীতির অনুপম শিক্ষা একমাত্র ইসলামই দিয়েছে। রাসূল সা: সমগ্র মানব সমাজকে ভেতর থেকে এমনভাবে বদলে দিয়েছিলেন যে, সমগ্র সমাজ ও সভ্যতায় ভারসাম্য স্থাপিত হয়েছিল। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে মানুষের মন-মগজ, চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি, রীতি-প্রথা, আদত-অভ্যাস, অধিকার ও কর্তব্যের বণ্টনরীতি, ন্যায় ও অন্যায়ের এবং হালাল ও হারামের মানদণ্ড বদলে গিয়েছিল। সভ্যতার একেকটি অঙ্গেরও একেকটি প্রতিষ্ঠানের আমুল পরিবর্তন সাধিত হলো। এই পরিবর্তনের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত কোথাও অসঙ্গতি ও ভারসাম্যহীনতা দৃষ্টিগোচর হয়নি। এর কোনো অংশেই অকল্যাণ নেই, কোথাও নেই বিকৃতি।

শুরুতে উল্লিখিত আয়াতটিতে মুহাম্মদ সা:-এর উম্মতের নেতৃত্বের ঘোষণার বাণী শুনানো হয়েছে। ‘এভাবেই’ শব্দটির সাহায্যে দু’দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এক. আল্লাহর পথপ্রদর্শনের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যার ফলে মুহাম্মদ সা:-এর আনুগত্যকারীরা সত্য-সরল পথের সন্ধান পেয়েছে এবং তারা উন্নতি করতে করতে এমন একটি মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে, যেখানে তাদের ‘মধ্যমপন্থী’ গণ্য করা হয়েছে। দুই. কিবলাহ পরিবর্তনের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। বাইতুল মাকদিস থেকে কাবার দিকে মুখ ফেরানোর অর্থ হচ্ছে, মহান আল্লাহ বনি ইসরাইলকে বিশ্ববাসীর নেতৃত্ব পদ থেকে যথানিয়মে হটিয়ে উম্মতে মুহাম্মদিকে সে পদে সমাসীন করে দিলেন।

‘মধ্যমপন্থী উম্মত’ শব্দটি অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক তাৎপর্যের অধিকারী। এর অর্থ হচ্ছে- এমন একটি উৎকৃষ্ট ও উন্নত মর্যাদাসম্পন্ন দল, যারা নিজেরা ইনসাফ, ন্যায়-নিষ্ঠা ও ভারসাম্যের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, দুনিয়ার জাতিদের মধ্যে যারা কেন্দ্রীয় আসন লাভের যোগ্যতা রাখে, সত্য ও সততার ভিত্তিতে সবার সাথে যাদের সম্পর্ক সমান এবং কারো সাথে যাদের কোনো অবৈধ ও অন্যায় সম্পর্ক নেই।
যার দরুণ নবী সা: কোনো সময় ইসলামের হুকুম বা সিদ্ধান্ত পেশকালীন সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন উত্থাপন করলে তিনি বলতেন, তোমাদের অবস্থা যেন বনি ইসরাইল জাতির উম্মতদের মতো না হয়ে যায়।

একটি ভারসাম্যপূর্ণ জাতির নেতা হিসেবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর রাসূল সা:কে এ ধরনের নসিহতই করেছেন- ‘তোমার হাত গলার সাথে বেঁধে রেখো না, আর একেবারে খোলা ছেড়েও দিও না- অন্যথায় তুমি তিরস্কৃত ও অক্ষম হয়ে যাবে’ (সূরা বনি ইসরাইল-২৯)। এর অর্থ হলো- লোকদের মধ্যে এতটুকু ভারসাম্যতা থাকতে হবে যাতে তারা কৃপণ হয়ে অর্থের আবর্তন রুখে না দেয় এবং অপব্যয়ী হয়ে নিজের অর্থনৈতিক শক্তি ধ্বংস না করে ফেলে। এর বিপরীত পক্ষে তাদের মধ্যে ভারসাম্যের এমন সঠিক অনুভূতি থাকতে হবে, যার ফলে তারা যথার্থ ব্যয় থেকে বিরত হবে না। আবার অযথা ব্যয়জনিত ক্ষতিরও শিকার হবে না। এ ভারসাম্য শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, মুসলমানদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রযোজ্য।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তোমরাই হলে শ্রেষ্ঠ জাতি। তোমাদের সৃষ্টিই করা হয়েছে মানবতার কল্যাণের জন্য। তোমরা সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে’ (সূরা আল ইমরান-১১০)। ‘উখরিজাত লিন নাস’ (সমগ্র মানব জাতির কল্যাণের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে) দুঃখের বিষয় যে সব সঙ্কীর্ণমনা ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সামাজিক মর্যাদার এই সুউচ্চ মাপকাঠি এবং সামাজিক জীবনের এই সুমহান লক্ষ্যকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে না, তারাই মূলত চরমপন্থার সঙ্কীর্ণ রাস্তা ধরে চলে। আর এরাই কোনো এক পর্যায়ে এসে ইসলামের দুশমনদের তৈরি ‘জাতীয়তাবাদ বা স্বাদেশিকতাবাদ’ এর এক ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়।

এই স্বাদেশীকতাবাদ ও জাতীয়তাবাদ সামান্য রদবদলের পর সহজেই জাতীয় ও স্বাদেশীক সঙ্কীর্ণতা এবং অন্ধ গোঁড়ামির রূপ পরিগ্রহ করে। এই সঙ্কীর্ণতা ও গোঁড়ামিই মানবতার কৃত্রিম ও অস্বাভাবিক শ্রেণী বিভক্তির জন্য দায়ী। উল্লিখিত আয়াতটির ‘উখরিজাত লিন নাস’ (সমগ্র মানব জাতির কল্যাণের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে) দ্বারা প্রকৃতপক্ষে মানবতার এই কৃত্রিম ও অস্বাভাবিক বিভক্তিকেই খণ্ডন করেছে। সামাজিক মর্যাদার এই সুমহান মাপকাঠিকে উপস্থাপিত করে আল কুরআন মুসলিম জাতিকে মানবতার সেবার সেই সুমহান লক্ষ্যের দিকে পথনির্দেশ করেছে যা সব ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে। একটি সত্যসন্ধ ও ন্যায়নিষ্ঠ জাতির কর্তব্য হলো কখনো বর্ণ, ভাষা কিংবা অন্য কোনো কিছুরই সীমিত গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ না হওয়া। তাদের কাছে সব মানুষ তথা সব আদম সস্তানই সমান। এ জন্য তাদের সবার সেবা করা অবশ্য কর্তব্য। বর্তমান প্রাচ্য ও প্রতিচ্য স্বীয় হীন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে জিহাদের কতগুলো অপব্যাখ্যা করে কিছু অতিউৎসাহী মুসলিমকে গোঁড়ামির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

ইসলামের জিহাদও একটি ভারসাম্য নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সব প্রকার বিপর্যয় ও নৈরাজ্য, লোভ ও লালসা, শত্রুতা ও প্রতিহিংসা, গোঁড়ামি ও কুপমণ্ডুকতার সর্বাত্মক আগ্রাসন প্রতিরোধের জন্য আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাহদেরকে তরবারি উত্তোলনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, তাদেরকে প্রতিরোধযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার অনুমতি দেয়া যাচ্ছে। কেননা, তাদের ওপর অত্যাচার হয়েছে। আল্লাহ তাদের সাহায্য করার ক্ষমতা অবশ্যই রাখেন। এরা সেইসব লোক, যাদের বিনা অপরাধে তাদের গৃহ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

তাদের একমাত্র অপরাধ, তারা আল্লাহকে নিজেদের একক মনিব ও প্রভু বলে ঘোষণা করেছে’ (সূরা হজ-৬)। পরিত্র কুরআনে যুদ্ধ সম্পর্কে যতগুলো আয়াত আছে, তার মধ্যে এ আয়াতটিই প্রথম নাজিল হয়েছে। মুসলমানদের এ কথা বলা হয়নি যে, তাদের একটি উর্বর ভূখণ্ড আছে কিংবা বড় রকমের বাণিজ্যিক এলাকা আছে, কিংবা তারা ভিন্ন ধর্মের অনুসারী, তাই যুদ্ধের মাধ্যমে তা দখল করে নাও। বরং যেহেতু তারা অত্যাচারী, বিনা অপরাধে তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে এবং আল্লাহকে একমাত্র প্রভু মেনে নেয়ার কারণে নির্যাতন করছে, তাই এর প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষার জন্য যুদ্ধ করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়াও দুর্বল, অসহায় মজলুমদের জালেমদের হাত থেকে রক্ষার জন্য জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে।

মধ্যম জাতি হিসেবে মুসলমানদের বৈশিষ্ট্যের কথা আল্লাহ তায়ালা আল কুরআনে এভাবে উল্লেখ করেছেন- ‘রহমানের (প্রকৃত) বান্দাহ তারা- যারা ভূপৃষ্ঠে নম্রতার সাথে চলাফেরা করে, আর জাহেল লোকেরা তাদের সাথে কথা বলতে এলে বলে দেয় যে, তোমাদের সালাম। যারা নিজেদের রবের নিকট সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকে রাত এবং যারা এই বলে দোয়া করে যে, হে আমাদের রব, জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করো। জাহান্নামের আজাব তো প্রাণান্তকর লেগে থাকে। নিশ্চয়ই বিশ্রামস্থল এবং বাসস্থান হিসেবে তা অত্যন্ত জঘন্য এবং যারা খরচের বেলায় বেহুদা খরচ কিংবা কার্পণ্য করে না; বরং দু’সীমার মাঝামাঝি মধ্যম নীতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে’ (সূরা ফুরকান- ৬৩-৬৭)।

‘তোমার চাল-চলনে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো এবং কণ্ঠস্বর খাটো করো’ (সূরা লোকমান-১৯)।
‘লোকদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কথা বলো না, আর গর্বভরে জমিনে হাঁটাচলা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো আত্ম-অহঙ্কারী, দাম্ভিক লোককে পছন্দ করেন না’ (সূরা লোকমান- ১৮)।

সুতরাং মুসলমান কখনও গোঁড়ামি ও চরমপন্থা অথবা অতি উদার নীতি কখনও গ্রহণ করতে পারে না। তাই মধ্যমপন্থী জাতি হিসেবে আমাদের কথা ও কাজে গোঁড়ামি ও চরমপন্থা ও অতি উদারতাকেও পরিহার করতে হবে এবং ন্যায় ও ইনসাফের জন্য অগ্রসর হতে হবে। আলাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! সত্যের ওপর স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত ও ইনসাফের সাক্ষ্যদাতা হয়ে যাও। কোনো দলের শুত্রুতা তোমাদের যেন এমন উত্তেজিত না করে দেয়, যার ফলে তোমরা ইনসাফ থেকে সরে যাও। ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত করো। এটি আল্লাহভীতির সাথে বেশি সামঞ্জস্যশীল। আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তার খবর রাখেন’ (সূরা মায়েদা-৮)।

লেখক : সিনিয়র ব্যাংকার


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us