জাতীয় সঙ্কট যেভাবে সমাধান করতেন হজরত ওমর (রা.)

হাফেজ মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুম | Apr 18, 2020 05:43 am
জাতীয় সঙ্কট যেভাবে সমাধান করতেন হজরত ওমর (রা.)

জাতীয় সঙ্কট যেভাবে সমাধান করতেন হজরত ওমর (রা.) - সংগৃহীত

 

হজরত উমর রা:। মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা। হজরত আবু বকর রা:, হজরত উমর রা:, হজরত উসমান রা: ও হজরত আলী রা: চার খলিফার অনুসরণের কথা হাদিসে বলা হয়েছে। বিশেষত প্রথম দু’জনের কথা। এক হাদিসে এসেছেÑ ‘তোমরা আমার পরে আবু বকর ও উমরের অনুসরণ করবে’ (জামে তিরমিজি, হাদিস-৩৬৬৩)।

হজরত উমর রা:-এর খেলাফত সময়কাল ছিল বেশ দীর্ঘ। ১০ বছর ছয় মাস প্রায়। তাঁর সময়কালে ইসলামের প্রচারও হয়েছে অধিক। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন নীতিমালা ও অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- জাতীয় সঙ্কটকালে তাঁর গৃহিত নীতিমালা। যা যুগ যুগ ধরে সর্বকালের শাসকদের জন্য শিক্ষণীয় হয়ে আছে। আমাদের দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। দেশের শাসকও মুসলিম। তাই এটি খুবই সঙ্গতিপূর্ণ যে, একজন মুসলিম শাসক হিসেবে আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্ণধার বর্তমান পরিস্থিতিতে হজরত উমর রা:-এর গৃহীত রাষ্ট্রীয় নীতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন। এখানে সংক্ষেপে তা উল্লেখ করা হলোÑ
মৌলিকভাবে হজরত উমর রা: জাতীয় অর্থনৈতিক সঙ্কট ও মহামারীর সময় যে নীতিগুলো গ্রহণ করতেন তা দুই ভাগে বিভক্ত। এর প্রথমটি হলোÑ ব্যক্তিগত উদ্যোগ, দ্বিতীয়তটিÑ জাতীয় অর্থনৈতিক উদ্যোগ

ব্যক্তিগত উদ্যোগ : সময়টি তখন ১৭তম হিজরি। আরবের হিজাজ ও ইয়েমেনসহ আশেপাশের অঞ্চলে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। অনাবৃষ্টি। মহামারী। দুর্ভিক্ষ। ক্ষুধার্থ মানুষের মিছিল। মানুষ, পশু কিছুই মৃত্যুর হাতছানি থেকে রেহাই পাচ্ছে না। প্রতিদিন মৃত্যুর সংবাদ আসছে। স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। থমকে গেছে জীবনের উচ্ছ্বলতা। ধসে পড়ছে অর্থনৈতিক অবকাঠামো। ইতিহাসে তা ‘আমুর-রামাদাহ’ নামে পরিচিত। ‘রামাদাহ’ মানে পুড়ে ছাই হওয়া, ভস্ম হওয়া, ধ্বংস হওয়া। এ সময়ে অনাবৃষ্টিতে জমিন পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। মানুষ ও পশু ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। দুই-তিন বছর তা স্থায়ী ছিল।
এ কঠিন সময়ে একজন রাষ্ট্রপতি হিসেবে হজরত উমর রা: ব্যক্তিগতভাবে যে উদ্যোগগুলো নিয়েছিলেন, তা হলো-


১. জাতির কল্যাণ চিন্তায় মনোনিবিষ্ট হওয়া : সঙ্কট চলাকালে দেশ ও জনগণের চিন্তায় হজরত উমর রা: এতটা মনোনিবিষ্ট হয়ে যেতেন, এতটাই পেরেশান হয়ে যেতেন, যা তার বিভিন্ন আচার-আচরণে প্রকাশ পেত। কিভাবে জাতিকে চলমান সঙ্কট থেকে মুক্ত করা যায় এ চিন্তা তার একান্ত ব্যক্তিগত চিন্তায় রূপ নিতো।

যে উমর রা: ভয় পেতেন, না জানি আল্লাহতায়ালা তাকে কোনো ছাগল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে বসেন, যে ফুরাত নদীর তীরে না খেয়ে মারা গেছে। সেই উমর রা: জাতির দুর্দিনে কতটা চিন্তামগ্ন ও জাতির জন্য নিবেদিত হয়ে যেতেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সঙ্কটকালে তাঁর দোয়ার নিয়মিত অংশ হেয় যেত এই দোয়াÑ ‘হে আল্লাহ, উম্মতে মুহাম্মদির ধ্বংস আমার হাতে ও আমার শাসনকালে রেখো না।’
জায়েদ বিন আসলাম বলেন, সঙ্কটকালে জাতিকে নিয়ে হজরত উমর রা: এতটা ব্যাতিব্যস্ত হয়ে যেতেন, আমরা তখন বলাবলি করতাম, আল্লাহতায়ালা যদি এই সঙ্কটময় অবস্থা তুলে না নেন, তাহলে মুসলিম জাতির চিন্তায় একসময় উমর মারাই যাবেন।

একজন শাসক যখন এভাবে জাতির চিন্তায় আত্মনিমগ্ন হন, তখন সঙ্কট থেকে উত্তরণের বিভিন্ন পথ ও উপায় আল্লাহর দয়ায় দ্রুত বের হয়ে আসে।

২. জাতির কষ্ট ও দুর্ভোগে নিজেকেও শামিল করা : জাতীয় সঙ্কটকালে হজরত উমর রা: নিজের জীবন মানকে সঙ্কুচিত করে নিতেন। কষ্ট ও দুর্ভোগে জাতির সাথে একাকার হয়ে যেতেন। বর্ণিত আছে, তিনি এ সময় তার কোনো সন্তানের ঘরে কিংবা তার স্ত্রীর ঘরে ওই মানের খাবারই খেতেন, যা জনগণ খেতো। যতদিন যাবৎ আল্লাহ তায়ালা জাতির অবস্থা উন্নত করেন।
জাতীয় সঙ্কটকালে একবার তাঁর এক স্ত্রী তার জন্য ঘি নিয়ে আসলেন। তিনি বললেন- ‘সব মানুষের অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি এমন দামি খাবার খাবো না’।

একজন শাসক যখন, সঙ্কটকালে নিজের জীবন মান সাধারণ পর্যায়ে নিয়ে আসেন, জাতির কষ্টে একাকার হয়ে যান, তখন জনগণ উৎসাহিত হয়। সবর ও সংযম অবলম্বন করতে আগ্রহী হয়ে উঠে। সঙ্কট প্রতিরোধে এক হয়ে কাজ করে। আর এভাবেই খুব দ্রুত সঙ্কট দূর হয়ে যায়।

সঙ্কটকালে হজরত উমর রা:-এর জাতীয় অর্থনৈতিক উদ্যোগ

১. সঙ্কট মুকাবেলায় রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা : জাতীয় সঙ্কটকালে তৎকালীন যুগে গ্রাম ও মরুভূমির মানুষ রাজধানী মদিনায় চলে আসত। হজরত উমর রা: সঙ্কট শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের সবার আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতেন। আর যারা আসতে পারতেন না, তাদের কাছে ত্রাণ পাঠিয়ে দিতেন।

প্রতিদিন কতজন মানুষ মদিনায় আসছেন, কতজন আসতে পারছেন না, এগুলো যথাযথভাবে হিসাব রাখার জন্য তিনি আলাদা লোকবল নিয়োজিত রাখতেন। একজন মানুষও যেন অনাহারে না থাকে, সে ব্যবস্থা করতেন।
মদিনার সদর দরজায় প্রশাসনিক লোক নিয়োগ দিতেন। তাদের প্রত্যেকের তথ্য লিপিবদ্ধ করা হতো। পুরোদস্তুর উন্নত প্রশাসনিক পন্থায় তা পরিচালনা করতেন।

বর্ণিত আছে, তৎকালীন মরুবাসী উট জবাই করে খেতো না। তাই তিনি তাদের উট না পাঠিয়ে, তা জবাই করে গোশত পাঠিয়ে দিতেন।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি পুরো দেশের মানুষের কী অবস্থা, সবাই যথাযথভাবে আহার পাচ্ছে কি না তা খোঁজ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে মিটিং করতেন। এই দীর্ঘ মিটিং প্রতিদিন সন্ধ্যায় হতো। সেখান থেকে পরবর্তী কর্মপন্থাও ঠিক করা হতো।

আজকের শাসকদের জন্য এখানে বড় শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। শুধু নামমাত্র ত্রাণ পৌঁছে দিয়ে মিডিয়া কভারেজ করা, সেটা যথাযথভাবে পৌঁছল কি না তা খোঁজ না নেয়া খুবই অন্যায়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করা এ সময় খুবই জরুরি। হজরত উমর রা: সেই কাজটি করেছিলেন।

২. দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কট মোকাবেলায় অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উন্নয়ন : মহামারী দীর্ঘ হলে হজরত উমর রা: অস্থায়ী উদ্যোগের পাশাপাশি স্থায়ী উদ্যোগও গ্রহণ করতেন। ইতিহাসে বর্ণিত আছে, দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কটে মানুষের যেন খাদ্য নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য তিনি মিসর থেকে খাদ্য আমদানির ঐতিহাসিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এ জন্য তিনি হেজাজ ও মিসরের মাঝে কৃত্রিম উপসাগর তৈরি করেছিলেন। আমাদের বর্তমান করোনা পরিস্থিতি একটি দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কট। এ অবস্থায় খাদ্য সরবরাহ যেন যথাযথ থাকে, সে দিকে লক্ষ রাখা সরকারের প্রধান দায়িত্ব।

৩. মানুষকে সংযমি হতে বলা : সঙ্কটকালে হজরত উমর রা: জনগণকে সংযমি জীবন যাপনের কথা বলতেন। আর এটা তিনি স্বয়ং নিজ ও নিজের পরিবার দিয়ে শুরু করতেন। যেমনটি আগে বর্ণিত হয়েছে। তিনি জনগণকে একই দস্তরখানে ঘি ও গোশত একত্র করতে নিষেধ করতেন। শুধু তাই নয়, অল্প উপাদান দিয়ে কিভাবে অধিক খাদ্য তৈরি করা যায়, তিনি সেটা নিজে শিখিয়ে দিতেন।

৪. স্বল্পমূল্যে খাবার দেয়া : সঙ্কট চলাকালে তিনি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে স্বল্পমূল্যে খাদ্য সরবরাহ করতেন। এর জন্য তিনি চমৎকার কার্ড তৈরি করেছিলেন। তাতে প্রত্যেকে কী পরিমাণ খাবার নিতে পারবে ও কত মূল্যে সেটা লেখা থাকত। এই কার্ড দিয়ে স্বল্পমূল্যে পর্যাপ্ত খাবার নেয়া যেতো। অনেকটা রেশন কার্ডের মতো। এই কার্ডগুলো সরকারি উদ্যোগে যোগ্য লোকদের কাছে পৌঁছে দেয়া হতো।

৫. বিত্তবানদের ওপর দরিদ্রদের দায়িত্ব অর্পণের ঘোষণা : সঙ্কট আরো তীব্র হলে, স্থায়ী হলে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সম্ভব না হলে, চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি প্রতি দু’জন বিত্তবানের ওপর একজন দরিদ্রের দায়িত্ব অর্পণ করে দেয়ারও ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন। যদিও তা পরবর্তীতে করতে হয়নি। এটি অত্যন্ত চমৎকার পদ্ধতি। আমরা যারা বিত্তবান আছি খুব সহজেই সঙ্কটকালে দরিদ্রদের সাময়িক দায়িত্ব নিতে পারি। এ ব্যাপারে বিত্তবানদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য সরকার উৎসাহমূলক নানা পদক্ষেপও নিতে পারে। যেমনÑ তাদের কর হ্রাস করা ইত্যাদি।

৬. পশুর জাকাত স্থগিত করা : সঙ্কটকালে হজরত উমর রা: ক্ষতিগ্রস্থ লোকদের কাছ থেকে পশুর জাকাত মওকুফ করে দিতেন। কারণ এর ওপর মানুষের জীবন তখন নির্ভর করত। সরকার এর অনুসরণে কর হ্রাস করতে পারে।

৭. কৃষি খাতের প্রতি গুরুত্ব প্রদান : যেকোনো দেশের মূল প্রাণ কৃষি খাত। কৃষকরা যেনো যথাযথ উপায়ে কৃষিকাজ অব্যাহত রাখে, সে জন্য সঙ্কটকালে তিনি কৃষকের প্রতি বিশেষ যতœ দিতেন। যেসব কৃষকরা মদিনায় চলে আসতেন, অবস্থা কিছুটা ভালো হওয়া মাত্রই তাদেরকে গ্রামে পাঠিয়ে দিতেন। তারা যেন কৃষিকাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। এ জন্য যা যা সহযোগিতা প্রয়োজন সবই করতেন।

৮. তাওবা ও ইস্তেগফার করা এবং আল্লাহ দিকে মনোনিবেশ করা : ইসলামী অর্থনীতির অংশ এটিও যে, সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য যেমনিভাবে বস্তুগত পার্থিব বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে, তেমনিভাবে সঙ্কটের মূল কারণ যেহেতু মানুষের পাপাচার, তাই মানুষকে তাওবা-ইস্তেগফারের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। এ অংশটি যদিও বর্তমান প্রচলিত অর্থনীতিতে অপরিচিত, তবে ইসলামী অর্থনীতিতে এটি খুবই সঙ্গতিপূর্ণ।

হজরত উমর রা:-এ পরিস্থিতিতে নিজেও আল্লাহর প্রতি বিশেষভাবে মনোনিবেশ করতেন, মানুষকেও উদ্বুদ্ধ করতেন। সঙ্কটকালে তিনি জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বলতেনÑ ‘হে লোক সকল, আমার ভয় হয়, হয়তো বা আল্লাহর ক্রোধ আমাদের ওপর ছেয়ে গেছে। সুতরাং তোমরা তোমাদের রবের দিকে ফিরে যাও। তার কাছে তাওবা করো। ভালো ও কল্যাণ কাজ করো।’

এ সময় তিনি নেক আমল বাড়িয়ে দিতেন। নফল নামাজ ও দোয়া অন্য সময়ের চেয়ে বেড়ে যেতো। (বিস্তারিত দেখুনÑ আল ফিকহুল ইকতিসাদি লি আমিরিল মুমিনিন উমার ইবনুল খাত্তাব রা:, পিএইচডি গবেষণা প্রবন্ধ, লেখক, ড. জারিবা ইবনে আহমদ, পৃষ্ঠা-৩৩৭)।

এখানে আমাদের শাসকদের জন্য বিরাট শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। জাতির উদ্দেশে ভাষণে মানুষকে তাওবা-ইস্তেগফারের প্রতিও আহ্বান করা উচিত।
আল্লাহতায়ালা আমাদের শাসক শ্রেণীকে হজরত উমর রা:-এর উপরোক্ত ১০টি কর্মপদ্ধতি থেকে অনুপ্রাণিত হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, ইসলামিক একাডেমি অ্যান্ড কনসালটেন্সি (আইএফএসি) ও সিনিয়র ডেপুটি মুফতি, জামিয়া শরিয়াহ মালিবাগ, ঢাকা


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us