নবীজী ও বারাকার গল্প

প্রকৌশলী মো: মাহমুদুর রহমান রনি | Jun 15, 2020 02:24 pm
মদিনা শরিফ

মদিনা শরিফ - ছবি : সংগৃহীত

 

আমাদের নবীর পিতা আবদুল্লাহ, একদিন মক্কার বাজারে গিয়েছিলেন কিছু কেনাকাটা করার জন্য। এক জায়গায় তিনি দেখলেন, এক লোক কিছু দাস-দাসী নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বিক্রি করছেন।


আবদুল্লাহ দেখলেন, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট ৯ বছরের কালো আফ্রিকান আবিসিনিয়ার মেয়ে। মেয়েটাকে দেখে আবদুল্লাহর অনেক মায়া হলো, একটু রুগ্ন হালকা-পাতলা কিন্তু কেমন মায়াবী। অসহায় দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে।
তিনি ভাবলেন ঘরে আমেনা একা থাকেন, মেয়েটা পাশে থাকলে তার একজন সঙ্গী হবে। এই ভেবে তিনি মেয়েটাকে কিনে নিলেন।
মেয়েটিকে আবদুল্লাহ ও আমেনা অনেক ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন এবং তারা লক্ষ্য করলেন, তাদের সংসারে আগের চেয়েও বেশি রহমত ও বরকত চলে এসেছে। এই কারণে আবদুল্লাহ ও আমেনা মেয়েটিকে আদর করে নাম দিলেন ‘বারাকাহ’।

এই গল্প, বারাকার গল্প
তারপর একদিন আবদুল্লাহ ব্যবসার কারণে সিরিয়া রওনা দিলেন। আমেনার সাথে সেটাই ছিল তার শেষ বিদায়। তার যাত্রার দু-একদিন পর আমেনা একরাতে স্বপ্নে দেখলেন, আকাশের একটা তারা যেন খুব আলো করে তার কোলে এসে পড়ল।
পরদিন ভোরে তিনি বারাকাকে এই স্বপ্নের কথা বললেন।

উত্তরে বারাকা মৃদু হেসে বললেন, ‘আমার মন বলছে আপনার একটা সুন্দর সন্তানের জন্ম হবে’।
আমেনা তখনও জানতেন না তিনি গর্ভধারণ করেছেন। কিন্তু কিছু দিন পর তিনি বুঝতে পারলেন, বারাকার ধারণাই সত্যি। আবদুল্লাহ আর ফিরে আসেননি, সিরিয়ার পথেই মৃত্যুবরণ করেন। আমেনার সেই বিরহ ও কষ্টের সময়ে, বারাকা ছিলেন একমাত্র সবচেয়ে কাছের সঙ্গী।
একসময় আমেনার অপেক্ষার শেষ হয় এবং তিনি জন্ম দিলেন আমাদের প্রিয় নবীকে। শেখ ওমর সুলাইমানের বর্ণনা অনুযায়ী, সর্বপ্রথম আমাদের নবীকে দেখার ও স্পর্শ করার সৌভাগ্য হয়েছিল যে মানুষটির, সেই হলো এই আফ্রিকান ক্রীতদাসী ছোট্ট কালো মেয়েটির।


আমাদের নবীকে নিজ হাতে আমেনার কোলে তুলে দিয়েছিলেন আর আনন্দে ও খুশিতে বলেছিলেন, ‘আমি কল্পনায় ভেবেছিলাম সে হবে চাঁদের মতো কিন্তু এখন দেখছি, সে যে চাঁদের চেয়েও সুন্দর।’
এই সেই বারাকা। নবীজীর জন্মের সময় তার বয়স ছিল ১৩ বছর। ছোটবেলায় শিশু নবীকে আমেনার সাথে যতœ নিয়েছেন, গোসল দিয়েছেন, খাওয়াতে সাহায্য করেছেন, আদর করে ঘুম পাড়িয়েছেন।
মৃত্যুর সময় আমেনা, বারাকার হাত ধরে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি যেন তার সন্তানকে দেখেশুনে রাখেন। বারাকা তাই করেছিলেন। বাবা-মা দু’জনকেই হারিয়ে, ইয়াতিম নবী চলে এলেন দাদা আবদুল মোত্তালিবের ঘরে। উত্তরাধিকার সূত্রে নবী হলেন বারাকার নতুন মনিব। কিন্তু তিনি এক দিন বারাকাকে মুক্ত করে দিলেন, বললেন, ‘আপনি যেখানে ইচ্ছে চলে যেতে পারেন, আপনি স্বাধীন ও মুক্ত।’
সেই শিশুকাল থেকেই নবী এই ক্রীতদাস প্রথাকে দূর করতে চেয়েছিলেন। বারাকা নবীকে ছেড়ে যেতে রাজি হলেন না। রয়ে গেলেন। মায়ের ছায়া হয়ে পাশে থেকে গেলেন।

এমনকি নবীজীর দাদা তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না। তার একই কথাÑ ‘আমি আমেনাকে কথা দিয়েছি, আমি কোথাও যাবো না।’
তারপর একদিন খাদিজা রা:-এর সাথে নবীজীর বিয়ে হলো। বিয়ের দিন রাসূল সা: খাদিজা রা:-এর সাথে বারাকাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, ‘উনি হলেন আমার মায়ের পর আরেক মা।’

বিয়ের পর রাসূল সা: একদিন বারাকাকে ডেকে বললেন, ‘উম্মি! আমাকে দেখাশোনা করার জন্য এখন খাদিজা আছেন, আপনাকে এখন বিয়ে করতেই হবে’ (নবীজী তাকে উম্মি ডাকতেন, নাম ধরে ডাকতেন না)।
তারপর রাসূল সা: ও খাদিজা মিলে তাকে উবাইদ ইবনে জায়েদের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন। কিছু দিন পর বারাকার নিজের একটা ছেলে হলো, নাম আইমান। এরপর থেকে বারাকার নতুন নাম হয়ে গেল ‘উম্মে আইমান’।


একদিন বারাকার স্বামী উবাইদ মৃত্যুবরণ করেন, নবীজী গিয়ে আইমান ও বারাকাকে সাথে করে নিজের বাড়ি নিয়ে আসেন এবং সেখানেই থাকতে দিলেন।
কিছু দিন যাওয়ার পর নবীজী একদিন বেশ কয়েকজন সাহাবিকে ডেকে বললেন, ‘আমি একজন নারীকে জানি, যার কোনো সম্পদ নেই, বয়স্ক এবং সাথে একটা ইয়াতিম সন্তান আছে, কিন্তু তিনি জান্নাতি, তোমাদের মধ্যে কেউ কি একজন জান্নাতি নারীকে বিয়ে করতে চাও?’
এ কথা শুনে জায়েদ ইবনে হারিসা রা: নবীজীর কাছে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। নবীজী উম্মে আইমানের সাথে কথা বলে বিয়ের আয়োজন করলেন।
বিয়ের দিন রাসূল সা: জায়েদকে বুকে জড়িয়ে আনন্দে ও ভালোবাসায়, ভেজা চোখে, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি কাকে বিয়ে করেছ, জানো জায়েদ?’
-হ্যাঁ, উম্মে আইমানকেÑ জায়েদের উত্তর। নবীজী বললেন, ‘না, তুমি বিয়ে করেছ, আমার মাকে।’

সাহাবিরা বলতেন, রাসূল সা:-কে খাওয়া নিয়ে কখনো জোর করা যেত না। তিনি সেটা পছন্দ করতেন না। কিন্তু উম্মে আইমান একমাত্র নারী, যিনি রাসূল সা:-কে খাবার দিয়ে ‘খাও’ ‘খাও’ বলে তাড়া দিতেন। আর খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাশে বসে থাকতেন। নবীজী মৃদু হেসে, চুপচাপ খেয়ে নিতেন।
রাসূল সা: তাঁর দুধ মাতা হালিমাকে দেখলে যেমন করে নিজের গায়ের চাদর খুলে বিছিয়ে তার ওপর হালিমাকে বসতে দিতেন ঠিক তেমনি মদিনায় হিজরতের পর দীর্ঘ যাত্রা শেষে উম্মে আইমান যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন নবীজী তাঁর গায়ের চাদরের একটা অংশ পানিতে ভিজিয়ে, উম্মে আইমানের মুখের ঘাম ও ধুলোবালি নিজ হাতে মুছে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘উম্মি! জান্নাতে আপনার এই রকম কোনো কষ্ট হবে না।’
নবীজী মৃত্যুর আগে সাহাবিদের অনেক কিছুই বলে গিয়েছিলেন। সেই সব কথার মধ্যে উম্মে আইমানের কথাও বলেছিলেন। এর মধ্যে একটা ছিল, ‘তোমরা উম্মে আইমানের যতœ নিবে, তিনি আমার মায়ের মতো। তিনিই একমাত্র নারী, যিনি আমাকে জন্ম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখেছেন। আমার পরিবারের একমাত্র সদস্য, যিনি সারা জীবন আমার পাশে ছিলেন।’
সাহাবিরা সেই কথা রেখেছিলেন ও গায়ের রং নয়, একসময়ের কোনো ক্রীতদাসী নয়, তাঁর পরিচয় তিনি যে নবীর আরেক মা। মায়ের মতোই তাঁরা এই বৃদ্ধ নারীকে ভালোবেসে আগলে রেখেছিলেন।

সূত্র : ইবনে হিশাম ও শেখ ওমর সুলাইমান, "ডড়সধহ যিড় পধৎবফ ভড়ৎবাবৎ" থেকে সংগৃহীত


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us