প্রফেসর কাজী জাকের হোসেন ও একটি বাবুই পাখির ছানা

ড. নূর জাহান সরকার | Jun 21, 2020 09:53 am
কাজী জাকের হোসেন

কাজী জাকের হোসেন - প্রতীকী ছবি

 

২১ জুন আমার শিক্ষাগুরু প্রফেসর কাজী জাকের হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকী। স্যারকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধার সাথে। আজ একটি ঘটনার উল্লেখ করছি, যা কখনো লেখা হয়নি। যখনই লিখতে গেছি, তখনই কলম থেমে গেছে। কেননা, ঘটনাটি অত্যন্ত কষ্টদায়ক। তবুও আজ উল্লেখ করছি এ জন্য যে, ঘটনাটি বলে দেয় স্যার ছিলেন প্রাণিজগতের প্রতি কতটা মমতার।

মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের সময়টুকুতে পড়াশোনা একেবারে বন্ধ ছিল। ১৯৭২ সালে শুরু হলো আমাদের এমএসসি ফাইনাল ইয়ারের পড়াশোনা। রিসার্চসহ থিসিস গ্রুপে ক্লাস করার সুযোগ পেলাম, বন্যপ্রাণী শাখায়। ফিল্ড ওয়ার্কও করা শুরু করলাম। গ্রীষ্মের কোনো একদিন আমরা ফিল্ড ওয়ার্কের জন্য গেলাম ঢাকার বাইরে। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বন্যপ্রাণী শাখায় মোট চারজন ছাত্রছাত্রী ছিলাম। ফিল্ডে হঠাৎ দেখা গেল একটি বাবুই পাখির বাচ্চা, যার চোখ তখনো ফোটেনি, গায়ে কোনো পালক গজায়নি। বাচ্চাটি একটি তালগাছের তলায় পড়ে আছে, যে গাছে অনেক বাবুই পাখির বাসা। বাচ্চাটি তুলে নিলাম। আমার সাথের ছেলে ক্লাসমেটরা ভাবল, বাচ্চাটিকে ওর বাসায় রেখে আসবে। কিন্তু তালগাছে ওঠা সহজ নয়। সুতরাং তারা খুঁজতে থাকে, এ জন্য কাউকে পাওয়া যায় কি না।

কিন্তু আমি চিন্তা করলাম, ওর বাসা কোনটি তা তো আমরা জানি না। অতএব ওকে যেকোনো বাসায় রাখা যাবে না। কেননা নিজের মা ছাড়া অন্য মা হলে ওকে ফেলে দেবে। অতএব সবার সিদ্ধান্ত মোতাবেক, বাচ্চাটিকে আমার রুমালে আলতোভাবে তুলে রওনা দিলাম। যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে পৌঁছলাম। একটি ড্রপার দিয়ে ওকে ‘হা’ করিয়ে কতক্ষণ পরপর দুধ খাওয়ানো শুরু করলাম। পরের দিন সবাই মিলে বাবুই পাখির বাচ্চাটি নিয়ে উপস্থিত হলাম স্যারের কাছে, জানতে চাইলাম স্যার, ওটাকে কী করব? স্যার বললেন, এটাকে যতœ করে দেখাশোনা করো, ওভাবে কতক্ষণ পরপর খাওয়াতে থাকো। আমার ক্লাসমেটদের মধ্যে কেউ ওর দায়িত্ব নিতে রাজি হলো না, কেননা তারা সবাই ছেলে। মনে মনে আমি খুবই খুশি, ওকে নিজেই লালন পালন করব। সুতরাং চলতে থাকে ওর যতœআত্তি। পরের দিন থেকে বাচ্চাটাকে আমার সাথে ডিপার্টমেন্টে নিয়ে যেতে হয়। কেননা, ওকে তো কিছুক্ষণ পরপর খেতে দিতে হবে। অবশ্য আমার থিসিস ওয়ার্ক ছিল Sturnidae Family-এর অন্তর্গত প্রজাতিগুলো অর্থাৎ শালিক, ময়না প্রভৃতি পাখির ওপর। ওই কাজ করতে আমাকে ফিল্ড ওয়ার্ক করতে হয়, ল্যাব ওয়ার্কও করতে হয়। ল্যাবের কাজে আমাকে কিছু কাজ একটি টেবিল ল্যাম্পের নিচে রেখে করতে হয়।

এ দিকে, আস্তে আস্তে বাবুই বাচ্চাটির চোখ ফুটল, গায়ে পালক গজাতে শুরু করল, একটু একটু উড়তে শিখেছে, তবে প্রায়ই উড়ে এসে আমার কাঁধে বসে থাকে, কখনো টেবিল ল্যাম্পের স্ট্যান্ডে এসে বসে। দেখা গেল, ওটা ল্যাবের বেসিনে গোসল করার চেষ্টা করে। ও যাতে বেসিনে না যায় সে জন্য একটি ট্রেতে পানি দিলাম। পাখির বাচ্চা ওই ট্রেতে গোসল করা শুরু করল। গোসল করে লাইটের স্ট্যান্ডে বসে পালক শুকায়, যখন পালক শুকিয়ে ঝরঝরে হয়ে যায়, আমার ঘাড়ে বসে থাকে, ল্যাবের ভেতরে ওড়াউড়ি করে; কিন্তু বাইরে যায় না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, আমার আসা-যাওয়ার পথ রোকেয়া হল থেকে কার্জন হল, কার্জন হল থেকে রোকেয়া হল, ও আমার কাঁধেই বসে থাকে। প্রথম প্রথম ওকে কাঁধে বসা অবস্থায় একটু ধরতে হতো, না হয় ছুটে যাওয়ার ভয় হতো। ক্রমেই ও বাচ্চাটা রিকশায় আমার কাঁধে কাপড় আটকে থাকতে অভ্যস্ত হলো। এমনকি যখন রিকশা জোরে চলে, তখন ও বেশ জোরে আমার কাঁধ আঁকড়ে ধরে। বাচ্চাটা উড়ে চলে যায়ই না; বরং আঁকড়ে থাকে। হলের রুমের বাইরেও যায়। তবে বেশির ভাগ সময় জানালার বাইরে উঁকিঝুঁকি মারে। এক আধটু বাইরে গেলেও দ্রুত উড়ে রুমে ঢুকে পড়ে। বাইরে গেলেও উড়ে চলে যায় না। আমি ফিল্ড ওয়ার্কে গেলে রুমমেটরা ওটাকে খেতে দেয়। ধান-চাল খায়। রুমের বাথরুমের বালতিতে গোসল করে, টেবিল ল্যাম্পের স্ট্যান্ডে বসে পালক শুকায়।

হঠাৎ একদিন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে দেখতে যাচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা বিভাগ থেকে মাইক্রোবাসে করে বিশ^বিদ্যালয়ের ব্যবস্থায়। আমিও গেলাম ছোট্ট বাবুইকে নিয়ে। ও কাঁধ আঁকড়ে থাকল। কবি নজরুলকে দেখলাম। ভিড়ের মধ্যে বারবার বাবুইকে হাত দিয়ে আলগে আলগে কাঁধে নিয়ে ফিরতে পারলে বাঁচি। একে তো ভিড়ে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম; তার ওপর দু-একজন সাংবাদিকের নজর পড়েছে, পাখিটি উড়ে যায় না কেন? স্যারের অনুমতি ছাড়া তাদের কাউকে কিছু বলব না। ক’দিন আগে স্যার বলেছিলেন, সাংবাদিক ডেকে বিষয়টি তুলে ধরবেন।

একদিন এক উইকএন্ডে আমরা ফিল্ডওয়ার্কে গেলাম, আমার রুমমেটরা রইল ওর সাথে। ও তাদের কাঁধে কখনো বসে না; তবে ওদের পাশে পাশে উড়ে বেড়ায়। ওরা এতেই বেশ মুগ্ধ। ফিল্ডওয়ার্ক শেষে হলে ফিরলাম। তখন সন্ধ্যা ৬টায় মেয়েদের অবশ্যই হলে ফিরতে হতো, এর একটুকুও ব্যতিক্রম নয়। তবে অনেক কষ্টে স্যারের চিঠি জমা দিয়ে, প্রভোস্ট আপার অনুমোদন পেলাম যে, আধা-এক ঘণ্টা দেরি হলেও ঢুকতে পারব। সে দিন আমার একটু দেরিই হলো ফিরতে, বাস দেরি করেছে। রাতের আঁধার নেমেছে। হলে ফিরে দেখি, আমার রুমমেটরা খুবই মন ভার করে আছে। বললাম, কী হয়েছে রে তোদের? ওরা বলল, কিছ ুনা, তুই কিছু খা, খাবার নিয়ে এসেছি। বললাম, বল না কী হয়েছে? আমার বাড়ি থেকে কোনো চিঠি এসেছে? দুঃসংবাদ? ওরা বলল, না।

বললাম, তাহলে কী হয়েছে? ওরা বলল, তুই আগে খা। বললাম, আমি অবশ্যই খাবো না; আগে বল কী হয়েছে? ওরা বলল, বাবুই উড়ে গেছে। আমি হেসে বললাম, বাবুই! তাই তো, ওটাকে তো দেখছি না! ও অনেকসময় জানালার বাইরে যায়, আসবে; কয়েকবার সন্ধ্যায়ও চলে গেছে জানালার একটু বাইরে, আবার এসেছে। আমার হাসি দেখে ওরা মনে হলো, আশ্বস্ত। আমিও খেয়ে নিলাম। ওরা বলল, বাবুই আর আসবে না, অনেক খুঁজেছি। বললাম, এক দিন আমিও পাইনি, পড়ে দেখা গেল হাজির। ওরা কেঁদে ফেলল। নিয়ে এলো বাবুইটাকে ট্রেতে করে এক টুকরো সাদা কাপড়ে ঢাকা!

হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। পরদিন স্যারের সামনে আমি হাজির বিষয়টি বলার জন্য। বললাম, স্যার বাবুই মরে গেছে। স্যার বললেন, কিভাবে? সব কথা খুলে বললাম। স্যার স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তার মুখমণ্ডল লাল হয়ে গেল, চোখ ভরে গেল পানিতে। কী কষ্টের! স্যার ওকে Baya Baya বলে ডাকতেন যখন আমাদের কাজ দেখতে ল্যাবে আসতেন। ওরা জানিয়েছিল কাপড়ে মাড় দেয়ার জন্য গরম মাড় রেখেছিল বালতিতে। বাবুই পানি ভেবে ওই মাড়ে ঝাঁপ দিয়েছিল গোসল করার জন্য।

পরের বছর দুটো চোখবোজা পালকবিহীন দু’টি বাবুই বাচ্চা আমাকে ক্লাসমেটরা গিফট দেয়। আমাকে না জানিয়েই ওরা তা সংগ্রহ করেছে। নিরুপায় হয়ে অনেক শ্রম, সময় দিলাম তাদের পেছনে। তারা একটুকুও আমাকে পছন্দ করল না। ওরা ব্যস্ত থাকে। আমার ধার ধারে না। একটু বড় হতেই খুঁজতে থাকল ফাঁকফোকর, কখন উড়ে যাবে। পুরোপুরি উড়তে না শিখেও দু’জনই একসাথে উড়ে গেল একদিন।

লেখক : বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ

প্রফেসর প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us