আর্তুগ্রুল বনাম ফাউদা : দুই সিরিয়ালে তোলপাড়

আহমদ হাসান ইমরান | Jul 21, 2020 03:18 pm
আর্তুগ্রুল বনাম ফাউদা

আর্তুগ্রুল বনাম ফাউদা - ছবি : সংগৃহীত

 

ভারতে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি যখন বিপুল ভোটাধিক্যে বিজয়ী হলেন, তখন কয়েকটি বার্তা সামনে নিয়ে আসে। তা হলো, ভারত এখন সংখ্যাগুরুর কট্টর ডানপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এ থেকে আরেকটি বিষয়ও জন্ম নেয়। তা হলো, রাজনীতি এবং জনপ্রিয় গণমাধ্যমে মুসলিমদেরকে বর্জন করার একটি প্রক্রিয়া চালু হয়। এরপর ভারতের একমাত্র মুসলিম-প্রধান রাজ্য কাশ্মিরে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। আর এর পক্ষে যুক্তি দেয়া হয় যে, কাশ্মির একটি খুবই সংবেদনশীল এবং কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। আর নিরাপত্তার ঝুঁকির কারণেই কাশ্মিরে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এই সময় কাশ্মীর এবং ইসরাইল সম্পর্কে ভারতীয়দের আগ্রহ বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। মনে করা হতে থাকে যে, ইসরাইল হচ্ছে একটি আদর্শ রাষ্ট্র যা ‘ইসলামী টেরোরিজম’ বা সন্ত্রাসকে সাফল্যের সঙ্গে দমন করতে পেরেছে।

ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করে যে, এই পরিস্থিতিতে মুসলিম দুনিয়া ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়গুলোর উপর এক কোমল প্রভাব খাটাতে এগিয়ে আসে। মুসলিম দুনিয়ার কয়েকটি রাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধ, যা একদিকে তাদের আন্তর্জাতিক মর্যাদা এবং কৌশলগত অর্জনে সহায়তা করবে। আর এজন্য সর্বশেষ যে প্ল্যাটফর্মটি তারা খুঁজে নিয়েছে তা হল, টেলিভিশনের ছোট পর্দা। তাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের জন্য ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির লক্ষে টেলিভিশনের ছোট পর্দাকেই তারা ব্যবহার করছে।

এজন্য আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় দু’টি টিভি সিরিয়াল, যার একটি হচ্ছে তুরস্কে নির্মিত এবং অন্যটি ইসরাইলের। একটি হলো উসমানি বা অটোমান খিলাফতের অনুষঙ্গে নির্মিত ‘আর্তুগ্রুল’ এবং অন্যটি হচ্ছে ইসরাইলি সিরিয়াল ‘ফাউদা’।

ভারতের উগ্র ডানপন্থী নীতিকৌশল হচ্ছে, দেশের জাতীয়তাবাদী নিরাপত্তার ভাবনাকে জনমনে প্রতিষ্ঠিত করা যা পাকিস্তান ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যে উগ্র মনোভাব রয়েছে, তাকে আরো হাওয়া দেয়া। কিন্তু প্রয়োজন ছিল ভারতের নিরাপত্তামুখী ও বিবেচনা সম্পন্ন এক পরিকাঠামো গড়ে তোলা। আর সোশ্যাল মিডিয়া এই উগ্র আবহাওয়া ও প্রচারণাকে আরো উগ্র করে চলেছে। আর এতে সক্রিয় রয়েছে, কথিত জাতীয়তাবাদী মোদি সমর্থক, বুদ্ধিজীবী ও তরুণ প্রজন্ম। আর এই প্রেক্ষাপটেই তুরস্কের ‘আর্তুগ্রুল’ এবং ইসরাইলি ‘ফাউদা’ ভারতীয় উপমহাদেশে জনপ্রিয় হয়েছে। এই দুই টিভি সিরিয়াল মানুষকে মাতিয়ে চলেছে। বলিউডের মুভি ইন্ডাস্ট্রিতেও বেশ কিছু ‘স্পাই থ্রিলার’ এবং কঠোর জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক ফিকশন তৈরি করা হয়েছে। যা ভারতের ইতিহাসে এক সময় প্রান্তিক চরিত্র ছিল সেই পৌরাণিক কাহিনিগুলোকে অতিমানবিক ও প্রবল দেশপ্রেমী ছাঁচে ঢালাই করা হয়েছে। এর দ্বারা বেশ কিছু মিথও খাড়া করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বলিউডে তৈরি করা হয়েছে ‘উরি : দ্য সার্জিকাল স্ট্রাইক’, ‘বালাকোট এয়ার স্ট্রাইক’ জাতীয় চলচ্চিত্র। আর মোদির রাজত্বকালে নেতানিয়াহুর ইসরাইলের সঙ্গে ভারতের সখ্যতা তুঙ্গে উঠেছে। এই আবহেই টিভি সিরিয়াল ‘ফাউদা’ ও ‘আর্তুগ্রুল’ জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছে। আর উপমহাদেশে এর ফলে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিতর্কও দানা বেঁধেছে।

ইসরাইলি সিরিয়াল ‘ফাউদা’-তে দেখা যাচ্ছে, এক ইসরাইলি ছদ্মবেশী ইউনিট যারা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামী মুসলিমদের (ইসরাইলের ভাষায় ‘টেরোরিস্ট’) খুঁজে খুঁজে হত্যা করছে। এই থিমের উপর তৈরি সিরিয়ালটি ভারতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে, বিশেষ করে যারা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ ও বিজেপির অনুরাগী। ভারতে এখন বাম ও উদারপন্থীদের জনপ্রিয়তা উবে গেছে। বরং ভারতবর্ষে এক নতুন এলিট শ্রেণির জন্ম হয়েছে, যারা হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। ভারতের মুসলিম-বিরোধী বিজেপি নেতা সুব্রাহ্মণ্যম স্বামী যিনি হার্ভার্ড থেকে অর্থনীতির ডিগ্রি নিয়েছেন, তিনি ‘ফাউদা’ সিরিয়ালটি দেখেন। স্বামী ভারতীয়দের অনুরোধ করেছেন যে, তারা যেন সকলে মিলে ফিলিস্তিনি মুসলিম-বিদ্বেষী এই সিরিয়ালটি দেখেন।

ভারতীয়রা সাধারণত সাব-টাইটেলযুক্ত সিরিয়াল বা চলচ্চিত্র দেখতে পছন্দ করে না। কিন্তু ‘ফাউদা’ ও ‘আর্তুগ্রুল’-কে তারা সাদরে গ্রহণ করেছে। তবে পার্থক্যও রয়েছে খানিকটা। ‘ফাউদা’-র দর্শকদের মধ্যে বেশি রয়েছে ডানপন্থী হিন্দুরা। আর ‘আর্তুগ্রুল’-এর দশর্কদের মধ্যে সংখ্যাধিক্য হচ্ছে মুসলিমদের। ফাউদাতে যেভাবে অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের ইসরাইলিরা সফলভাবে হত্যা ও দমন করছেন, উগ্রপন্থী কিছু লোকের ফ্যান্টাসি হচ্ছে, কাশ্মিরে একই কায়দায় উগ্রবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করা হোক। তার মধ্যে হয়তো নিরীহ সাধারণ মানুষও পড়তে পারে। কারণ, একই রকম হচ্ছে ফিলিস্তিনে।

অন্যদিকে, ‘আর্তুগ্রুল’ কাশ্মিরি ও ভারতীয় মুসলিমদের তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার সব মুসলিম সম্প্রদায়ের মন জয় করে নিয়েছে। আর পাকিস্তানে তো উর্দু ডাবিংয়ের সঙ্গে এই সিরিয়ালটি সুপারহিট। ছেলে-মেয়ে-স্বামী-স্ত্রী-বাবা-দাদু-দিদিমা- সকলেই এই সিরিয়ালটিকে আপন করে নিয়েছেন। আর সিরিয়ালটির একের পর এক এপিসোড নেশার মতন দর্শকদের আকৃষ্ট করেছে। অনেকে বলছেন, ‘আর্তুগ্রুল’-এর প্রভাব খানিকটা ড্রাগ এডিকশনের মতো। একটি এপিসোড দেখলে তাকে ড্রাগ আসক্তির মতোই পরর্বতী এপিসোড দেখার জন্য অধীর করে তুলবেই। অবশ্য, আর্তুগ্রুল শুধু পাকিস্তান, ভারত ও কাশ্মিরে নয়, আরব দুনিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সুদান, নাইজেরিয়া এবং ইউরোপে বসবাসকারী মুসলিম, বলকানের বসনিয়া, কসোভো, রাশিয়ার আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, দাঘেস্তান এবং চেচনিয়াতেও সাধারণ মানুষের মন কেড়েছে।

‘আর্তুগ্রুল’ হচ্ছে ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইতিহাস-নির্ভর একটি নাটকীয় সিরিয়াল। এতে রয়েছে প্রেম, পারিবারিক ঘটনাপ্রবাহ, অ্যাডভেঞ্চার এবং আর্তুগ্রুলের ছোট-বড় নানা যুদ্ধের কাহিনি, যার ঐতিহাসিক প্রভাব অনস্বীকার্য। এই আর্তুগ্রুলই হচ্ছেন তুরস্কের প্রথম অটোমান সুলতান ওসমান জ্জ-এর বাবা। নেটফিক্স এবং ইউটিউবেও দেখা যাচ্ছে এর ডাবিং করা উর্দু ভার্সনটি। ‘আর্তুগ্রুল গাজি’ বলে ইউটিউবেও তা সম্প্রচার হচ্ছে। আর উপমহাদেশের বাইরে এই সিরিয়ালটি সম্প্রচার হচ্ছে ইংরেজি সাব-টাইটেলসহ। উর্দু ভার্সনটি ইতিমধ্যেই ২১০ মিলিয়ন মানুষ দেখেছেন। আর ৬১ মিলিয়ন দর্শক দেখেছেন ইউটিউব চ্যানেলে।

মুসলিমদের মধ্যে আর্তুগ্রুলের জনপ্রিয়তার কারণ হচ্ছে, এই ঐতিহাসিক সিরিয়ালে মুসলিমদের হিরো এবং বিজয়ী হিসেবে দেখানো হয়েছে। নইলে অনেক ক্ষেত্রেই রূপালি পর্দা বা টিভি সিরিয়ালে দেখা যায়, মুসলিমরা অশিক্ষিত, ক্রিমিনাল এবং দরিদ্র। তাদের সংস্কৃতি বলতে কিছু নেই। আর আর্তুগ্রুল গাজিতে যে চিত্র ফুটে উঠেছে তাতে মুসলিম সংস্কৃতি, পারিবারিক জীবন ফুটে উঠেছে। আর্তুগ্রুলে এমন অনেক শব্দ রয়েছে যা উর্দু বা বাংলাভাষী মুসলিমদের পরিচিত। যেমন, মাসুম (নির্দোষ), জুল্ম (অত্যাচার), লেকীন (কিন্তু), জান্নাত (স্বর্গ) ইত্যাদি। আর ৬০০-রও বেশি বছর এই উসমানিয়ারা একরকম পৃথিবী শাসন করেছেন। তাদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়ার একটা বিরাট অংশে। তাঁদের সেই বিজয় এবং জুলুমহীন শাসনের কথাও বিভিন্নভাবে ভারতের মুসলমানদেরও কানে পৌঁছেছে এবং উদ্বুদ্ধ করেছে।

গান্ধিজি, শওকত আলি এবং মুহাম্মদ আলিরা স্বাধীনতার সঙ্গে খিলাফত বাঁচাও আন্দোলনও করেছিলেন। ইংরেজ ও পাশ্চাত্য শক্তি যখন এই ১৯২০ সাল নাগাদ অটোমান বা ওসমানীয় খিলাফতকে উচ্ছেদ করতে চাইছিল, তখন ভারতীয় মুসলিমরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন করে এবং অর্থ প্রেরণ করে এই খিলাফতকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। যদিও পাশ্চাত্য দুনিয়া কামাল আতাতুর্কের মাধ্যমে খিলাফতকে উচ্ছেদ করে এবং তুরস্ককে ইসলাম মুক্ত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তুরস্ক পুনরায় এরদোগানের নেতৃত্বে জনজীবনে ইসলামি মূল্যবোধকে স্বীকৃতি দিয়েছে। মুসলমানরা দুনিয়া জুড়ে প্রশ্ন তুলেছে, যদি খ্রিস্টান দুনিয়ার জন্য পোপ থাকতে পারে, তাহলে কেন মুসলমানদের খলিফা থাকবেন না?

যাইহোক, ইতিহাস, সংস্কৃতি, মানবাধিকার- সবকিছু মিলিয়ে এখন ভারতেও চলছে এক নয়া লড়াই ‘আর্তুগ্রুল’ বনাম ‘ফাউদা’।

সূত্র : পূবের কলম


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us