লর্ড ক্লাইভ আর বাংলার করুণ ইতিহাস

সমৃদ্ধ দত্ত | Jul 26, 2020 07:25 am
লর্ড ক্লাইভ আর বাংলার করুণ ইতিহাস

লর্ড ক্লাইভ আর বাংলার করুণ ইতিহাস - ছবি : সংগৃহীত

 

রিচার্ড ক্লাইভ ছেলেকে পাঠালেন এক বন্ধুর কাছে। লন্ডনে। সেই বন্ধু একটি কোম্পানির অন্যতম ডিরেক্টর। বেশ প্রভাবশালী। চিঠি লিখে রিচার্ড বললেন, আমার ছেলেকে পাঠাচ্ছি। যদি সম্ভব হয় কোনো একটি কাজ দেওয়া যায় নাকি দেখ। রিচার্ড লন্ডন থেকে দূরে থাকেন। একটি গ্রামীণ জনপদ, শ্রপশায়ার। রিচার্ড ছেলেকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। চূড়ান্ত দুর্বিনীত, অসহিষ্ণু। দলবল জুটিয়ে স্থানীয় গ্রামের দোকানগুলিকে ব্ল্যাকমেল করে অর্থ আদায় করে। দ্রুত একটা কাজে ঢুকিয়ে দেয়া ভালো। রিচার্ডের ছেলের বয়স মাত্র ১৭। ১৭৪২ সালের ১৫ ডিসেম্বর সেই ছেলেটি লন্ডনে এসে সেই কোম্পানির দপ্তরে প্রথমবার ঢুকল একজন চাকরিপ্রার্থী হিসেবে। তাকে যে পদে নেয়া হলো, সেই পদের নাম ‘রাইটার।’ সবচেয়ে নিচুতলার কাজ বলা যায়। সামান্য বেতন। তবে যেতে হবে অন্য দেশে। কোম্পানির কাজকর্ম ওই দেশেই বেশি। কোন দেশে যেতে হবে? জানতে চাইল ছেলেটি। বলা হয় ইন্ডিয়া। সে বলল, আমি রাজি। কবে যেতে হবে? তিন মাস পর। রিচার্ড ক্লাইভের ১৭ বছরের সেই ছেলেটির নাম রবার্ট ক্লাইভ। আর যে কোম্পানির সবচেয়ে কম বেতনের ‘রাইটার’ পদে সে চাকরি পেল, সেই সংস্থার নাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১০ মার্চ ১৭৪৩। রবার্ট ক্লাইভ নামে ১৭ বছরের তরুণ ইন্ডিয়াগামী জাহাজে চেপে বসল।

মাদ্রাজে জাহাজ থেকে নেমে প্রথম দর্শনেই এই দেশটাকে সে অপছন্দ করল। কাজে যোগ দেয়ার পর ক্লাইভের ডিপ্রেশন এতটাই বেড়ে যায় যে, এক বছরের মধ্যে সে আত্মহত্যার চেষ্টা করে একদিন। রবার্টের একটি গুণ আচমকা প্রকাশ পেল। এতদিন তাকে কেউ সিরিয়াসলি নেয়নি। কিন্তু আচমকা ১৭৫১ সালে ফ্রেঞ্চ বাহিনীর বিরুদ্ধে অ্যাটাকে যাওয়া হবে বলে জনিয়ে রবার্ট সকলকে অবাক করে দিলো। একাই নেতৃত্ব দিলো প্রায় ৩০০ সিপাহির। আর যুদ্ধটা জিতেও গেল। আবার পরের বছর আরো বড় একটা জয়। রবার্টের কৃতিত্বে ফ্রেঞ্চ বাহিনী সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত ত্রিচিনোপল্লিতে। এই বিপুল সাফল্যের জন্য রবার্ট ক্লাইভকে কোম্পানি কমিশনারির কোয়ার্টার মাস্টারি পদে প্রোমোশন দিলো। যা সাংঘাতিক উচ্চপদই শুধু নয়, পুরস্কার ও ভাতা হিসেবে তার আয় হলো ৪০ হাজার পাউন্ড (আজকের দিকে ৪০ লক্ষ পাউন্ড)। মাত্র ১০ বছরের মধ্যে একটি সাফল্যময় জীবন। বয়স ২৭। অ্যাস্ট্রোনমাল রয়্যালের বোন মার্গারেট ম্যাসকেলিনকে বিয়ে করলেন ক্লাইভ। এবার ভারতকে বিদায় জানানোর পালা। বিপুল সম্পত্তি। সফল জীবন। আর কী চাই! ২৩ মার্চ ১৭৫৩। বম্বে ক্যাসল নামের একটি জাহাজে চেপে রবার্ট আর মার্গারিট ফিরে গেলেন লন্ডন।

কিন্তু নিয়তি অন্যরকম এক চিত্রনাট্য তৈরি করেছিল ক্লাইভের জন্য। ভারতবর্ষের জন্যও। ঠিক ১৮ মাস পর আবার তাকে ফিরতে হলো। কারণ, ফরাসিরা আবার মারাত্মক আগ্রাসী হয়ে উঠেছে সেখানে। কোম্পানির কাজকর্ম ধ্বংস হয়ে যাবে ফরাসিদের অত্যাচারে। অতএব ক্লাইভ ছাড়া আর কে যাবে? যে ছেলেটি সামান্য রাইটারের চাকরি নিয়ে ভারত গিয়েছিল ১৭৪৩ সালে, এবার তা কেই পাঠানো হচ্ছে মাদ্রাজের ডেপুটি গভর্নর হিসেবে। ১৭৫৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ক্লাইভ যখন ভারতে দ্বিতীয়বার এলেন, তখন মাদ্রাজ নয়, অন্য একটি শহর হয়ে উঠেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সবচেয়ে বড় বাণিজ্যকেন্দ্র। ২ লক্ষ জনসংখ্যার ওই শহরটির নাম কলকাতা। ইংল্যান্ডের ৬৫ শতাংশ টেক্সটাইল আমদানি হতো এই বেঙ্গল নামক প্রদেশ থেকে। বছরে যে শহর পেত ১ লক্ষ ৮০ হাজার পাউন্ড। আর্মেনিয়ানদের ন্যাজারাথ, ফোর্ট উইলিয়ম নামের কেল্লার উচ্চ মিনার, গভর্নর রজার্স ড্রেকের আবাস অট্টালিকা, হাসপাতাল, বিরাট এক জলের ট্যাঙ্ক। এ এক উজ্জ্বল শহর হয়ে ওঠার লক্ষণ দেখাচ্ছে। শান্তিপুর, কাটোয়া, গলাগোড়, হরিপাল, ক্ষীরপাই, মালদহ, সোনামুখী, ধনেখালি ইত্যাদি বিস্তীর্ণ জনপদে ছড়িয়ে থাকা রেশম আর সুতোর ব্যবসায় বছরে ১৩ লক্ষ টাকা টার্নওভার ছিল। গ্লাস, সিন্দুক, নারিকেল দড়ি, তামাকু, আতসবাজি, শাল ও সেগুন কাঠ, মেটেসিন্দুর, তুঁতে, পুরনো লোহা ইত্যাদির দোকান এবং কারখানা ছিল বৃহত্তর কলকাতা জুড়ে। প্রতি বৃহস্পতিবার এবং রোববার সুতানটি আর শোভাবাজারে বসত বিপুল এক আর্থিক লেনদেনের বাজার।

এহেন সম্পদশালী একটি রাজ্যের শাসক অবশ্য থাকতেন কলকাতা থেকে দূরে। মুর্শিদাবাদে। নাম আলিবর্দি খাঁ। বস্তুত যার আমলে শেষবার বাংলা দেখেছিল অর্থনৈতিক উন্নতির একটি উল্লেখযোগ্য রূপরেখা। মারাঠি শাসক রঘুজি ভোঁসলের লেঠেলবাহিনী ভাস্কর পণ্ডিতদের মতো নির্মম ডাকাত... সেই বর্গিদের চরম ১৭৪১ থেকে ১০ বছর ধরে অত্যাচারে বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাঙালি। মৃত্যু হয় ৪ লক্ষাধিক মানুষের। কতটা নিষ্ঠুরতা? গোটা গ্রাম ঘিরে টাকাপয়সা লুট করাতেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রাণভয়ে পালানো গ্রামবাসীদের তাড়া করে গলায় ঘোড়ার পা তুলে চাপ দিয়ে দিয়ে মেরে ফেলা। বাঙালির দুর্ভাগ্য তাড়া করে বেরিয়েছে বারংবার। চৌথ হিসেবে বর্গিদের অগাধ অর্থ প্রদান করে নিষ্কৃতি মিলেছিল। কিন্তু মারাঠা তথা বর্গিদের এই লুটতরাজ বস্তুত বাংলাকে পিছিয়ে দিয়েছিল। সেই অত্যাচার সত্ত্বেও বাংলা আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে ১৭৫২ সাল থেকে। সবেমাত্র আরো একবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু হয়েছিল আলিবর্দি খাঁয়ের শাসনসকালে। ১৭২০ সালের তুলনায় তার আমলে বাংলার রাজস্ব বেড়েছিল অন্তত ৪০ শতাংশ। কতটা শস্যসম্পদে পরিপূর্ণ ছিল বাংলা?

শুধুমাত্র একটি বাজারের কথা জানা যাক। কাশিমবাজারের নিকটবর্তী ওই বাজারেই বছরে ৭ লক্ষ টন ধানচালের ক্রয়বিক্রয় হতো। চিনি, বস্ত্র, আফিম, তুঁতে বিদেশে রফতানির প্রধান কেন্দ্রই ছিল বাংলা। তন্তুবায় এবং মসলিন নির্মাতা অন্তত লক্ষাধিক ছিল বাংলাজুড়ে। যা ব্রিটেন থেকে পশ্চিম এশিয়া... সর্বত্র বিক্রি হতো। এহেন এক সম্পদশালী বাংলার সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল ছিলেন আলিবর্দি খাঁ।

* * *
১৭৫৬ সালের মার্চ মাসে আলিবর্দি খাঁয়ের হঠাৎ একটা স্ট্রোক হলো। প্রথম সাত দিন তিনি গোটা শরীর নাড়াতে পারছিলেন না। সম্পূর্ণ পঙ্গু। ইশারায় কথা বলতে পারলেই যেন ভালো হয়। একটানা চিকিৎসার পরও সম্পূর্ণ সুস্থ হলেন না নবাব। কিছুটা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েই রইলেন। ঠিক সেরকমই সময় তিনি দু’টি খবর পেলেন। প্রথমত, কর্ণাট প্রদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কীভাবে মোগল নবাবদের সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বস্তুত হাতের পুতুল করে ফেলেছে। আর দ্বিতীয় সংবাদ হলো, কোম্পানি কলকাতায় কিছু কিছু এলাকায় হঠাৎ নতুন বিল্ডিং তৈরি করছে, কেল্লা মেরামত করছে এবং প্রাচীর নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছে। হঠাৎ কলকাতায় প্রাচীর কেন? এরা তো ব্যবসা করবে? এদের এই অধিকার তো দেয়া হয়নি!

আলিবর্দি খাঁ তাঁর এক কর্মচারী নারায়ণ সিংকে বললেন, গিয়ে গভর্নরকে বল এসব আমরা সহ্য করব না। সব কাজ বন্ধ করতে হবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর রজার ড্রেককে সেই বার্তা দিতে গেলেন নারায়ণ সিং। আর তিনি ফিরে আসার আগেই ৯ এপ্রিল ১৭৫৬ আলিবর্দি খাঁয়ের জীবনাবসান হলো। বিকেলে দাদুর মৃত্যু হয়েছে। সেই রাতেই সিরাজউদ্দৌল্লাহ মাসি ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ আক্রমণ করে সর্বস্ব লুটপাট করলেন। আর পরের মাসে বিপুল সেনাবাহিনী নিয়ে চললেন পূর্ণিয়া। সেখানে তার এক সম্পর্কিত ভাই থাকে। তাকে পরাস্ত ও হত্যা করতে। কারণ সিরাজের লক্ষ্য, সিংহাসন যেন কণ্টকহীন হয়। পুর্ণিয়া যাওয়ার পথেই আচমকা সেই নারায়ন সিং ফিরে এলো প্রায় কাঁদতে কাঁদতে। তার অভিযোগ, কোম্পানির গভর্নর রজার্স ড্রেক যাচ্ছেতাই অপমান করেছে তাকে। এমনকী আটকে রেখে দিয়েছিল এতদিন। শুনে সিরাজ এক মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলেন, গোরাদের শিক্ষা দেয়া দরকার। তিনি গোটা সেনাবাহিনীর মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। কাশিমবাজারে কোম্পানির ফ্যাক্টরি আক্রমণ করলেন। এবং সেখানে ঢুকে কোম্পানির সেপাইদের কচুকাটা করে সোজা কারখানা, ট্রেজারি, অফিস দখল করে নিলেন। কাশিমবাজার ফ্যাক্টরির দায়িত্বে থাকা উইলিয়ম ওয়াটস হাতজোড় করে নবাবের পায়ের কাছে বসে বলেছিলেন, আমি আপনার গোলাম। আমরা আপনার গোলাম। সেই শুরু হলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে নবাব সিরাজের প্রত্যক্ষ বিরোধ। কোম্পানির কাশিমবাজার কারখানার এই পরাজয় এবং আত্মসমর্পণ দেখে তখন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে কাঁপছিলেন এক কর্মী। মাত্র ২৪ বছর বয়স যুবকের। তার নাম ছিল ওয়ারেন হেস্টিংস!

এরপর সিরাজউদ্দৌল্লার কলকাতা আক্রমণ, কলকাতাকে রক্ষা করতে মাদ্রাজ থেকে রবার্ট ক্লাইভের আগমন, ফলতায় এসে ঘুঁটি সাজিয়ে পুনরায় কলকাতা ফোর্ট দখল করা এবং নবাবের বিরুদ্ধে একঝাঁক বিশ্বাসঘাতককে নিয়ে চক্রান্তকাহিনী, পলাশীর যুদ্ধ, সিরাজের মৃত্যু, মিরজাফর হয়ে মিরকাশিমের হাতে রাজ্যপাট আসা... এসব কাহিনী বহুচর্চিত। সেই বিস্তারিত বিবরণ এই প্রতিবেদনের প্রতিপাদ্য নয়। শুধু মনে রাখা দরকার যে, ১৭৫৪ সালে গোটা মোগল সাম্রাজ্য এবং ব্রিটিশ কোম্পানির কাছে সবচেয়ে স্বর্ণোজ্জ্বল, সম্পদশালী রাজ্য বেঙ্গল মাত্র ১৪ বছরের মধ্যে ১৭৬৮ সালে হঠাৎ কীভাবে এক ইতিহাসের অন্ধকারে প্রবেশ করল। সেই অন্ধকারের জন্য শুধু‌ই খরা, অনাবৃষ্টি দায়ী নয়। তার থেকেও বেশি দায়ী অপরিসীম কোষাগার লুণ্ঠন। ১৭৫৭ সালে সিরাজের ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ গোটা শহরে ঘোরানোর পর ৭ জুলাই এই যুদ্ধে কোম্পানির সহায়তার পেমেন্ট হিসেবে ক্লাইভ একাই পেয়েছিলেন ২ লক্ষ ৩৪ হাজার পাউন্ড। প্রথম ইনস্টলমেন্ট হিসেবে ৭৫ লক্ষ। কয়েক কোম্পানি সেনা এবং ২০০ নবাবী বজরা নিয়ে কাটোয়া, চন্দননগর হয়ে কলকাতায় ফিরেছিলেন ক্লাইভের অ্যাসিস্ট্যান্ট লুক স্ক্র্যাফটন। ১০০টি নৌকায় ছিল ৭৫০টি সিন্দুক। শুধুই বাংলার টাকা। এছাড়া পলাশীর যুদ্ধের পর নতুন নবাব মিরজাফর কোম্পানিকে দিয়েছিলেন ১২ লক্ষ ৩৮ হাজার পাউন্ড। যার মধ্যে একা ক্লাইভের তহবিলে গিয়েছিল ১ লক্ষ ৭০ হাজার পাউন্ড। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ পর্যন্ত মুর্শিদাবাদের নবাবের কোষাগার থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে গিয়েছিল প্রায় ২২ লক্ষ পাউন্ড। আজকের দিনে হিসেব করলে কত? ক্লাইভ দফায় দফায় ইংল্যান্ড ফিরেছেন আবার এসেছেন। শুধু ক্লাইভ? কলকাতার তাবৎ বাবু, মহতাব রাই নামের জগৎশেঠ, এমনকী কলকাতার বিখ্যাত বাবুদের পালিত গণিকারা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল হাজার হাজার টাকা। বস্তুত বাংলার জেলে, চাষি, তন্তুবায়, রাজমিস্ত্রী, কর্মকার, স্বর্ণকারদের ঘামঝরানো আয়ের টাকা লুটতরাজ হয়ে গিয়েছে বছরের পর বছর। তারপর এলো অন্ধকারের কালো মেঘ।

* * *

মুর্শিদাবাদের প্রশাসক মুহম্মদ রেজা খান কলকাতায় চিঠি লিখলেন। নভেম্বর, ১৭৬৮। বললেন, ধানের চাষ মার খেয়েছে জুন মাসে। এখনো তুলো, তুঁতে, চাষ কিছুই সম্ভব হয়নি। লাগাতার অনাবৃষ্টি। এই সময় কোম্পানির খাজনা আর কর আদায় মওকুব করা দরকার। কারণ শুরু হয়েছে এক মারাত্মক দুর্ভিক্ষ। প্রতিদিন গড়ে তখনই ৬ হাজার করে মানুষ মারা যাচ্ছে অনাহারে। মুহম্মদ রেজা খানের এই আবেদনে কর্ণপাত করেনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বরং তারা জানায়, কোনোভাবে রেভিনিউ কম করা যাবে না। যথাযোগ্য খাজনা আদায় করা আমাদের ডিউটি। রেজা খান ডিসেম্বর মাসে আবার চিঠি লিখলেন হেনরি ভার্লেস্টকে। মানুষ প্রতিদিন হাজার হাজার সংখ্যায় মারা যাচ্ছে। সম্ভব হলে কলকাতা, হুগলির শস্যভাণ্ডার থেকে নৌকায় চাল পাঠানো হোক। আমরা নৌকা পাঠাচ্ছি। কোম্পানি এসব বাজে কথায় কান দেয়নি। নামানো হয় ১০ হাজার বাহিনীর সেনা। তাদের কাজ হলো, গ্রামে গ্রামে গিয়ে খাজনা ও কর আদায়। অস্বীকার করলে ফাঁসিকাঠে ঝোলানো। এরকমই সময়ে কলকাতার গভর্নর কখনো হুগলি, কখনো ফলতা, কখনো উলুবেড়িয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন ৩টি বজরা আর ৩১টি নৌকা নিয়ে। ২৩০ জন কর্মচারী। ৬৫০ মণ চাল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গুদামে মজুত ছিল সেই সময়। কলকাতায় চালের দর কোম্পানি নির্ধারিত করে দেয় ১ টাকায় এক মণ। তার বেশি যদি চালের দাম ব্যবসায়ীরা বিক্রি করে, তাহলে কোম্পানির কর্মচারীরা সেই চাল আটক করতে পারে। একদিকে এই নিয়ন্ত্রণ চালু করলেও বোম্বাই আর মাদ্রাজে তিনটি জাহাজ মাঝেমধ্যেই যাতায়াত করতে দেখা যায়। অবশেষে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে সেটা আটকানো হয়েছিল।

মুর্শিদাবাদ থেকে শুরু হওয়া সেই দুর্ভিক্ষ ক্রমেই ছড়িয়ে গেল গোটা বাংলায়। লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল রাজমহল আর মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদাবাদে দেখা যায়, বহু মানুষকে গঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে মাঝনদীতে যাওয়া নৌকা ও বজরাকে হাত দেখিয়ে দেখিয়ে নিজেদের ছেলেমেয়েকে উঁচু করে তুলে ধরছে। ছেলেময়েকে বিক্রি করতে চায় তারা। লাইন দিয়ে। ঘাস, গাছের পাতা আর কাঁচা মাছ খেতে হচ্ছে গ্রামে গ্রামে। শুরু হলো কলেরা। কলকাতায় এসে পৌঁছয়নি দুর্ভিক্ষ? অবশ্যই। ১৭৭০ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর—তিন মাসে শুধু কলকাতায় ৭৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হলো অনাহারে। চালের দাম ৮ টাকায় পৌঁছেছে। কিন্তু চালই নেই। চরম মজুতদারি শুরু হয়ে গেল। কলকাতার গঙ্গায় দেখা যাচ্ছিল কালো কাঠের মতো অসংখ্য জড়পদার্থ ভেসে যাচ্ছে। লাইন দিয়ে। সেগুলো ছিল লাশ।

১৭৭০ সালের জুলাই মাসে এর সঙ্গেই শুরু হলো স্মল পক্স। মানুষ কীটপতঙ্গের মতো মারা যাচ্ছে। পাটনার শাসক সিতাব রাই বরং অনেকটা সামলে নিলেন। তিনি যখনই আঁচ করলেন যে দুর্ভিক্ষ আসছে, বেনারসে পাঠিয়ে দিলেন একঝাঁক নৌকা। বেনারসের দরেই চাল আমদানি করতে। একসঙ্গে তিনি কিনে নিয়েছিলেন ৩০ হাজার টাকার চাল। ততদিনে নতুন গভর্নর এসেছেন। জন কার্তিয়ের। তিনি এসেই কিন্তু অনেকটা বুঝতে সমর্থ হলেন যে, এই মহাদুর্ভিক্ষ সামাল দিতে না পারলে কোম্পানির ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। আগামী বহু বছর ধরে রাজস্ব আদায় হবে না। শিল্পবাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি চেষ্টা করলেন দিনে ১৫ হাজার মানুষের খাবারের। কিন্তু ওই মহাবিপর্যয়ে ১৫ হাজার মানুষের খাবার যেন কি‌ছু‌ই নয়। বরং তিনি সামাল নিতে পারলেন না তার নিজের সংস্থা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী আর ব্যবসায়ীদের মিলিত দুর্নীতি। কেমন দুর্নীতি? টাকায় ১২০ সের চাল কিনে নিয়ে তারা স্থানীয় ব্যবসায়ীকে বিক্রি করেছিলেন এক টাকায় ১৫ সের। ফলে দ্রুত বাজার থেকে চাল উধাও হয়ে শুধু কতিপয় ব্যবসায়ীর গুদামেই পাওয়া যাচ্ছিল। ১৭৬৯ সালে এরকম এক কর্মচারী ইংল্যান্ডে নিজের বাড়িতে ১ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন। এক বছর পর সেই কর্মচারীই শুধু চালের দুর্নীতি করে পাঠিয়েছিলেন ৬০ হাজার টাকা। যে মন্বন্তরে লক্ষ লক্ষ বঙ্গবাসী মারা গেল, সেই মন্বন্তরের সময়ই কোম্পানির পক্ষ থেকে তাদের লন্ডন হেডকোয়ার্টারে পাঠানো হয়েছিল ১০ লক্ষ ৮৬ হাজার পাউন্ড।

চরম অনাহার আর এই আকালে খাজনা আদায় বন্ধ রাখাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আদতে ১৭৭১ সালে জানা গেল, ১৭৭০ সালে বেঙ্গল থেকে ট্যাক্স বেড়েছে ১০ শতাংশ। চার বছর চাষবাস হলো না। গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস... জনবিরল। বহু জনপদ ও চাষের জমি ধীরে ধীরে জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল। কমে এসেছিল শহর আর জনপদের আয়তন। বাংলার যে জনপদে একটা সময় মানুষের কাজকর্মের শব্দ, কলতান, যাতায়াতের ভিড়ে পূর্ণ ছিল, সেসব স্থানে ক্রমেই বাঘ, শেয়াল এসে থাকতে শুরু করল। সেগুলো হয়ে গেল ঘোর অরণ্য। সম্পদশালী বাংলার শান্ত এক জনজীবন সম্পূর্ণ ধ্বংস। অন্তত তিন বছর ধরে চলল সেই মন্বন্তর। ১ কোটি? ৫০ লক্ষ? নাকি ২০ লক্ষ? ইতিহাসে গত ২৫০ বছর ধরে নানা চর্চা হয়েছে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে।

সূত্র : বর্তমান

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us