সিল্ক রুট ও মোঙ্গল বাহিনীর রহস্যময় কাহিনী

ওমর খালেদ রুমি | Aug 15, 2020 07:17 pm
সিল্ক রুট ও মোঙ্গল বাহিনীর রহস্যময় কাহিনী

সিল্ক রুট ও মোঙ্গল বাহিনীর রহস্যময় কাহিনী - ছবি : সংগৃহীত

 

অতীতের দিকে তাকালে পৃথিবী আজ শুধু মোঙ্গলদের নৃশংসতার কথাই জানে। কিন্তু তারা কি শুধু নৃশংসতাই জানত? একটা জাতি, যারা পুরো পৃথিবী পায়ের তলায় মাড়িয়ে দিয়েছিল প্রায় দেড় শ’ বছর ধরে, তাদের কি আর কোনো মাহাত্ম্যই ছিল না। চেঙ্গিস খানের ব্যক্তিজীবন, এর রূঢ় বাস্তবতা এসব কি একেবারেই মূল্যহীন। বাদ দিলাম এসব কথা। সমসাময়িক পৃথিবীতে অন্যরাইবা তখন কী করছিল? পুরো পৃথিবী কেনইবা তাদের প্রতিহত করতে পারল না। এ ব্যর্থতা তবে কার?

শুধু মোঙ্গলদের দোষ দিলেই কি চলবে? মোঙ্গলরা যুদ্ধবিদ্যায়ই শ্রেষ্ঠ ছিল না। তাদের দখল ছিল কবিতায়ও। তরবারির আড়ালে তাদেরও আবেগ ছিল। তারা প্রতিবাদীও ছিল। সে কথায় পরে আসব।
মোঙ্গলদের আবেগের কথা বলছিলাম। কবিতায় তাদের দখল ছিল। তারা কথা বলত কাব্যের ভাষায়।

মোঙ্গল বীরপুরুষদের মেধা আর মননশীলতাও ছিল। তারা অনেক অনেক দূর থেকে রমণীর শরীর থেকে বাতাসে ভেসে আসা সুগন্ধকে বুনো ফুলের সুগন্ধ থেকে আলাদা করতে পারত। তাদের দৃষ্টি যেমন বহুদূর যেত তেমনি তাদের অন্তর্দৃষ্টিও যেত বহুদূর। আর যেত বলেই চেঙ্গিস যখন জিন এবং কারা খিতাইদের দখল করার মাধ্যমে এক বিরাট সাম্রাজ্য বানালেন তখনো তিনি অহঙ্কারী হলেন না। তিনি দেখলেন তাকে বাণিজ্যে টিকে থাকতে হলে সিল্ক রুটের সাহায্য প্রয়োজন। আর এই সিল্ক রুটের কর্তৃত্ব মূলত খাওয়ারিজমান শাহদের হাতে। তিনি তরবারি না চালিয়ে মাথা ব্যবহার করলেন। শাহকে এক চমৎকার পত্রে তিনি লিখলেন,

“I am Khan of the lands of the rising sun while you are sultan of those of the setting sun: Let us conclude a firm agreement.”

কিন্তু শাহের মাথা গরম। মাথা গরম তার অধীনস্থদেরও। তারা চেঙ্গিসের দূতদের অবমূল্যায়ন করলেন। করলেন হত্যাও। এত বড় ভুল পৃথিবী এর আগে কখনো দেখেছে কি না আমার ছোট জ্ঞানে তা জানা নেই। বললাম এ জন্য যে, এ ঘটনাই পরবর্তীতে পৃথিবী এবং তার ইতিহাস দুটোই বদলে দিয়েছিল। চেঙ্গিস ছিলেন এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। সেই সুপ্ত আগ্নেয়গিরির নিদ্রা থেকে তিনি জেগে ওঠে লাভা উদ্গীরণ করতে শুরু করলেন। আগুনের সেই গলিত লাভার নিচে চাপা পড়ে গেল কত শত জনপদ তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আসলে ইতিহাস কতটা লিপিবদ্ধ করতে পারে। মৃত্যুর বিভীষিকাময় মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কারোরই আর ইতিহাস লেখার সুযোগ থাকে না। তখনো তাই ঘটেছিল। যা কিছু লেখা হয়েছিল তার হয়তো অনেক কিছুই ছিল কম বা বেশি। কিন্তু এ কথা তো সত্য তেরশ’ শতক পেরিয়ে যখন চৌদ্দশ’ শতক এলো প্রায় ১০০ বছর পরে যেখানে জনসংখ্যা অনেক গুণ বেড়ে যাওয়ার কথা সেখানে মোঙ্গলদের জনসংখ্যা ১২০ মিলিয়ন থেকে ৬০ মিলিয়ন হয়ে গিয়েছিল। বেশির ভাগই মরেছিল যুদ্ধে। তা হলে বাকিরা কি পরিমাণে মরেছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না, যেখানে কখনো তখনো একজন মোঙ্গলকে কোনো এক যুদ্ধে পাঁচশ জনকেও হত্যা করতে হয়েছে। হায়রে পৃথিবী। সাধে কি আর চেঙ্গিস খান বলেছিলেন, সমরের সাধ ছিলা, সে সাধ মিটাব।’

যে প্রসঙ্গে ছিলাম। সিল্ক রুটের মাধ্যমে বাণিজ্য। ১২২১ সালে খাওয়ারিজম শাহকে বিতাড়িত করে চেঙ্গিস সিল্ক রুটের দখল ঠিকই পেয়েছিলেন। পৃথিবীর ভাগ্য ভালো না মন্দ জানি না, তবে ১২২৭ সালে চেঙ্গিস খানের মৃত্যু হওয়ায় সে যাত্রা হয়তো পৃথিবীর অন্যান্য জনপদের বাসিন্দারা প্রাথমিক ধাক্কাটা কিছুটা হলেও সামলাতে সক্ষম হয়েছিল। এর পরও চলেছে হত্যাযজ্ঞ। ১২৫৮ সালে চেঙ্গিসের নাতি তল্ইুয়ের পুত্র হালাকু খানের বাগদাদ ধ্বংসের সময়ের নৃশংতার কথা কে না জানে? এখানেও মোঙ্গলদের নৃশংসতার পাশাপাশি তাদের সূক্ষ্ম জ্ঞানেরও পরিচয় পাওয়া যায়।

বাগদাদ দখলের পরও খলিফা মোস্তাসিমকে তারা জীবিত রেখেছিল। মোঙ্গলরা জানত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আব্বাসীয়দের জড়ো করা ধন সম্পত্তি কোথায় লুক্কায়িত আছে তার খবর রয়েছে একমাত্র খলিফার কাছে।

তারা এই ধনভাণ্ডারের জন্য তাকে চাপ দিতে লাগল। খলিফা সহজে মুখ না খোলায় তাকে ক্ষুধার্ত রাখার বন্দোবস্ত করল। ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে খলিফা রাজি হলেন বলতে। তাকে বলা হলো খবর জানিয়ে দিলে আহারের বন্দোবস্ত করা হবে। নির্বোধ খলিফা যখন তথ্য জানিয়ে দিলেন তখন মোঙ্গলরা ওই সব ধনসম্পদ বের করে আনলেন। খলিফার ক্ষুধার্ত মুখে সোনা-দানা, হিরা-জহরত গুঁজে দিয়ে বললেন, এখন এগুলোই গিলে খাও। যে সম্পদ জড়ো করেছ তা আজ ভক্ষণ করো। যদি এসব জড়ো না করে শক্তিশালী সেনাবাহিনী বানাতে তা হলে আজ এভাবে অপমানজনকভাবে মৃত্যুবরণ করতে হতো না।

কিন্তু এ থেকেও কি মুসলমানরা কোনো শিক্ষা নিয়েছিল? না নেয়নি। যদি নিত সেই থেকে শুরু করে আজকের পৃথিবী অন্য রকম হতো। বরং তারা লিপ্ত ছিল পরস্পর ভ্রাতৃঘাতী লড়াই, ভোগবিলাস আর জঘন্য সব উল্লেখ করার অযোগ্য অপকর্মে। বিধর্মীদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে তারা পা দিয়েছিল বারবার। ইতিহাস আজ অনেক কিছুরই সাক্ষী। কিন্তু কথা একটাই ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।’ মানুষ পরিচালিত হয় তার গোপন তাড়না দ্বারা। সেখানে তার অন্তর পরিপূর্ণ থাকে হিংসা-ঘৃণা-বিদ্বেষ আর বিষে। রেমন্ড দ্য চ্যাটেলিয়ন তাই তার অন্তরের এই বিষকে এ কথা বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন যে ‘বিদ্বেষ হচ্ছে পবিত্র যুদ্ধের মূল্য যা সবাইকে পরিশোধ করতে হয়।’ হায়রে পৃথিবী!

মনে পড়ে স্পেনে মুসলমানদের শাসনকালের কথা। সেখানে কী ঘটেছিল আজো পুরো পৃথিবী তা জানে। এ কথা ভোলার নয়। পৃথিবীতে কিছু দগদগে ক্ষত থাকে যা অত সহজে ভোলা যায় না। সেখানকার মুসলিম শাসকদের কেউ কেউ এতটা নিচে নেমেছিলেন যে, তাদের বিরুদ্ধে এমন কিছুর অভিযোগ উঠেছিল, যা মানুষের দ্বারা সংরক্ষিত হওয়া আদৌ সমীচীন কি না। অতঃপর তারা ধ্বংস হলো। শুধু যে এটাই কারণ, তা নয়। তারা পিতার বিরুদ্ধে পুত্র অস্ত্র ধরেছিল। আর তাতে ছিল শত্রুর প্ররোচনা।

এভাবে স্পেনে মুসলমানদের আবেগের শেষ আশ্রয়স্থল গ্রানাডাও ধ্বংস হয়ে যায়। আজো সেখানকার বাতাসে কান পাতলে বাতাসে দোল খাওয়া জলপাই গাছের পাতার ঝিরঝির আওয়াজের সাথে লাখ লাখ নির্যাতিত আর মৃত নারী আর শিশুর কান্না ভেসে আসে। যারা বেঁচে ছিল তাদেরও ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল। আল আন্দালুসের মুসলমানরা আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্তত সাম্রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে এই একটা কথা তিক্ত সত্য যে, একবার যে সাম্রাজ্য নুয়ে পড়েছে তাকে আর টেনে তোলা সম্ভব হয়নি।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us