রফির একটি গান ও শত মত-শত পথ

সারওয়ার মো. সাইফুল্লাহ্ খালেদ | Aug 26, 2020 05:30 pm
রফি

রফি - ছবি : সংগ্রহ

 

ভারতবর্ষের তদানীন্তন বোম্বাই ও বর্তমানের মুম্বাইয়ের বিখ্যাত ও প্রভাবশালী গায়ক মোহাম্মদ রফি (২৪ ডিসেম্বর ১৯২৪-৩১ জুলাই ১৯৮০)। ভারত ও বিভিন্ন দেশের ভাষাসহ হিন্দি ও বাংলায় অসংখ্য কালজয়ী গান গেয়েছেন তিনি। তার সমকক্ষ গায়ক শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের সঙ্গীতাঙ্গনে বিরল। তার গাওয়া একটি বাংলা গান নিম্নরূপ: ‘নাহ্ নাহ্ নাহ্/পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না/ওকে গাইতে দাও/ ওর কণ্ঠ থেকে গান কেড়ো না/ নাহ্ নাহ্ নাহ্/পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না/ওকে গাইতে দাও/ওর কণ্ঠ থেকে গান কেড়ো না/ নাহ্ নাহ্ নাহ্/। দেখ ভেবে, পাখিটা মরে গেলে ফাগুন বিদায় নেবে/দেখ ভেবে, পাখিটা মরে গেলে ফাগুন বিদায় নেবে/ওর গানই যে ফুল ফোটার প্রেরণা/পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না/ ওকে গাইতে দাও/ ওর কণ্ঠ থেকে গান কেড়ো না/নাহ্ নাহ্ নাহ/। চাও নাকি পাখিটা সারা দিন গান গেয়ে ঘরে ফিরে যাক/ভেঙ্গো না ওর সোনার সংসার/ কত সুখী ওর ঐ গান শুনে ফোটে যে সূর্যমুখী/ যদি আনন্দ পেতে চাও ওকে তুমি ছেড়ো না/পাখিটার বুকে যেন তুমি তীর মেরো না/ ওকে গাইতে দাও/ ওর কণ্ঠ থেকে গান কেড়ো না/ নাহ্ নাহ্ নাহ্’।

অমর গানটি বেশ পুরনো হলেও চিরনতুন এবং মোহাম্মদ রফিও আজ আর বেঁচে নেই। রূপকার্থে গানটির বহুমুখী ব্যবহার করা যায়। তবে আমি সাহিত্য, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা এবং এ জাতীয় বুদ্ধিজীবীদের বাকস্বাধীনতা প্রসঙ্গে রফির পাখিটিকে রূপকার্থে ব্যবহার করে এ গানটির তাৎপর্র্য ব্যাখ্যা করতে চাই।

মোহাম্মদ রফি ভারতীয়দের কাছে ‘রফি সাব’ নামে খ্যাত। ছোট বড় নির্বিশেষে ভারতীয়রা শ্রদ্ধাভরে এই নামেই তাকে সম্বোধন করে থাকেন। রফি সাব এ গানটি কোন উদ্দেশ্য নিয়ে গেয়েছিলেন, জানি না। রফি সাব কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে জড়িত ছিলেন বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। রফি দুইবার বিয়ে করেছেন। তার প্রথম স্ত্রী তার সম্পর্কিত ভগ্নি (cousin) বাশিরা বিবির সাথে ছাড়াছাড়ি হয় এ কারণে যে, তিনি ভারত বিভাগের সময় তার পিতা মাতা হারালে তিনি ভারতে থাকতে অনীহা প্রকাশ করে লাহোর চলে যান। রফি সাব ভারতেই রয়ে গেলেন। তার দ্বিতীয় স্ত্রী বিলকিস বানু। রফি সাবের পুত্র শাহিদ কৃত Mohammad Rafi : Voice of a nation অনুসারে রফি সাব আজীবন খোদাভীরু একজন অমায়িক লোক ছিলেন। যে-ই তার কাছে আসতেন তিনি খালি হাতে তাদের ফিরিয়ে দিতেন না। দান খয়রাতের ব্যাপারে তিনি মুক্তহস্ত এবং পারিবারিক জীবনে অনুরক্ত ছিলেন। আগেই বলেছি, রাজনীতির ব্যাপারে তিনি উৎসাহী ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। তার উপর্যুক্ত ‘গানের পাখিটি’ দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রচিন্তক, সংস্কৃতিসেবক ও বুদ্ধিজীবীদের রূপকার্থে ব্যবহার করব এবং যাকে উদ্দেশ করে বলছেন ‘পাখিটির বুকে তীর মেরো না’ তাদের রাষ্ট্র পরিচালকদের রূপকার্থে ব্যবহার করব।

যেকোনো দেশে প্রায়ই দেখা যায় লেখক, শিল্পীসহ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের ওপর সরকারি কিছু সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়। এ ছাড়াও ‘সেল্ফ সেন্সরশিপ’ বলে তো একটা কথা আছেই। পাখি যেমন মুক্তকণ্ঠে গান গেয়ে বর্ণিল বসন্তকে বিকশিত করে তোলে ঠিক তেমনি গণতন্ত্রের স্বার্থে মুক্তকণ্ঠে কেউ কিছু বলতে বা লিখতে পারেন না। আমি আমার এক বন্ধু, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. আবদুল কাদির ভুঁইয়াকে (অল্প ক’দিন আগে তিনি মারা গেছেন) জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘তুমি লিখ না কেন?’ তিনি আমার লেখা নিয়মিত পড়তেন। তিনি অতি শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলেন ‘আমি যা লিখতে চাই তা লিখতে পারব না’। সাপ্তাহিক ‘সাম্প্রতিক দেশকাল’ ট্যাবলয়েড পত্রিকার সম্পাদক ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ আমার কিছু লেখা এডিট করতে যেয়ে কিছু কিছু কাটছাঁট করেছেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘এমনটা হলো কেন’। তিনি বললেন, ‘দশটা কথা লিখতে গিয়ে যদি দুটো কথা বাদ দিতে হয় তবু আটটা কথা তো বলা হলো।’ কথাটা সত্য এ কারণে যে, কিছুই যেখানে বলা যায় না সেখানে যতটা বলা যায় তাই বা মন্দ কী। অন্যান্য পত্রিকায় লিখেও আমার একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। বেশ কিছু দিন থেকে দৈনিক নয়া দিগন্তে লিখছি। আমার তিন তিনটি লেখা তারা ছাপেননি। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলা হলো, ‘বোল্ড হয়ে গেছে’। আমি বুঝলাম। প্রত্যেক সংবাদপত্রেরই এডিটরিয়াল পলিসি থাকে। এর বাইরে তারা এগোন না। আমিও চাপাচাপি করি না।

এটা কেবল সাম্প্রতিককালের ঘটনা নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকেই এ জাতীয় ঘটনা ঘটছে। পাকিস্তান আমলেও তাই ছিল। দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ পত্রিকার অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। পশ্চিমা দেশগুলোতেও কমবেশি এটাই হয়। প্রো এস্টাবলিশমেন্ট ও অ্যান্টি এস্টাবলিশম্যান্ট বলে দুটো কথা চালু আছে। অ্যান্টি এস্টাবলিশম্যান্ট পত্রিকাগুলোকে সাবধানে চলতে হয়- ‘দশটির বেলায় আটটি’, প্রো এস্টাবলিশমেন্ট পত্রিকাগুলোতে দশটির বেলায় বিশটি লিখলেও আপত্তি নেই। মোট কথা, যেখানে বাক-স্বাধীনতা নেই সেখানে ‘দেখ ভেবে পাখিটা মরে গেলে ফাগুন বিদায় নেবে’; অর্থাৎ সেখানে নতুন নতুন ভাবধারার বিকাশ ও সম্প্রচার ঘটে না বলে বসন্ত উৎসবের মতো বর্ণিল বিকাশের স্ফুরণও ঘটে না। পত্রিকাগুলো কেমন যেন একঘেঁয়ে নিরামিষ লাগে। দুনিয়াব্যাপীই এটা চলছে। বিভিন্ন দেশে সাংবাদিক, সাহিত্যিক নির্যাতিত হচ্ছেন। খাশোগির মতো সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব নিহত হচ্ছেন।

শিক্ষাঙ্গনেও তাই। মনে আছে, পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মাহমুদ হাসানের ওপর ‘একটি সরকারপক্ষীয় ছাত্রফ্রন্ট’ খোলার চাপ পড়লে তিনি সাথে সাথে ‘I cannot do the job of a police’ বলে পদত্যাগ করেন। প্রফেসর ড. হাসানের ভাই জাকির হোসেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এখন তো দলীয় লোকেরাই ওসব পদ দখল করে নেন। এখানে রফি সাবের গানটির এ কলিটি প্রাসঙ্গিক: ‘ভেঙ্গো না ওর সোনার সংসার/কত সুখী ওর ঐ গান শুনে ফোটে যে সূর্যমুখী’। ড. মাহমুদ হাসানের আমলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগত শিক্ষার্থীরা সূর্যমুখী হয়ে ফুটত। কিন্তু আজ? মনে পড়ে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এককালে ছাগলের জল ছাপযুক্ত সার্টিফিকেট দেয়া হতো- এর অর্থ কি এই যে অধুনা ছেলে/মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানব সন্তান হয়ে প্রবেশ করে ছাগল ছানা হয়ে বেরোয়! এসব দেখে সত্যিই বলতে ইচ্ছে করে: ‘পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না।/ ওকে গাইতে দাও/ ওর কণ্ঠ থেকে গান কেড়ো না/ নাহ্ নাহ্ নাহ্/। দেখ ভেবে, পাখিটা মরে গেলে ফাগুন বিদায় নেবে।/ দেখ ভেবে, পাখিটা মরে গেলে ফাগুন বিদায় নেবে।/ ওর গানই যে ফুল ফোটার প্রেরণা’। আজকে সেই প্রেরণাদায়ক শিক্ষকরাই বা কোথায়? একেবারে নেই তা বলব না; তবে তারা নগণ্য, চোখে পড়ার মতো নন।

রাজনৈতিক অঙ্গনের কথাই বলি। এখানে একে অপরের প্রতিপক্ষকে চুপ করিয়ে দিতে চায়। এখানে চুপ করিয়ে দেয়ার হাতিয়ারটা সরকারের হাতেই ন্যস্ত। বিশুদ্ধ গণতন্ত্রের স্বার্থে, রফি সাবের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে হয় : ‘ওর কণ্ঠ থেকে গান কেড়ো না/ নাহ্ নাহ্ নাহ্/ পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না/। ওকে গাইতে দাও/ ওর কণ্ঠ থেকে গান কেড়ো না/নাহ্ নাহ্ নাহ্’। নানা মত নানা পথের মিলনেই তো একটি দেশে গণতন্ত্রের সুবাতাস বয়ে যায়। এ না হলে ‘দেখ ভেবে, পাখিটা মরে গেলে ফাগুন বিদায় নেবে।’ প্রতিপক্ষ যদি সত্যানুসন্ধানে সোচ্চার না হয়, গণতন্ত্রের ফাগুন আসবে কী করে? আর কথা বাড়াব না। বোদ্ধা পাঠক নিজেই এ গানটিকে রূপক অর্থে ব্যবহার করে অনেক আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবেন। আমি তাই মনে করি।

নিবন্ধটি শেষ করার আগে রফি সাবের এই গানটি আবার তুলে ধরি : ‘নাহ্ নাহ্ নাহ্ / পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না/ ওকে গাইতে দাও/ ওর কণ্ঠ থেকে গান কেড়ো না/ নাহ্ নাহ্ নাহ্/ পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না/ ওকে গাইতে দাও/ ওর কণ্ঠ থেকে গান কেড়ো না/ নাহ্ নাহ্ নাহ্/। দেখ ভেবে পাখিটা মরে গেলে ফাগুন বিদায় নেবে/ দেখ ভেবে পাখিটা মরে গেলে ফাগুন বিদায় নেবে/ ওর গানই যে ফুল ফোটার প্রেরণা/পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো না/ওকে গাইতে দাও/ ওর কণ্ঠ থেকে গান কেড়ো না/নাহ্ নাহ্ নাহ্/। চাও নাকি পাখিটা সারা দিন গান গেয়ে ঘরে ফিরে যাক/ভেঙ্গো না ওর সোনার সংসার/ কত সুখী ওর ঐ গান শুনে ফোটে যে সূর্যমুখী/ যদি আনন্দ পেতে চাও ওকে তুমি ছেড়ো না/ পাখিটার বুকে যেন তুমি তীর মেরো না/ওকে গাইতে দাও/ওর কণ্ঠ থেকে গান কেড়ো না/ নাহ্ নাহ্ নাহ্’। গানটি একবার নয় বারবার শুনে দেখুন। তবেই সুরের ঝংকারে গানটির বহুমাত্রিক রস আস্বাদন করা যাবে। বহু আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চলন বলনের ক্ষেত্রে রূপকার্থে এ গানটি ব্যবহার করা যায়।

লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us