পোশাকের ব্যাপারে ইসলামের ৯টি শর্ত

ড. মাহফুজুর রহমান | Sep 02, 2020 03:40 pm
পোশাকের ব্যাপারে ইসলামের ৯টি শর্ত

পোশাকের ব্যাপারে ইসলামের ৯টি শর্ত - ছবি : সংগৃহীত

 

এদেশে দাওয়াতে দ্বীনের ক্ষেত্রে একটি সঙ্কট ও সমস্যা হলো আলেম ওলামা ও দায়ীদের লেবাস পোশাকের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি। আমি অনেক আলেমকে দেখেছি যাদের লেবাস পোশাকের ব্যাপারে ইসলামের শিক্ষা কী সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকার কারণে তারা এ ব্যাপারে বেশ বাড়াবাড়ি করেন। তারা মাদরাসার ছাত্রদের জন্য শার্ট-প্যান্ট পরা প্রায় হারাম মনে করেন। একজন আলেম সিগারেট খেলে বা নামাজ কাজা করলে সেটাকে তেমন আপরাধ মনে করা হয় না; যেমন শার্ট-প্যান্ট পরাকে অপরাধ মনে করা হয়। আমার এক আলেম বন্ধু অস্ট্রেলিয়া থাকেন; সেখানে দাওয়াতে দ্বীনের কাজ করেন। অস্ট্রেলিয়ার মতো জায়গায় ইসলামিক সেন্টার ও মসজিদ স্থাপন করেছেন। এখন সেখানে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। এ লোকটি শার্ট-প্যান্ট পরে বলে আমার সামনে বহু আলেম তার সমালোচনা ও নিন্দা করেন। দুঃখজনক ব্যাপার হলো- আমার সেই বন্ধু যে দ্বীন ও ঈমানের ব্যাপারে আপসহীন, দাওয়াতের কাজ করছেন সে ব্যাপারে তাদের ভাবনা নেই, তাদের ভাবনা তার শার্ট-প্যান্ট নিয়ে।

আমি এমন বহু লেবাস পোশাকধারী আলেমকে চিনি যাদের লেনদেন, যাদের আমল আখলাক, মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। যাদের কাছে হালাল-হারামের কোনো পার্থক্য নেই। যারা নির্দ্বিধায় মিথ্যা কথা বলেন, মাদরাসার অর্থ আত্মসাৎ করেন। এসব আলেম লেবাস পোশাকের কারণেই নিন্দিত হন না সমালোচিত হন না; সমালোচিত হন শার্ট-প্যান্ট পরা আলেমরা। অথচ শার্ট-প্যান্ট শরিয়তে নিষিদ্ধ কোনো পোশাক নয়।

তারা ড. জাকির নায়েকের দ্বীনের কথা বলাকে এ জন্যই নিন্দা করেন যে, তিনি শার্ট-প্যান্ট পরে দ্বীনের দাওয়াত দেন। এদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের যেসব তরুণ যুবক ইসলামী দাওয়াতের কাজ করেন তাদের ব্যাপারে কিছু আলেমের মুখে এ কথা বলতে প্রায় শোনা যায়, যাদের সাড়ে তিন হাত দেহে ইসলাম নেই তারা কিসের ইসলামের কথা বলে? তাদের ধারণায় পাজামা-পাঞ্জাবি ও লম্বা জুব্বা পরা ছাড়া শার্ট-প্যান্ট পরলে দেহে ইসলাম থাকে না। তাই শার্ট-প্যান্ট পরে ইসলামের কথা বলা যাবে না। তারা ভাবে না দ্বীন যাকে জরুরি বানায়নি তাকে জরুরি বানানোও দ্বীনের দৃষ্টিতেই অন্যায়। এসব আলেম এ কথা কখনো ভাবেন না যে, রাসূল সা:ও তো কখনো পাজামা-পাঞ্জাবি পরেননি। রাসূল সা: না পরা সত্ত্বেও তা ইসলামী লেবাস হবে, আর শার্ট-প্যান্ট রাসূল সা: ও সাহাবিরা পরেননি বলে তা ইহুদি নাসারার পোশাক হবে কেন?

কিছু মানুষ লম্বা জুব্বা পরাকে সুন্নতি লেবাস মনে করেন। কারণ রাসূল সা: তা পরতেন। সাহাবারাও তা পরতেন। তারা ভাবেন না এ পোশাক দ্বীনের পোশাক নয়; এটি আরব জাতির পোশাক। তখনকার কাফেররাও এ পোশাক পরত। তারা না বুঝে ইবাদত ও আদত বা অভ্যাসকে একাকার করে ফেলেছেন। রাসূল সা: যা দ্বীন হিসেবে করেছেন আর যা আরব জাতির অভ্যাস বা মানব স্বভাব হিসেবে করেছেন তার মাঝে যে পার্থক্য আছে তারা তা বোঝেন না। রাসূল সা: যা দ্বীন হিসেবে করেছেন সেটি দ্বীন সুতরাং তার আনুগত্য করতে হবে। আর যা আরব জাতির স্বভাব বা মানব স্বভাব হিসেবে করছেন তা দ্বীন নয়; সুতরাং সে ক্ষেত্রে তার আনুগত্য করা আবশ্যক নয়। এ কারণেই রাসূল সা: কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে তার আগের পোশাক খুলে নতুন কোনো সুন্নতি পোশাক তাকে পরাননি। সাহাবায়ে কেরামও পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় যেসব লোক তাদের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাদের ইসলামী পোশাক নামক নতুন কোনো পোশাক পরাননি। যদিও পৃথিবীর সব এলাকার মানুষের পোশাক লম্বা জুব্বা ছিল না।

এ দেশে যারা পুরুষদের সুন্নতি লেবাস পরার জন্য অত্যন্ত জোর দেন; তারা তাদের স্ত্রীদেরকে সুন্নতি লেবাস পরানোর কথা কখনো ভাবেন না। তারা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। তারা ভাবেন না যে, পুরুষদের সুন্নতি লেবাস থাকলে নারীদেরও সুন্নতি লেবাস থাকার কথা। মহিলাদের সুন্নতি লেবাস কী ধরনের সে ব্যাপারেও তাদের বেশির ভাগই ভাবেন না। তারা এটাও ভাবেন না যে, তাদের স্ত্রীরা শাড়ি-ব্লাউজ, সালোয়ার কামিজ যা পরে তা কখনো রাসূল সা:-এর স্ত্রীরা পরেননি।

কিছু আলেম তো শার্ট প্যান্ট, কোট-টাই পরাকে ইংরেজদের অনুকরণ বলে তা পরলে এর নিন্দা করেন। তারা আরো বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘যারা কোনো জাতির সাদৃশ্য ধারণ করে তারা তাদেরই অন্তর্ভুক্ত’। (আবু দাউদ, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-৪৪, হা: ৪০৫১; শায়খ নাসির উদ্দিন আলবানী হাদিসটি হাসান সহিহ বলে মন্তব্য করেছেন)

এ হাদিসের আলোকে শার্ট-প্যান্ট, কোট-টাই পরা অবৈধ। অবশ্য তারা শেরোয়ানি পরা, সুয়েটার পরা, শাল পরা, লুঙ্গি পরা, পাজামা-পাঞ্জাবি পরাকে কখনো অন্য জাতির অনুকরণ বলে মনে করেন না। তারা জানেন না যে, অন্য জাতির কোন ধরনের বিষয়ে সাদৃশ্য ধারণ অবৈধ? আর কোন ধরনের বিষয়ে সাদৃশ্য ধারণ নিষিদ্ধ নয়। আলোচ্য হাদিসে যে ধরনের বিষয়ে সাদৃশ্য ধারণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সেই সাদৃশ্য হলো অন্য জাতির ধর্মীয় বিষয়ে সাদৃশ্য ধারণ। সুতরাং যা তাদের ধর্মীয় বিষয় নয়; অভ্যাস ও স্বভাবের বিষয় তাতে সাদৃশ্য ধারণ নিষিদ্ধ সাদৃশ্য ধারণের মধ্যে পড়ে না। অতএব কোনো অমুসলিম লুঙ্গি পরছে বলে আমি লুঙ্গি পরতে পারবে না এমনটি নয়। কোনো হিন্দু পাজমা-পাঞ্জাবি পরছে বলে আমরা পাজামা-পাঞ্জাবি পরতে পারব না এমনটিও নয়। কোনো অমুসলিম টুপি পরছে বলে আমরা টুপি পরতে পারব না এমনটিও নয়।

ইসলাম মানুষের জন্য কোনো বিশেষ ধরনের পোশাক পরা আবশ্যক করেনি। কারণ মানুষ পোশাক পরে তার দেশের আবাহাওয়া ও পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে। আমরা বাংলাদেশে যে পোশাক পরে চলাফেরা করি, রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় সে রকম পোশাক পরে চলাফেরা করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। ইসলাম যেহেতু সব মানুষের জন্য আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন তাই যাতে সব মানুষ তাদের আবহাওয়া ও পরিবেশ এবং সমাজিক অবস্থার নিরিখে তাদের পছন্দের পোশাক পরতে পারেন সে জন্য কোনো বিশেষ ধরনের পোশাককে ইসলামী পোশাক বলে চিহ্নিত করে দেয়নি। ইসলাম পোশাকের ব্যাপারে বেশ প্রশস্ততা রেখেছে।
মুআম্মার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মালেক ইবনে দিনারকে বলা হয়, আপনি মানুষের ওপর লেবাস পোশাক ও খাবার দাবারের ব্যাপারে কড়াকড়ি করেন। তখন মালেক ইবনে দিনার বলেন, ‘তোমরা হালাল উপার্জন করো আর যা ইচ্ছা পোশাক পরিধান করো’। (হিলিয়াতুল আওলিয়া, খণ্ড-২, পষ্ঠা-৩৮৫)
আমর ইবনে শোয়াইব থেকে তিনি তার দাদার সূত্রে তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা খাও সাদাকাহ করো; আর অপচয় ও অহঙ্কার না করে পোশাক পরিধান করো’। (নাসায়ি, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৫৯, হা-২৫৫৯; শায়খ নাসির উদ্দিন আলবানি হাদিসটি হাসান বলে মন্তব্য করেছেন। আহমদ, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-৬০০; শায়খ শোয়াইব আরনুউতও হাদিসটির সনদ হাসান বলে মন্তব্য করেছেন)

হ্যাঁ, ইসলাম পোশাকের ব্যাপারে কিছু শর্তারোপ করেছে। যেমন-
১. পুরুষ নারীর পোশাক পরতে পারবে না, আর নারীও পুরুষের পোশাক পরতে পারবে না;
২. পুরুষ মানুষ রেশমি পোশাক পরিধান করতে পরবে না;
৩. যে পোশাক কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর ধর্মীয় পোশাক বলে পরিচিত তেমন কোনো পোশাক মুসলমান নারী-পুরুষ পরিধান করতে পারবে না। যেমন খ্রিষ্টান পাদ্রিদের পোশাক মুসলমান পুরুষরা পরতে পারবে না, আর মুসলমান নারীরা খ্রিষ্টান সিস্টারদের পোশাক পরতে পারবে না। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের পুরোহিতদের বিশেষ ধরনের পোশাক পরতে পারবে না;
৪. পুরুষ মানুষ গেরুয়া রঙের পোশাক পরতে পারবে না;
৫. নারী-পুরুষ কেউ তাদের সতর দেখা যায় তেমন কোনো পোশাক পরতে পারবে না;
৬. নারী-পুরুষ কেউ এমন টাইটফিট পোশাক পরতে পারবে না যাতে তাদের শরীরের অবয়ব প্রকাশ পায়। নারীদের নারীত্ব প্রকাশক অঙ্গগুলো উদ্ভাসিত হয়; ৭. পুরুষ মানুষ পায়ের গোড়ালির নিচে যায় এমন প্যান্ট-পাজামা-লুঙ্গি পরতে পারবে না;
৮. নারী-পুরুষ কেউ লেবাসুস শুহরা বা প্রসিদ্ধিজ্ঞাপক পোশাক পরতে পারবে না;
৯. পোশাকে অপচয় করা যাবে না বা অহঙ্কার আসে এ রকম পোশাক পরা যাবে না।

এ শর্তগুলো রক্ষা করে যেকোনো ধরনের পোশাক মুসলমান পরতে পারে। পাজামা-পাঞ্জাবি, শার্ট-প্যান্ট, কোট-টাই লুঙ্গি সবই পরতে পারবে। মহিলা সালোয়ার কামিজ, শাড়ি-ব্লাউজ, লেহেঙ্গা ইত্যাদি সবই পরতে পারবে। তবে শর্ত হলো- তার শরীর ডাকতে হবে।

লেখক : ইসলামিক স্কলার ও অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us