যেভাবে কথা বলবেন

ড. মো: আবদুল কাদের | Oct 04, 2020 02:30 pm
যেভাবে কথা বলবেন

যেভাবে কথা বলবেন - ছবি সংগৃহীত

 

ইসলামী দাওয়াতের প্রধান মাধ্যম হলো বক্তৃতা। যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ বক্তৃতার মাধ্যমে মানুষকে দ্বীনের পথে আহ্বান জানিয়েছেন। মহান আল্লাহ মানুষকে কথা বলা শিখিয়েছেন। সুতরাং প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য একে অপরের সাথে বাক্য বিনিময় করে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদেরকে কথা বলা শিক্ষা দিযয়েছেন।’ (সূরা আর রহমান : ২-৩)

বর্তমান পৃথিবীতে প্রচলিত ও আবিষ্কৃত যত ধরনের ভাষা রয়েছে তা সবই মহান আল্লাহর দান। ভাষা হলো মানুষের মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। নবী-রাসূলগণ স্বজাতির কাছে তাদের ভাষায় বক্তব্যের মাধ্যমে দাওয়াত দিয়েছেন। কুরআন এসেছে, ‘আমি সব রাসূলকেই তাদের স্বজাতির কাছে ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদের কাছে বর্ণনা করতে পারে।’ রাসূল মুহাম্মদ সা: আরববাসীর কাছে অল্প কথায় অনেক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করতেন। তাঁর মতে, ‘নিশ্চয়ই কোনো বক্তব্য জাদুর মতো প্রভাব ফেলে।’ ফলে বক্তব্যদানের ক্ষেত্রে নবী-রাসূলগণ যেসব রীতি-পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন প্রত্যেক দাঈকে তা অনুসরণ করা আবশ্যক।

বক্তব্য হতে হবে সত্য-সঠিক ও শরিয়াহসম্মত। অসত্য ও মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে বক্তব্য দেয়া মিথ্যাকে প্রমোট করার শামিল। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো।’ (সূরা আল আহজাব : ৭০) অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তোমাদের মুখ থেকে সাধারণত যেসব মিথ্যা বের হয়ে আসে, তার মাধ্যমে তোমরা আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে বলো না যে, এটা হালাল এবং ওটি হারাম। নিশ্চয় যারা আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা আরোপ করে, তারা সফলকাম হবে না।’ (সূরা আন নাহল : ১১৬)

বক্তব্যদানে বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করতে হয়। কেননা বিনয় ও নম্রতা দাঈকে শ্রোতামণ্ডলীর নিকটতম করে দেয়। বিশাল ক্ষমতাধর ফেরাউনের কাছে দাওয়াত উপস্থাপনের জন্য মুসা ও হারুন আ:কে লক্ষ্য করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তোমরা তাকে নম্র কথা বলো, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভীত হবে। (সূরা ত্বহা : ৪৪) অপর দিকে রূঢ়তা ও কঠোরতা অবলম্বন শ্রোতামণ্ডলীকে দূরে ঠেলে দেয়। এদিকে লক্ষ্য করে মহানবীর দাওয়াত সম্পর্কে কুরআনে এসেছে, ‘আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন, আপনি যদি রূঢ় ও কঠিন হৃদয়ের হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে অবশ্যই বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। (সূরা আলে ইমরান : ১৫৯)

সুস্পষ্টভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করা প্রত্যেক দাঈর কর্তব্য। উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলীর কাছে খুব সহজেই অনুমেয় হয়, এরূপ শব্দ চয়ন করা জরুরি। জনসাধারণের বোধগম্য নয়, এমন কোনো দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার অনুচিত। রাসূল (সা:) এর বক্তব্য এমন স্পষ্ট ছিল যে, যারা শুনত তারা তা সবাই বুঝত। তদুপরি তিনবার পর্যন্ত তিনি বক্তব্য পুনরাবৃত্তি করতেন। হাদিসে এসেছে, তাঁর বক্তব্য এত স্পষ্ট ছিল যে, ‘যারা শুনত তাদের প্রত্যেকে তা বুঝতে সক্ষম হতো।’ (আবু দাউদ : ৪৮৩৯) অন্যত্র এসেছে, রাসূল সা: যখন কোনো কথা বলতেন, তখন তা তিনবার পুনরাবৃত্তি করতেন যেন তা স্পষ্ট হয়। (বুখারি : ৯৫)

কোনো বিষয়ে সুস্পষ্ট জ্ঞান না থাকলে সে ব্যাপারে বক্তব্য দেয়া সমীচীন নয়। কারণ এ ধরনের বক্তব্য সমালোচনার পথ উন্মুক্ত করে দেয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হয়ো না। নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু, হৃদয় প্রত্যেকের কাছে কৈফিয়ৎ তলব করা হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৬)

বক্তব্যের সময় কাউকে ঠাট্টা বিদ্রূপ করা, বিকৃত নামে ডাকা ইসলাম খুব কঠিনভাবে নিষেধ করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর পুরুষকে উপহাস না করে। কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো মহিলা অপর কোনো মহিলাকেও যেন উপহাস না করে। কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। ঈমান আনার পর মন্দ নামে ডাকা গর্হিত কাজ। যারা এ ধরনের আচরণ থেকে বিরত হয় না তারাই জালিম। (সূরা আল হুজুরাত : ১১) এ ছাড়াও বক্তাকে যেকোনো অনর্থক কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা এটি শুধু তাই নয়; বরং একজন মুমিনের অন্যতম গুণ। মহান আল্লাহ বলেন, (সফলকাম তারা) আর যারা অনর্থক ক্রিয়া-কলাপ হতে বিরত থাকে। (সূরা আল মুমিনুন : ৩) তাছাড়া দীর্ঘক্ষণ ও অহঙ্কারপূর্ণ কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে।

কেননা এসব শ্রোতাদের বিরক্তির উদ্রেক করে। সংক্ষিপ্ত ভাষণ মানুষের জ্ঞানের পরিচায়ক। হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: বলেন, ‘নিশ্চয়ই কোনো ব্যক্তির দীর্ঘতম সালাত আদায় ও সংক্ষিপ্ত ভাষণ তার জ্ঞানের পরিচায়ক। অতএব, সালাতকে দীর্ঘ করো ও বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করো।’ (মুসলিম : ২০৪৬) অন্য হাদিসে এসেছে, নিশ্চয়ই কেয়ামত দিবসে আমার ক্রোধ ও দূরবর্তী অবস্থানে থাকবে যারা বাচাল অতিশয় উক্তিকারী এবং বিদ্রূকারীগণ। আর যার অহঙ্কারবোধ প্রদর্শিত হয়। (তিরমিজি : ২০১৮)

এমন কোনো বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করা উচিত নয়, যার সাথে তার কাজের বা ব্যক্তিগত আমলের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। কেননা মহান আল্লাহর কাছে এ ধরনের বক্তব্য নিন্দিত ও ঘৃণিত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যা করো না তা কেন বলো, আল্লাহর কাছে অত্যন্ত নিন্দনীয় হলো এমন কথা বলা যা তোমরা আমল করো না।’ (সূরা আস-সাফ :১-৩) সব নবী ও রাসূল মানুষকে দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়টির খুব গুরুত্ব দিতেন। কুরআনে এসেছে, ‘আর আমি চাই না যে তোমাদের যা ছাড়াতে চাই পরে নিজেই সে কাজে লিপ্ত হবো।’ (সূরা হুদ : ৮৮)

অতএব, দাঈদের কর্তব্য হলো সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় মানুষের সম্মুখে সত্য দাওয়াত উপস্থাপন করা, যাতে থাকবে বিনয়-নম্রতাসহ দরদ মাখা আহ্বান, অহঙ্কারমুক্ত থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। শ্রোতামণ্ডলীর বাহবা কুড়ানো উদ্দেশ্য হবে না। ইখলাসপূর্ণ পন্থায় এই মহতী কাজ আঞ্জাম দিলে শ্রোতামণ্ডলীর ওপর যে কোনো বক্তব্য জাদুর মতো প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us