কেন সরানো হয়েছিল স্ট্যালিনের লাশ

গোলাপ মুনীর | Oct 04, 2020 08:41 pm
স্ট্যালিন

স্ট্যালিন - ছবি : সংগৃহীত

 

নানা অসামঞ্জস্য
সোভিয়েত লৌহমানব স্ট্যালিনের খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ারপর প্রথম সরকারি ঘোষণায় দাবি করা হয় তিনি অসুস্থ হন তার মস্কোর অ্যাপার্টমেন্টে। যদি তা সত্য হয়, তাহলে তিনি কী করে ফিরে গেলেন কুনজেভোতে, যা আরো ৪৮ মাইল দূরে? কেন সরকারি ভাষ্যে বলা হলো, তিনি প্রথম রোগে পড়েন সোমবার খুব ভোরের দিকে, যেখানে ক্রুশ্চেভ ও অন্যরা বলেছেন, তিনি আক্রান্ত হন রোববার সকালের দিকে? পদচ্যুত ক্রুশ্চেভ কেন কয়েক বছর পর তার স্মৃতিচারণে এমন ভিন্ন কথা বলেন যে, তিনি ও তার তিন সাথী যখন স্ট্যালিনের গ্রামের বাড়িতে যান তখন তারা স্ট্যালিনকে দেখেননি এবং ডাক্তারও ডাকেননি? তা না করে বরং এর বদলে তারা বাড়ি চলে যান এবং ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকেন যতক্ষণ না ম্যালেনকভ কয়েক ঘণ্টা পর এমন খবর নিয়ে আসেন যে, স্ট্যালিন আসলেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

তার মৃত্যুর কিছু দিন আগে তিনি ভারতীয় কূটনীতিকের কাছে দাবি করেছিলেন, স্ট্যালিন অলসভাবে এঁকেছিলেন ক্রুদ্ধ খেঁকশিয়ালের ছবি। তিনি কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, অনুগ্রহ করে জেনে নিন কিভাবে খেঁকশিয়াল নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এরা তাদের পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়।

স্ট্যালিন কি একটি প্রতি-আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন? তার ‘ডক্টরস প্লট’ হতে পারে তার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার অজুহাত খাড়া করা। শেষ দিকে স্ট্যালিন যখন ল্যাভরেন্টি বেরিয়ার ওপর মাঝে মধ্যেই হঠাৎ করে রেগে যেতেন, তখন ধরে নেয়া যেত এই সিক্রেট পুলিশপ্রধান বিপদে আছেন। আসলে যাই ঘটুক, স্বৈরশাসক স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর বেরিয়ার পরমান্দকর স্বস্তি ও ক্ষমতার উলঙ্গ দখল স্বল্প সময় স্থায়ী হয়। জুন মাসে তাকে প্রকাশ্যে গ্রেফতার করে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করা হয়। ম্যালেনকভ সরকারের প্রধান ও একই সাথে কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হিসেবে স্ট্যালিনের উত্তরসূরি হয়েছিলেন। তিনি প্রেসিডিয়ামের বাকিদের সাথে যোগ দেন টেরোরিজমের জিনিয়াস বলে খ্যাত বেরিয়াকে প্রকাশ্যে দোষারোপ ও মুক্ত করার কাজে নেমে পড়েন। সম্ভবত একটি গোপন বিচারের মাধ্যমে ডিসেম্বরের দিকে বেরিয়ার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রায় ঘোষণার পর পরই সে স্থানেই তাকে গুলি করে মারা হয়। আগে যা বলার মতো ছিল না, শিগগিরই এ নিয়ে নানা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। মৃত ক্ষমতাধরদের সঙ্গী সাথীদের শিশুধর্ষণ, ছিনিয়ে আনা তরুণীদের নিয়ে পানোন্মত্ততা ও এমনি আরো অনেক গুঞ্জনই মস্কোর বাতাসে ভাসতে লাগল।

যুগের সমাপ্তি
অন্যান্য পরিবর্তনও বাতাসে ভাসতে লাগল। সেপ্টেম্বরের দিকে ক্রুশ্চেভ ম্যালকভের কাছ থেকে পার্টির সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন। আর ১৯৫৫ সালে স্ট্যালিনের ফার্স্ট ডেপুটিকে একটি প্রদেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে কার্যত নির্বাসনে পাঠিয়ে বুলগেনিন হলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রজন্মে এই প্রথমবারের মতো নেতৃত্বে পরিবর্তন ঘটেনি চিপটেইনের জীবনের বিনিময়ে। আরো বড় মাটি কাঁপানো ঘটনা হলো, মস্কো দ্রুত সরে এলো স্ট্যালিনের বিখ্যাত ‘কাল্ট অব পার্সোনালিটি’ থেকে। স্ট্যালিনের সমাহিত হওয়ার দুই সপ্তাহ পর থেকে সরকারি প্রেসে স্ট্যালিনকে আর ধফ হধঁংবঁস হিসেবে উদ্ধৃত করা হতো না কিংবা তাকে প্রশংসা করে কিছু লেখা হতো না। ‘স্ট্যালিনিস্ট কনস্টিটিউশন’ রূপ নিলো ‘সোভিয়েত কনস্টিটিউশন’-এ। এমনকি রুশ সরকারি অভিধান থেকে ‘স্ট্যালিনিস্ট’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। সরকারি পত্রিকা প্রাভদা ঘোষণা করল ‘ডক্টরস প্লট’ কখনোই অস্তিত্বশীল ছিল না। ক্রুশ্চেভ প্রকাশ্যে বলেন, স্ট্যালিনের অব্যবস্থাপনার সূত্রে কৃষিসঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে।

সবশেষে ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন নেতা ২০তম পার্টি কংগ্রেসে দেন তার বিখ্যাত ‘সিক্রেট স্পিচ’। এতে তিনি তার পূর্বসূরি স্ট্যালিনের শাসনামলের বর্বরতা ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কথা উল্লেখ করেন। তাদের পাশ্চাত্যের শত্রুদের প্রশ্নে ক্রুশ্চেভ স্ট্যালিনের শত্রুতাপূর্ণ বিদেশনীতির বিপরীত নীতিতে অবস্থান নেন। তার নতুন ডকট্রিন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হয় ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান‘ হিসেবে। এর মধ্য দিয়ে কার্যত বিদায় করা হয় স্ট্যালিন যুগের।

সরানো হলো স্ট্যালিনের লাশ
১৯৫৩ সালে স্ট্যালিন মারা যাওয়ার পর লেনিনের লাশের পাশেই সমাহিত করা হয়। এর পর প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ তার সমাধি দেখত আসত। এর আট বছর পর সোভিয়েত সরকার আদেশ দেয় লেনিনের সমাধি থেকে স্ট্যালিনের লাশ সরিয়ে নেয়ার জন্য। কেন সোভিয়েত সরকারের মনোভাবের এই পরিবর্তন? লেনিনের সমাধি থেকে স্ট্যালিনের লাশ সরানোর পর এ লাশের কী হলো?

এ কথা ঠিক, স্ট্যালিন ছিলেন এক স্বৈরশাসক। তার পরও তিনি নিজেকে জনগণের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন ফাদার অব দ্য পিপল হিসেবে। তার মৃত্যুর পর সোভিয়েত জনগণ বলতে শুরু করে, তিনি দেশের লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। কমিউনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি (১৯৫৩-১৯৬৪) এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৮-১৯৬৪) নিকিতা ক্রুশ্চেভ শুরু করেন ডি-স্ট্যালিনাইজেশনের কাজ। স্ট্যালিনের মৃত্যুর তিন বছর পর ১৯৫৬ সালের ২৪-২৫ ফেব্রুয়ারি ক্রুশ্চেভ ২০তম পার্টি কংগ্রেসে দেয়া ভাষণে স্ট্যালিনের জীবনের প্রচলিত সব মহত্ত্ব ধূলিসাৎ করে দেন। এই ভাষণে ক্রুশ্চেভ স্ট্যালিনের করা নানা বর্বরতার কথা উল্লেখ করেন।

পাঁচ বছর পর সময় এলো ‘প্লেস অব অনার’ হিসেবে বিবেচিত লেনিন টম্ব থেকে স্ট্যালিনের লাশ সরিয়ে দেয়ার। কমিউনিস্ট পার্টির ২২তম পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ১৯৬১ সালের অক্টোবরে। এই পার্টি কংগ্রেসে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধা বললেন : ‘আমার হৃদয় লেনিনে পরিপূর্ণ। কমরেড, আমি আমার জীবনের সবচেয়ে জটিল দিনগুলো পেরিয়ে আসতে পেরেছি শুধু একটি কারণে। কারণ আমি আমার হৃদয়ে বহন করেছি লেনিনকে এবং সব সময় করণীয় সম্পর্কে তার পরামর্শ নিয়েছি। গতকালও আমি তার পরামর্শ নিয়েছি। তিনি ছিলেন আমার সামনে দাঁড়িয়ে, যেন এখনো তিনি জীবিত এবং তিনি আমাকে বলেছেন, স্ট্যালিন আমার পাশে শুয়ে আছে এটি আমার জন্য বিরক্তিকর। পার্টির এই ক্ষতিটা কে করল।’

এই বক্তব্য ছিল পূর্বপরিকল্পিত। তার পরও এটি ছিল বেশ কার্যকর প্রভাব সৃষ্টিকর। এর পর ক্রুশ্চেভ স্ট্যালিনের লাশ সরিয়ে নেয়ার ব্যাাপারে একটি ডিক্রি পাঠ করেন। এর কয়দিন পর স্ট্যালিনের লাশ নীরবে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। তার লাশ আবার কবর দেয়া হয় অন্য সব ছোটখাটো বিপ্লবী নেতাদের কবরের পাশে। তাকে কবর দেয়া হয় ক্রেমলিন দেয়ালের পাশে অনেকটা গাছগাছালি দিয়ে আড়াল করা এক স্থানে। এর কয় সপ্তাহ পর কবরের পাশে স্থাপন করা হয় একটি ছোট্ট গ্রানাইট পাথর যাতে শুধু লেখা হয় : ‘জেবিএস স্ট্যালিন ১৮৭৯- ১৯৫৩’। ১৯৭০ সালে তার কবরের পাশে যোগ করা হয় একটি ছোট্ট আবক্ষমূর্তি।

 

 

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us