ভেসেকটমি পুনঃ নালীকরণ : বন্ধ্যা পুরুষকে সক্ষম করা

ডা: মো: সাইফুল ইসলাম | Oct 13, 2020 02:55 pm
ভেসেকটমি পুনঃ নালীকরণ : বন্ধ্যা পুরুষকে সক্ষম করা

ভেসেকটমি পুনঃ নালীকরণ : বন্ধ্যা পুরুষকে সক্ষম করা - ছবি সংগৃহীত

 

জনসংখ্যায় ভারাক্রান্ত এদেশের জনগণকে সরকারি বা বেসরকারি সবপর্যায় থেকেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অস্থায়ী বা স্থায়ী দু’রকম পরামর্শই দেয়া হয়। অস্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করার পর সক্ষম দম্পতি ইচ্ছা করলেই যেকোনো সময় সন্তান নিতে পারেন। কিন্তু স্থায়ী পদ্ধতি যেমন পুরুষের জন্য ‘ভেসেকটমি’ ও মহিলাদের জন্য ‘লাইগেশন’ একবার গ্রহণ করলে সক্ষম দম্পতি সহজেই যেকোনো সময় সন্তান ধারণ করতে পারবে না। তখন সন্তান ধারণ করতে হলে জটিল চিকিৎসাপদ্ধতির প্রয়োজন হয়।

ভেসেকটমি একটি স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। পুরুষের অন্ডোকোষ থেকে শুক্রাণু ভাসডিফারেনস নামক নালীর মাধ্যমে বীর্যের সাথে মিশ্রিত হয়ে পুরুষাঙ্গের মূত্রনালীর ভেতর দিয়ে সঙ্গমের সময় স্ত্রীর যৌনাঙ্গে প্রবেশ করে এবং গর্ভধারণ করে। ভেসেকটমি নামক ছোট একটি অপারেশনের মাধ্যমে ভাসডিফারেনস নালীকে কেটে বা বেঁধে দেয়া হয় এবং এর দ্বারা এই নালীর ভেতর দিয়ে আর শুক্রাণু চলাচল করতে পারে না। অস্ত্রপ্রচারকৃত পুরুষ তখন স্থায়ীভাবে বন্ধ্যা হয়ে যায় বলে মনে করা হয়। কিন্তু পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২ থেকে ৬ শতাংশ ভেসেকটমি সম্পাদিত পুরুষের বিভিন্ন কারণে সন্তান ধারণের জন্য ভেসেকটমি পুনঃনালীকরণ প্রয়োজন হয়। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে অণুবিক্ষণিক অস্ত্রপ্রচারের মাধ্যমে খণ্ডিত ভাসডিফারেন্সকে জোড়া লাগিয়ে পুনঃনালীকরণ করা হয়। এই অস্ত্রোপচারের সময় যদি অন্তত একপাশের নালীর রসে শুক্রাণু পাওয়া যায় তবে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে অপারেশনের পর বীর্যে শুক্রাণু পাওয়া যায় এবং ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে গর্ভধারণের সফলতা পাওয়া যায়।

সফলতার হার
ভেসেকটমি পুনঃনালীকরণ অপারেশনের সফলতা নির্ভর করে ভেসেকটমির মেয়াদ, অণ্ডকোষের অবস্থা ও ইপিডিডাইমাস বা বীর্যথলির অবস্থার ওপর। কত দিন আগে ভেসেকটমি অপারেশন করা হয়েছে এই সময়টি পুনঃনালীকরণের সফলতায় অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। যদি ভেসেকটমি অপারেশনের তিন বছরের মধ্যে পুনঃনালীকরণ করা হয় তবে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে বীর্যে শুক্রাণুর উপস্থিতি ও ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে গর্ভধারণের আশা করা যায়। আর যদি ১০ বছরের মধ্যে পুনঃনালীকরণ করা হয় তবে বীর্যে শুক্রাণু প্রাপ্তির হার ৮০ শতাংশের নিচে ও গর্ভধারণের হার ৪৫ শতাংশের নিচে নেমে যায়। অণ্ডকোষ যদি নরম ও ছোট হয় এবং শরীরে উচ্চমাত্রায় এফএসএইচ (FSH) হরমোন বিদ্যমান থাকে তবে পুনঃনালীকরণ অপারেশনের সফলতা অত্যন্ত কম থাকে।

অণ্ডকোষের পার্শ্বে অবস্থিত ইপিডিডাইমাস বা বীর্যথলি যদি ফোলা থাকে তবে মনে করা হয় যে, বীর্যথলি থেকে শুক্রাণু ভাসডিফারেন্স বা বীর্যনালীতে যেতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে ভাসডিফারেন্স বা বীর্যনালীর সাথে ভাসডিফারেন্স বা বীর্যনালীর জোড়া না লাগিয়ে ভাসডিফারেন্স বা বীর্যনালীর সাথে ইপিডিডাইমাস বা বীর্যথলির জোড়া লাগানো হয়। এ ছাড়াও অণ্ডকোষে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পর যদি রক্তে এন্টিস্পার্ম এন্টিবডি নামক জৈবরস যদি বেশি তাকে তাহলেও পুনঃনালীকরণের সফলতা খুবই কম থাকে।

ভেসেকটমি পুনঃনালীকরণ পদ্ধতি
ভেসেকটমি পুনঃনালীকরণ অপারেশনটি লোকাল বা স্থানীয়ভাবে অবশ করে যেমন করা যায়, তেমনি শরীরের নিম্নাংশ অবশ করেও করা যায়। অপারেশনের সময় সাধারণত দুই থেকে চার ঘণ্টা লাগে। সময় নির্ভর করে ইতোপূর্বে সম্পাদিত ভেসেকটমি পরবর্তী ভাসডিফারেন্স বা বীর্যনালীর পরবর্তী অবস্থার ওপর। সাধারণত অপারেটিভ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে এই অপারেশন করা হলেও শক্তিশালী সার্জিক্যাল চশমা ব্যবহার করেও এই অপারেশন করা যায়। এর সফলতা নিভর্র করে সার্জনের দক্ষতার ওপর।

প্রথমে অপারেশন থিয়েটারে রোগীকে শুইয়ে তার অণ্ডকোষের থলিকে জীবাণুমুক্ত করা হয়। তারপর অণ্ডথলিতে অন্ডকোষ ও ভাসডিফারেন্সকে পরীক্ষা করা হয়। এরপর দুই আঙ্গুলের মাধ্যমে ইতোপূর্বে সম্পাদিত ভেসেকটমির জায়গা নির্ণয় করে ভাসডিফারেন্সকে ধরে তার উপরস্থিত অণ্ডথলির চামড়ায় অবশ করার ওষুধ প্রয়োগ করে অণ্ডথলির চামড়ায় খুব ছোট করে কেটে ভাসডিফারেন্সকে বের করে আনা হয়। তারপর ইতোপূর্বে করা ভেসেকটমির অংশটুকু কেটে বাদ দিয়ে কাটা অংশ থেকে নিঃসৃত রস অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষা করা হয় কোনো প্রকার শুক্রাণু আছে কি না তা দেখার জন্য। অংশের উভয় অংশে আর কোনো বাধা যে নেই তা দেখার জন্য নরমাল সেলাইন দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। তারপর চুলের চেয়েও চিকন সার্জিলে সুতা (৭/০ বা ৯/০ প্রলিন ) দ্বারা এমনভাবে সেলাই করা হয় যেন বীর্যনালী থেকে কোনো প্রকার রস বের না যায়। পরে অণ্ডথলির কাটা জায়গাটাকে সেলাই দিয়ে বা সেলাই ছাড়াই বন্ধ করে ড্রেসিং করে দেয়া হয়। অণ্ডথলির সেলাই কাটার কোনো প্রয়োজন হয় না এবং দুই দিনের মধ্যেই রোগী সুস্থ হয়ে হালকা স্বাভাবিক কাজ কর্মে ফিরে যেতে পারে।

অপারেশনের সময় কাটা অংশ থেকে যে রস নির্গত হয় তার ভেতরে যদি কোনো শুক্রাণুু পাওয়া যায় তবে কোনো কোনো কেন্দ্রে তা পরবর্তীতে যদি প্রয়োজন হয় তবে ‘স্পার্ম ব্যাঙ্ক’ নামক স্থানে সংরক্ষণ করা হয়। এর মাধ্যমে পরে প্রয়োজনে টেস্টটিউব প্রযুক্তিতে গর্ভধারণ সম্ভব হয়।

অপারেশন পরবর্তী অবস্থা
ভেসেকটমি পুনঃনালীকরণ অপারেশনের দুই-তিনদিন পর থেকে রোগী হালকা কাজকর্ম করতে পারে এবং কমপক্ষে চার সপ্তাহ যৌনমিলন থেকে বিরত থাকতে হবে। অপারেশনের সফলতা দেখার জন্য এক, তিন ও ছয় মাস অন্তর বীর্য পরীক্ষা করে শুক্রাণুর উপস্থিতি দেখা যেতে পারে। রোগীকে এবং তার স্ত্রীকে গর্ভধারণের জন্য স্বাভাবিক যৌনমিলনে উৎসাহিত করা হয়ে থাকে। কোনো কোনো সময় ১২ শতাংশ ক্ষেত্রে ভেসেকটমি পুনঃনালীকরণ অপারেশনের পরেও জোড়া লাগানো স্থানে এক বছরের মধ্যে পুনরায় সরু হয়ে নালী বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বীর্যে ধীরে ধীরে শুক্রাণুর পরিমাণ ও শুক্রাণুর গতি কমে যেতে থাকে। সে ক্ষেত্রে পুনরায় অপারেশনের প্রয়োজন হয়।

প্রযুক্তিগতভাবে ভেসেকটমি পুনঃনালীকরণ অপারেশন একটি সুড়ঙ্গ ও জটিল অনুবিক্ষণিক অপারেশন হলেও এর সফলতা একটি স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি দ্বারা বন্ধা একজন পুরুষকে পুনরায় সন্তান জন্মদানে সক্ষম করে তুলতে পারে। এই অপারেশনের সফলতা অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল, যার মধ্যে ভেসেকটমি পরবর্তী অতিবাহিত সময় ও অস্ত্রোপচারকারী সার্জনের দক্ষতা অন্যতম।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইউরোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us