কুরআন সংরক্ষণ ও সঙ্কলনের ইতিহাস

মুফতি আবু বকর সিদ্দিকী | Oct 18, 2020 05:53 pm
কুরআন সংরক্ষণ ও সঙ্কলনের ইতিহাস

কুরআন সংরক্ষণ ও সঙ্কলনের ইতিহাস - ছবি সংগৃহীত

 

পৃথিবীর সবাই এ কথার জ্ঞান রাখে যে, পবিত্র কুরআনুল কারিম মহান আল্লাহ তায়ালার মহাপবিত্র বাণী, আর আল্লাহ তায়ালা যেমন অনাদি, অক্ষত তদ্রূপ তার বাণী ও অনাদি-অক্ষত যে কথাটি তিনি স্বীয় গ্রন্থ কুরআনেই উল্লেখ করেছেন, বরং এটা মহা সম্মানিত পবিত্র কুরআন যা লাওহে মাহ্ফুজে সংরক্ষিত (সূরা বুরুজ আয়াত ২১-২২)।

উল্লেখিত আয়াত হতে এটা প্রতীয়মান হয় যে পবিত্র কুরআন অনাদি কাল হতেই লিখিত ও সংরক্ষিত, আর সংরক্ষণের সেই স্থানের নাম হলো লাওহে মাহ্ফুজ, আর লাওহে মাহ্ফুজ সম্পর্কে হাদিস বর্ণিত হয়েছে যে, হজরত ইব্নে আব্বাস রা: বলেন, যে, তা সাদা মতি দ্বারা নির্মিত যার দৈর্ঘ্য আসমান জমিনের দূরত্ব এবং তা পূর্ব পশ্চিম দিগন্ত পরিমাণ প্রশস্ত। (তাফসিরে জালালাইন)

অবতরণ : পবিত্র কুরআনুল কারিম লাওহে মাহ্ফুজ হতে দুইবার অবতরণ হয়েছে।
প্রথম অবতরণ : লাওহে মাহ্ফুজ হতে বাইতুল ইজ্জতে যা বাইতুল্লাহ্ শরিফ বরাবর অবস্থিত ফেরেস্তাদের ইবাদতখানা যার অপর নাম বাইতুল মা’মুর। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন প্রথমত পূর্ণ কুরআনকে একসাথে লাইলাতুল কদরে বাইতুল ইজ্জতে অবতরণ করেছেন, কুরআনুল হাকিমে ইরশাদ হচ্ছে, নিশ্চয় আমি ইহাকে (কুরআন) লাইলাতুল কদরে অবতরণ করেছি। (সূরা কদর ১)

দ্বিতীয় অবতরণ : হজরত আয়েশা রা: হতে বর্ণিত প্রিয়নবী সায়্যিদুল মুরসালীন খাতামুন্নাবিয়্যিন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ সা: নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে নির্জনতা পছন্দ করতেন, এ কারণে তিনি বাইতুল্লার অদূরে অবস্থিত হেরাগুহায় নিসঙ্গ জীবন বেছে নিলেন, এমনকি তার বয়স যখন চল্লিশ বছর পূর্ণ হলো, তখন আল্লাহ্ তায়ালা মহা পবিত্র লাওহে মাহ্ফুজে সংরক্ষিত বাণীকে জিবরাইল আ: মারফতে দুনিয়ার জমিনে নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ সা:-এর ওপর অবতরণ করেন। রাসূল সা:-এর ওপর সর্বপ্রথম নাজিলকৃত কুরআনের অংশ হলো সূরা আলাকের প্রথম তিন আয়াত এরপর ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘ তেইশ বছর যাবত প্রয়োজন অনুসারে অল্প অল্প করে পূর্ণ কুরআন অবতীর্ণ হয়। রাসূলুল্লাহ্ সা: কুরআন নাজিলের প্রথম দিন হতে শেষ পর্যন্ত পূর্ণ কুরআনকে স্বয়ং মুখস্থ এবং আপন সাহাবায়ে কেরামকে মুখস্থের প্রতি উৎসাহ করে ও তাকিদ দিয়ে কুরআনুল কারিমকে দুনিয়ার জমিনে সংরক্ষণের প্রাথমিক ব্যবস্থাপনা করেন। অতঃপর বিভিন্ন সাহাবিকে যথা উবাই ইব্নে কা’ব, মুয়াবিয়া, যাবেদ প্রমুখকে কুরআন লিখে সংরক্ষণ করার দায়িত্ব অর্পণ করেন। কারণ মুখস্থ এক সময় ভুলে যাওয়ার ও সম্ভাবনা থাকে, সুতরাং তারা রাসূল সা: এর পূর্ণ নেগরাণীতে এবং দিক নির্দেশনায় অর্থাৎ কোন্ সূরা কোথায় হবে এমনকি কোন আয়াত কোথায় থাকবে সে বিষয়েও রাসূল সা: থেকে পরামর্শ নেন ও সে অনুপাতে কুরআন লিখে রাখেন। তবে রাসূল সা:-এর জীবদ্দশায় পূর্ণ কুরআনকে একত্রে কিতাব আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়নি, কারণ রাসূল সা: যতক্ষণ জীবিত আছেন ততক্ষণ পর্যন্ত ওহি/কুরআন নাজিল হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। অতঃপর সেই নাজিল আয়াত বা সূরাটি কোন স্থানে হবে তাও কারো জানা ছিল না অর্থাৎ বিষয়টি এমন ছিল না যে, আগে অবতীর্ণ সূরা বা আয়াত আগে লিখা হবে আর পরে অবতীর্ণ আয়াত পরে লিখা হবে বরং বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ খোদা কর্তৃক সিদ্ধান্ত তিনি যে সূরাকে যেখানে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন রাসূল সা: সেই সূরাকে সেখানেই প্রতিস্থাপন করার জন্য বলেছেন আর অহি লিখক সাহাবিরা রাসূলের নির্দেশকে হুবহু বাস্তবায়ন করেছেন বিধায় রাসূল সা: জীবিত থাকা পর্যন্ত পূর্ণ কুরআনকে একত্রে কিতাবের রূপ দেয়া সম্ভব হয়নি। বরং বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন স্থানে লিখে তা সংরক্ষণ করা হতো।

পূর্ণ কুরআনকে সর্বপ্রথম একত্র করার ইতিহাস
ছিদ্দিকে আকবর হজরত আবু বকর রা:-এর খেলাফতকালে ইসলামের অন্যতম ঘোর শত্রু মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদার মুসায়লামাতুল কাজ্জাবের সাথে ইয়ামামায় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে প্রায় বারশত মুসলিম সাহাবায়ে কেরাম শহীদ হন তন্মধ্যে হাফেজ ও কারীরাও শহীদ হন। এত বিপুলসংখ্যক হাফেজে কুরআন শহীদ হওয়ায় সায়্যিদুনা উমারে ফারুক রা: খুবই মর্মাহত হলেন এবং ভবিষ্যতে এভাবে হাফেজে কুরআন শহীন হলে এক সময় হাফেজে কুরআন বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করলেন। বিধায় তিনি, খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত আবু বকর রা:-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন এবং সম্পূর্ণ কুরআন একত্র করার প্রতি উৎসাহিত করলেন। কিন্তু হজরত আবু বকর রা: বিষয়টি অগ্রাহ্য করলেন, এতদসত্ত্বেও হজরত উমর রা: পিছপা হলেন না বরং বারবার বলতেই থাকলেন, অবশেষে হজরত আবু বকর রা:-এর এ বিষয়ে বক্ষ খুলে গেল তাই পূর্ণ কুরআন একত্র করার অনুমতি দিলেন, অবশেষে হজরত যায়েদ ইবনে ছাবিত রা:-কে ডাকলেন এবং পূর্ণ কুরআন একত্র করার নির্দেশ দিলেন। কুরআনের প্রথম একত্রিত সেই কপি আবু বকরের কাছেই তার ওফাত পর্যন্ত রয়ে গেল অতঃপর তার ওফাতের পর কুরআনের এ কপি হজরত উমর ফারুক রা:-এর কাছে ছিল তিনি ওফাত বরণের পর তারই কন্যা রাসূল সা:-এর স্ত্রী হজরত হাফছা রা:-এর নিকট রাখলেন অতঃপর কুরআনের এই মূল কপির অনুসরণ করে আরো অনেক কফি করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থানান্তর করা হলো।

হজরত ওসমান রা:-এর খেলাফতকালে কুরআন সংরক্ষণ
যখন ইসলামের বিজয় ব্যাপক হতে লাগল এবং বিভিন্ন দেশের অনারবগণ প্রচুর পরিমাণে মুসলমান হতে শুরু করল যাদের মাতৃভাষা আরবি না হওয়ার কারণে তারা আরবি হরফগুলো সাধারণত সহিহ শুদ্ধভাবে আদায় করতে পারত না। এ ছাড়াও খোদ আহলে আরবদের মধ্যে আঞ্চলিক ভাষা ভিন্ন ভিন্ন ছিল। এ ছাড়াও হজরত ওসমানের খেলাফতের সময় যখন আরমিনিয়া ও আজারবাইজান জয় হলো এবং শাম ও ইরাকের সৈনিকেরা একত্র হলো তখন তাদের মধ্যে হয়রান করার মতো কেরাত ভুল দেখা গেল এমনকি প্রত্যেকেই নিজের কেরাতকে সহিহ শুদ্ধ দাবি করার শুরু করল। তখন হজরত হুজাইফা রা: অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে হজরত ওসমান রা:-কে অবগত করলেন এবং এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ করলেন। হজরত যায়েদ ইবনে ছাবেত, আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, সাইদ ইবনে আছ এবং আবদুর রহমান ইবনে হারেছকে পুনরায় কুরাইশের ভাষায় হাফছা রা:-এর কাছে সংরক্ষিত কপির অনুরূপ একাধিক কপি লিপিবদ্ধ করার আদেশ দিলেন। কপিগুলোকে যথাক্রমে মক্কা, মদিনা, শাম, বসরা এবং কুফায় প্রেরণ করলেন। পরিশেষে এক কপি হজরত ওসমান রা: নিজের কাছে রাখলেন।

লেখক : ইমাম ও খতিব উত্তর কাউন্নারা সওদাগর পাড়া জামে মসজিদ : উস্তাজুল বুখারী (২য়), জামিয়া জয়নব বিন্তে জাহাশ রা: মাদ্রাসা, সাটুরিয়া, মানিকগঞ্জ।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us