চীন-ভারত দ্বন্দ্ব এবং বাংলাদেশ

মাসুম খলিলী | Oct 20, 2020 05:59 pm
চীন-ভারত দ্বন্দ্ব এবং বাংলাদেশ

চীন-ভারত দ্বন্দ্ব এবং বাংলাদেশ - ছবি সংগৃহীত

 

চীন-ভারত দ্বন্দ্ব দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশেরই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ডিনামিক্স বা গতিময়তায় পরিবর্তন এনেছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র কৌশলে। ২০০৭ সালের বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, ২০০৮ সালের নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার গঠন- এসবে প্রতিবেশী ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। এরপর ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা প্রতিবেশী ভারত পালন করেছে বলে ধারণা করা হয়। এই নির্বাচনের পর সরকারের সাথে চীনের বিশেষ সম্পৃক্ততা লক্ষ করা যায়। আর ২০১৮ সালের অদ্ভুত ধরনের নির্বাচনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মনে করা হয় চীনকে।

এর মধ্যে বাংলাদেশে চীন ব্যাপক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরি করে। শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরকালে এ দেশে ২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব করেন। পরবর্তীকালে আরো বিভিন্ন প্রকল্পে চীনা বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়া হয়, যার মধ্যে তিস্তার পানি রিজার্ভার প্রকল্পও রয়েছে।

২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে চীনের সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং একই সাথে সরকারের রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায় থাকার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনে ঢাকা ক্রমেই বেইজিংয়ের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে তোলে। প্রাথমিকভাবে বলা হচ্ছিল, বাংলাদেশের কৌশলগত সম্পর্ক থাকবে ভারতের সাথে আর অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি হবে চীনের সাথে। কিন্তু সাবমেরিন কেনা ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা খাতে চীন নির্ভরতা বজায় রাখার ফলে এ ব্যাপারে সন্দেহ হয় দিল্লির। আর এশিয়ায় ভারতের প্রধান মিত্র হিসেবে এই সমীকরণে যুক্ত হয়ে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও।

বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র কৌশল নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে, ঢাকা বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সাথে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক তৈরি ও বজায় রাখতে আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে ঢাকা আগাগোড়াই সহযোগিতা দিয়ে এসেছে। ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ ও অংশীদারিত্ব সৃষ্টি এবং ট্রানজিট করিডোর বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেয়ার মধ্য দিয়ে কৌশলগত দিকে অবিরামভাবে দিল্লিকে উদার সহযোগিতা দিয়ে এসেছে ঢাকা। আর পদ্মা সেতু কর্ণফুলী টানেল থেকে শুরু করে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে চীনকে সংযুক্ত করেছে। এর পাশাপাশি রাশিয়াকে জ্বালানি খাতের বড় বড় কাজ প্রদান বিশেষত রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প দিয়ে বিশেষ এক ধরনের সম্পর্ক তৈরি করে রাখা হয়েছে। একই সাথে জাপানের সাথেও অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রেখেছে ঢাকা। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি-আমিরাত বলয় ও তুরস্ক-কাতারের সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক বজায় রেখেছে ঢাকা। আমিরাতের মাধ্যমে ইসরাইলের সাথেও এক ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

চীনবিরোধী ইন্দো-আমেরিকান সঙ্ঘাত যতই তীব্র হয়ে উঠছে ততই বাংলাদেশ পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ বজায় রাখতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন হলো কোনো বিশেষ বলয়ে থেকে নিজস্ব অর্থনৈতিক ও অন্য কোনো স্বার্থের কারণে অন্য দেশের সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক বজায় রাখার সুযোগ। এ কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের সুবাদে ভারত আমেরিকান বলয়ে প্রবেশ করার পরও রাশিয়া থেকে বিভিন্ন সমরাস্ত্র সংগ্রহ করে চলেছে। ভারতের সাথে কৌশলগত মৈত্রী বজায় রেখেই চীনের সাথে অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে বলে ধারণা করেছিল বাংলাদেশ । এখন মনে হচ্ছে এ ব্যাপারে ইন্দো-মার্কিন বলয়ের তীব্র চাপের মধ্যে রয়েছে ঢাকা। মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগানের অতি সাম্প্রতিক ঢাকা সফরে এ বিষয়টি প্রবলভাবে সামনে চলে এসেছে। এ সময় কয়েকটি ইস্যু সামনে চলে আসে।

প্রথমত, করোনা উত্তর অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলা ও বৃহৎ প্রকল্প অর্থায়নে চীনের সম্পৃক্ততা কমিয়ে আনা। আর এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক গ্রুপ, জাপান, আমিরাত-সৌদি বলয় ও অন্যান্য সূত্র থেকে অর্থের সংস্থান করা।

দ্বিতীয়ত, ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় জোট কোয়াডে যোগ দিয়ে এশিয়ায় মার্কিন-ভারতের নেতৃত্বাধীন উদ্যোগে কৌশলগত অংশীদার হওয়া।

তৃতীয়ত, আমিরাত বাহরাইনের মতো সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলো ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলে বাংলাদেশেরও বিষয়টিকে বিবেচনার মধ্যে রাখা।

চতুর্থত, রোহিঙ্গা ইস্যুতে কৌশল নির্ধারণে ইন্দো-আমেরিকা বলয়ের সাথে সমন্বয় বজায় রাখা।
বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত কৌশলগতভাবে কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তা বলা কঠিন। তবে পণ্য রফতানি বাজার, রেমিট্যান্সের উৎসগুলো এবং বহুপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার ওপর আমেরিকান বলয়ের নিয়ন্ত্রণ থাকায় এ বিষয়টি বাংলাদেশকে বিবেচনায় রাখতে হবে। কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের কোনো কিছু ইন্দো-আমেরিকা বলয়ের অনুমোদনের বাইরে বাংলাদেশ করতে চাইলে স্বার্থ সঙ্ঘাত অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।

এক সময় বাংলাদেশ নিজেই এপাচি হেলিকপ্টারসহ কিছু উন্নত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে প্রস্তাব দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। কিন্তু সেটি কার্যকর করার জন্য দুটি প্রতিরক্ষা ক্রয় চুক্তি সম্পাদন করার বিষয় সামনে এলে সেটি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে না করে দেয়া হয়। ফলে এর আওতায় ৩০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা সামগ্রী অনুদান হিসাবে দেয়া যেটি পরে ১ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পৌঁছার সম্ভাবনা ছিল সেটি বাতিল হয়ে যায়।
এবারের মার্কিন পররাষ্ট্র উপ মন্ত্রীর সফরকালে ঠান্ডা বরফ গলেছে এমন কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। এসময় ঢাকাকে বলা হয়েছিল চার দশকের বেশি সময় ধরে যে দেশটি সব ধরনের সহযোগিতা নিয়ে পাশে ছিল সেই দেশটিকে বেছে নিবে নাকি এক ধনী ব্যাংকারকে পছন্দ করবে বাংলাদেশ? ওয়াশিংটন সন্তোষজনক কোন সাড়া পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।

আর সেটি হলে ঢাকার ওপর চাপ তৈরি করতে মার্কিন বলয়ের হাতে যেসব টুলস রয়েছে তা ব্যবহার হতে পারে। এর প্রভাব ইউরোপ আমেরিকার বাজার সুবিধা, রোহিঙ্গা সমস্যায় সমর্থন প্রদান, বহুপক্ষীয় সংস্থা সমূহের আর্থিক সহায়তা লাভ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। ওয়াশিংটনের সম্পৃক্ত হবার বিষয়টি সরকার থেকে অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতেও বিস্তৃত হতে পারে। যার মধ্যে শাসন পরিবর্তনের বিষয় থাকাটাও অসম্ভব নয়।
অন্য দিকে চীনও দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে নানা প্রভাবক টুলসের অধিকারী। বৈশ্বিকভাবে সবচেয়ে অধিক অঙ্কের বিনিয়োগ সক্ষমতা রয়েছে এককভাবে চীনের। দেশটি বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারও। সেই সাথে রোহিঙ্গা সঙ্কট যে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সাথে যুক্ত সে দেশের ওপর এখনো চীনা প্রভাব এককভাবে সক্রিয়। বাংলাদেশের ১৯৭৫ উত্তর নিরাপত্তা ডকট্রিন আবর্তিত হয়েছে প্রধানত চীনা সমরাস্ত্র ঘিরে। এ সরকার সেখান থেকে সরে এসেছে এমনটি এখনো মনে হচ্ছে না। এ ছাড়া বাংলাদেশে ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকার যেসব ভরকেন্দ্র রয়েছে তার ওপরও চীনা প্রভাব কম নয়।

সব কিছু মিলিয়ে চীন-আমেরিকা বৈশ্বিক সঙ্ঘাত এবং ভারত-চীন দক্ষিণ এশীয় সঙ্ঘাত বাংলাদেশকে এক ধরনের কৌশলগত ডিলেমার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কোনো একক গন্তব্যে যুক্ত হওয়া যেমন ঝুঁকিপূর্ণ তেমনিভাবে না হওয়াও সরকার বা রাষ্ট্রের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে। কোন দিকে যাবে বাংলাদেশ?

mrkmmb@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us