বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন : ভারতীয়দের দাবি যেভাবে মিথ্যা প্রমাণিত হলো

শোয়াইব দানিয়েল | Oct 26, 2020 08:15 am
বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন : ভারতীয়দের দাবি যেভাবে মিথ্যা প্রমাণিত হলো

বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন : ভারতীয়দের দাবি যেভাবে মিথ্যা প্রমাণিত হলো - ছবি : সংগৃহীত

 

পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশ থেকে (এবং এর আগে পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গ প্রদেশ) অভিবাসনের ভীতি আসামের রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে। একে যৌক্তিক করতে বাংলাদেশী অভিবাসীদের সংখ্যা বিপুলভাবে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হতো ভারতের সরকারি ক্ষেত্রে।

গত ১৯৯৭ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দ্রজিত গুপ্ত পার্লামেন্টে বলেছিলেন যে ভারতে এক কোটি অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী বাস করছে। ২০১৬ সালে মোদি সরকার পার্লামেন্টে ঘোষণা করে, দুই কোটির মতো বাংলাদেশী অবৈধভাবে ভারতে বসবাস করছে (সংখ্যাটির অর্থ হলো ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২ ভাগ আসলে বাংলাদেশী)।

এই ইস্যুতে স্থানীয় ভাবাবেগের তীব্র সঞ্চালক ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ধরে নেয় যে অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা কোটি কোটি হবে এবং তা কার্যত আসাম রাজ্যের প্রতি একটি আগ্রাসন।
এই স্থানীয়দের প্রতি ভাবাবেগের একটি অংশ হলো জাতিগত। আসামীয় জাতীয়তাবাদীরা বাংলাদেশ থেকে হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধরনের অভিবাসনের বিরোধী। এই আবেগের আরেকটি অংশ হলো সাম্প্রদায়িক। বিজেপির মতো হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলগুলো একে মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি হিসেবে প্রদর্শন করছে।
এর সাথে যোগ হচ্ছে প্যান-ভারতীয় এই ধারণা যে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ অনেক গরিব এবং এর ফলে কাজের সন্ধানে বাংলাদেশীরা সীমান্ত অতিক্রম করে।

এই রাজনীতির ফলেই সুপ্রিম কোর্ট ২০১৪ সালে নির্দেশ দেয় যে আসাম রাজ্যের জন্য নাগরিক নিবন্ধন তথা খাঁটি ভারতীয় নাগরিকদের তালিকা তৈরী করতে হবে। এতে কয়েক প্রজন্মের পুরনো যেসব দলিল-দস্তাবেজ ব্যবহৃত হয়েছে, তা বিশ্বের অন্য কোথাও ব্যবহার করা হয় না।
মিথ-খণ্ডনকারী এনআরসি
অবৈধ অভিবাসী ব্যাপক সংখ্যায় আছে, এমন ধারণা নিয়ে এনআরসি হালনাগাদ করার পর ২০১৯ সালে এর চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এতে ওই ধারণা কোনোভাবেই প্রমাণিত হয়নি। ভারতীয় নাগরিক নয়, এমন সংখ্যা পাওয়া যায় প্রায় ১৯ লাখ। ২০১৬ সালে মোদি সরকার যে হিসাব দিয়েছিল, এই সংখ্যাটি তার চেয়ে ১০ গুণেরও বেশি কম।

কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যকার এই ব্যবধান আসামে দুঃখবোধের সৃষ্টি করে।অল আসাম স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য স্বীকার করেন, ১৯ লাখ বাদ পড়ার তথ্যটি দেখে আমরা হতাশ হয়েছি। আগে অবৈধ অভিবাসীর যে সংখ্যাটি বলা হয়েছিল, এটি তার ধারেকাছেও নেই।
এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা দীর্ঘ দিনের আরেকটি মিথও ভেঙে দিয়েছে। সেটি হলো বাংলাদেশ থেকে মুসলিমদের ব্যাপক হারে অভিবাসন। সরকারিভাবে ধর্মীয় হিসাব প্রকাশ করা না হলেও (তা কোনোকালে করা হবেও না) আসাম বিজেপির এক সিনিয়র নেতা বলেছেন, বাস্তবে মুসলিমরা নয়, বাঙালি হিন্দুরাই আসামের এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা থেকে বেশি বাদ পড়েছে।

এর ফলে এনআরসির প্রবল সমর্থক থেকে বিজেপি রাতারাতি এর প্রবল বিরোধীতে পরিণত হয়, এমনকি চূড়ান্ত তালিকা আবার যাচাই করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন পর্যন্ত করে। মুদ্রার অপর পিঠ হলো, আসামের বাঙালি-বংশোদ্ভূত মুসলিমরা ব্যাপক হারে বর্তমান এনআরসি সমর্থন করছে এবং প্রক্রিয়াটি বাতিলের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছে।
অভিবাসন নিয়ে কল্পনা ও বাস্তবতার এই বিপুল ব্যবধানের ব্যাখ্যা কী হতে পারে?

বাংলাদেশের উত্থান
এর একটি জবাব সম্ভবত নিহিত রয়েছে ১৩ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) একটি অর্থনৈতিক প্রক্ষেপণে। এতে দেখানো হয়েছে, ২০২০ সালে ভারতের মাথাপিছু অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাংলাদেশের চেয়ে কম হবে। অন্য কথায় বলা যায়, বাংলাদেশীরা শিগগিরই ভারতীয়দের চেয়ে গড়ে ধনী (সামান্য) হবে।

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যদি এটিই তুলনা হয়, তবে আসামের ক্ষেত্রে কী হতে পারে তা বের করা কঠিন কিছু নয়। কারণ এটি হলো ভারতের সবচেয়ে গরিব রাজ্যগুলোর একটি। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি আসামের চেয়ে ১.৫ গুণ বেশি। অধিকন্তু, ১৯৭১ সাল থেকেই, যে বছর বাংলাদেশ স্বাধীন হয় এবং এনআরসির হিসাব শুরুর বছর, তা অনেক বেশি।
বিভিন্ন সূচক ব্যবহার করে জীবনযাত্রার মানও তুলনা করা যায়। আসামের লোকজনের চেয়ে বাংলাদেশের গড় আয়ু এক দশকেরও বেশি। আসামের শিশু মৃত্যু হার ৪১, বাংলাদেশে ২৬। বাংলাদেশে মাতৃকালীন মৃত্যু হার ১৭৩, আসামে ২১৫।

ফলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অর্থনৈতিক কারণে অভিবাসনের যে হিসাবটি দেযা হয়েছিল, তা এনআরসিতে পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশে ধর্মীয় নির্যাতন

১৯৭০ সালের ২০ ভাগ হিন্দু বর্তমানে অর্ধেকের কমে ৮ ভাগে নেমে এসেছে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাসগুপ্ত বলেন, বাংলাদেশ থেকে বারতে ব্যাপক গণঅভিবাসনের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা হলো ধর্মীয় নির্যাতন।

আর এ কারণেই সীমান্ত-সংলগ্ন আসামের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তিনটি জেলায় এনআরসি তালিকা থেকে তুলনামূলকভাবে কম লোক বাদ পড়েছে, অথচ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতাপূর্ণ চাচার জেলায় বাদ পড়া হার বেশি।

বিরূপ রাজনীতি
অভিবাসীদের টার্গেট করা স্থানীয় ভাবাবেগকেন্দ্রিক রাজনীতিতে নিয়মিতভাবেই যুক্তরাষ্ট্র বা গ্রেট ব্রিটেনের মতো ধনী, উন্নত পাশ্চাত্য দেশের মতো করে তুলে ধরা হয।অথচ আয়ের দিক থেকে ভারত অনেক গরিব। আসামের রাজনীতির ক্ষেত্রে বিষয়টি আরো প্রবলভাবে প্রযোজ্য।

চূড়ান্ত এনআরসি তথ্য বিজেপিকে একটি উত্তেজনাকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। দলটি এখন চূড়ান্ত তালিকা বাতিলের দাবি জানাচ্ছে। আর ভারতের মতোই ধনী বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের পক্ষে অর্থনৈতিক উদ্বাস্তু ভাষ্যটি গেলানো কঠিনই হবে।

স্ক্রল.ইন

 

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us