ভারতের সমালোচনা অনেকের মুখে কি বেমানান?

মো: ইখতিয়ার উদ্দিন রিবা | Nov 01, 2020 06:54 pm
মওলানা ভাসানী

মওলানা ভাসানী - ছবি সংগৃহীত

 

১৯৭১ সালে আমরা চেয়েছি দেশের স্বাধীনতা। সম্পদের সমবণ্টন এড়াতে তখন স্বেচ্ছায় তা না দিয়ে পাকিস্তান করেছে কৌশলী অভিনয় আর ভারত তার আদি ও পূর্ব-পরিকল্পনা করেছে কৌশলী অভিনয় আর ভারত তার আদি ও পূর্ব-পরিকল্পনা মতে চেয়েছে যেকোনো মূল্যে আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন, নয়তো স্বাধীন করাতে। ভারত সরকারের Bangladesh documents, Vol-2, Page-224 মতে- ‘ভারতীয় সেনা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ শুরু করায় ৪ ডিসেম্বর লন্ডনস্থ দ্য ডেইলি মিরর পত্রিকায় জন পিলগার প্রথম আক্রমণকারী বলে ভারতকে অভিযুক্ত করেন। প্রতি-উত্তরে ওই দিনই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, If any country thinks that by calling us aggressor it can press us to forget our national interest, then that country is living in its own fool’s paradise.’ (যদি কোনো দেশ আমাদেরকে প্রথম আক্রমণকারী বলে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ভুলানোর জন্য চাপ দেয় তবে সে দেশ তারই বোকার স্বর্গে বাস করছে)।

এর দু-দিন পরে ৬ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ায় তখন সিপিএম দলীয় সংসদ সদস্য জ্যোতিবসু বলেন, ‘দিনটি ’৪৭ হতে এ পর্যন্ত দিনগুলোর মধ্যকার একটা ছিল। জনসঙ্ঘ দলীয় সংসদ সদস্য পীতাম্বর দাস বলেন, ‘বিরল ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ’। পরিণামে ঘটিত যুদ্ধে দুই হাজার ৩০৭ সেনা নিহত, দুই হাজার ১৬৩ জন নিখোঁজ, ছয় হাজার ১৬৩ জন আহত, ৪৫ যুদ্ধবিমান, ৭৩ ট্যাংক ও একটি যুদ্ধজাহাজ হারাতে হয়েছে ভারতকে (পাঞ্জাবের গুরুনানক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. এস এম বিন্দ্রার INDO-PAK Relations বইয়ের ১৭৮ পৃষ্ঠায় Asiatic Recorder থেকে উদ্ধৃত।

মরহুম মওলানা ভাসানীও তখন তার আশ্রয় নেয়া ভারতের এই কর্মতৎপরতার সমর্থন করেছেন। কিন্তু, স্বাধীনতার পর তিনিই ভারতবিরোধী অবস্থান নেন। পূর্বোল্লিখিত লেখকের Indo-Bangladesh Relations বইয়ের ২৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- ‘A cartoon of Moulana Bhashani standing naked but refusing to accept clothes supplied by Marwarris had appeared in one of the Calcutta newspapers. The same newspaper in an editorial called Bhashani ‘Badmash. (দাঁড়ানো অবস্থায় উলঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও ভাসানী মাড়োয়ারিদের সরবরাহ করা কাপড় প্রত্যাখান করছেন বলে কার্টুন ছাপা হয়েছে কলকাতাস্থ এক বাংলা সংবাদপত্রে, যার সম্পাদকীয়তে তাকে ‘বদমাশ’ বলা হয়েছে।)

ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীও ভারতের এহেন ভূমিকাকে স্বাধীনতার অবদান বিবেচনায় এর প্রশংসাকারী ও সমর্থক। স্বয়ং তিনি ভারতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। গত ৯ আগস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ভাসানী অনুসারী পরিষদের মানববন্ধনে ভারতের সাথে তার দূষিত রক্তের সম্পর্ক’ বলে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বলা রক্তের সম্পর্কের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছেন। গত ২৬ জুলাই প্রধানমন্ত্রীকে লেখা, তিনি তার খোলা চিঠিতে নিজেকে ৪৯ বছর পরে এক বোকা মুক্তিযোদ্ধা বলা যদি আজ ভারতের সমালোচনা করা তার নৈতিক অধিকার হয়, তবে অবশ্যই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার প্রশ্ন এড়ানো যায় না। কারণ স্বার্থ উদ্ধারের বিনিময় পরবর্তী সময়ে উদ্ধারকারীর স্বার্থ হারানোর অভিযোগের জন্য অপবাদের দায়ভার সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকদের হলেও গোটা জাতিকে তা সইতে হয়।

পূর্বোল্লিখিত বইয়ের ১২ পৃষ্ঠায় এমন অপবাদের কথাই বলা হয়েছে, ‘Bengalis are emotional, sentimental and negative in their behaviour. They always wanted a seapegoat for their own follies. during Pakistani rule they blamed West Pakistan for all the misfortunes and miseries. And after that they started using India as a tool in order to fulfill their desires,’ (বাঙালিরা আবেগ প্রবণ ও ভাবপ্রবণ এবং আচরণে নেতিবাচক। তারা সর্বদাই নিজেদের বোকামির দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে চায়। পাকিস্তানি শাসনামলে তারা তাদের দুর্ভাগ্য ও দুর্দশার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। এর পরে তারা ভারতকে ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে তাদের বাসনা পূরণের জন্য)। নিজের ভুলের বা অক্ষমতার দায়ে অন্যকে দোষারোপের প্রবণতা আমাদের বাস্তব জীবনেই পরিলক্ষিত।

তখন ভারতে না গিয়ে দেশে বসে মুক্তিযুদ্ধ করার মতো মানুষের সংখ্যাও কম ছিল না। এদের মধ্যে সর্বহারাপন্থীদের সম্পর্কে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার ‘লেগ্যাসি অব ব্লাড’ বইয়ের ৩৮ পৃষ্ঠায় বলেছেন- ‘Shikdar and his men used to observe 16 december, the anniversary of Bangladesh’s liberation as a ‘Black day’ because they resented heat they felt was a gift of independence by India.’ (শিকদার ও তার লোকজন বাংলাদেশে স্বাধীনতা বার্ষিকীর ১৬ ডিসেম্বরকে ‘কালদিবস’ বলে পালন করতে শুরু করেন। কারণ, স্বাধীনতাকে তারা ভারতের উপহার মনে করায় ক্ষুব্ধ)। ওই বইটির অনূদিত বাংলা ‘রক্তের ঋণ’-এর ৪৩ পৃষ্ঠায় এই তথ্যটি অনুল্লিখিত।

পরবর্তীতে ২৬ মার্চকে সরকারিভাবে স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করায় ‘সর্বহারাদের’ ওই দাবি বিস্তৃত হয়ে যায়। ১৮৯৮ সালে স্পেনের শাসন থেকে কিউবাকে মুক্ত করিয়ে আমেরিকার প্রভুত্ব ক্ষণস্থায়ী হলেও স্থায়িত্ব হয়তো সময়ের ব্যাপার। খাল কাটার মুখ্য উদ্দেশ্যে কলম্বিয়ার অধীন থেকে ১৯০৩ সালে সামরিক অভিযান চালিয়ে পানামাকে নামে স্বাধীন করলেও আজো সেটার তাঁবেদারিত্ব অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক কারণের বাস্তবতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় স্বাধীনতা প্রদানের আশ্বাসে তুরস্কের বিরুদ্ধে আরবদের উসকানি দেয় ব্রিটিশরা। এতে পরাজয়ের ফলে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বেশ কয়েকটি স্বাধীন আরব রাষ্ট্রের সৃষ্টি করা হয়।

এরপরও মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্যের ভাগাভাগিতে ‘ব্রিটিশ’ ও ফ্রান্সের মধ্যে করা এক গোপন চুক্তি মতে, ব্রিটিশ ম্যানডেটে ১৯২৩ সালে গোটা ফিলিস্তিনের ট্রান্স জর্দানকে আলাদা একটা স্বাধীন রাজকীয় রাষ্ট্র করা হয়। একই লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইহুদি রাষ্ট্র, যার ঐতিহাসিক ভিত্তি অবশ্যই অনস্বীকার্য। এটাই আরবদের বর্তমান বাস্তবতায় স্মরণে এসে যায়। তৃতীয় ক্রুসেড যুদ্ধে (১১৮৯-১১৯২ খ্রি.) বিজয়ী সালাউদ্দিন আইয়ুবিকে মিসরের প্রধানমন্ত্রী শাওয়ারের শিখানো সেই কথা- ‘Wealth without military power was worse than useless.’ সামরিক শক্তি ছাড়া ধনদৌলত নিষ্ফলের চেয়েও অধিক অকেজো)। ১৯২০ সালে ইরানের কাছ থেকে আজারবাইজানভুক্ত এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই লিথুনিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়াকে সোভিয়েট ইউনিয়নভুক্ত করা হয়েছিল। প্রতিবেশী কর্তৃক এক এক অংশ দখলের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত পোল্যান্ড ছিল ‘ইউরোপের অশ্রুফোঁটা। ১৯৬৮ সালে চেকোশ্লোভাকিয়ায় অভিযান চালায় রাশিয়া আর ১৯৫০ এ অভিযান চালিয়ে পরবর্তীতে তিব্বতকে ‘স্বায়ত্তশাসিত’ প্রদেশ করে নেয় চীন, যার রয়েছে ঐতিহাসিক ভিত্তি। ১৯৭৫ সালে সিকিমকে ভারতের সাথে যুক্ত করার নাটের গুরু ছিলেন সিকিম কংগ্রেস দলীয় নেতার বেলজিয়ান স্ত্রীর দত্তক পুত্র নরবাহাদুর খাতিওয়াদা, যাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলেছেন তখনকার ভারতীয় প্রতিনিধি।

এগুলো মাত্র কয়েকটি উদাহরণ। সাহায্য ও সহযোগিতার বিনিময়মূল্য আদায় বিশ্ব ইতিহাসের চলমান প্রক্রিয়া। ১৯৭১-এর আদৌ কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে কারো বিবেচনায় একান্তই ভুল হলেও তার কূটকৌশলী প্রতিকারই আজ শ্রেয়। তাই বলে প্রকাশ্যে ভারতের বিরোধিতা বা সমালোচনা অনেকেরই অকৃতজ্ঞতা এবং ’৭১-এ তার ব্যাপারে কারো কারো আশঙ্কার যেন বাস্তব প্রতিফলনের স্বীকৃতি।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us