লিবিয়ার নতুন সরকার কি শান্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ?
লিবিয়ার নতুন সরকার কি শান্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ? - ছবি : সংগৃহীত
গত ৫ ফেব্রুয়ারি জাতিসঙ্ঘের নেতৃত্বে গঠিত লিবিয়ান পলিটিক্যাল ডায়ালগ ফোরাম’ লিবিয়া পরিচালনার জন্য একটি তিন সদস্যবিশিষ্ট রাষ্ট্রপতির পরিষদ গঠনে ঐক্যমতে পৌঁছেছে। সংগঠনটির ৭৪ জন সদস্য ভোটের মাধ্যমে মোহামেদ আল-মনেফি রাষ্ট্রপতি ও আব্দেলহামিদ দবেইবাহকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেছে। তাদের দায়িত্ব একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করা এবং সেই সরকারের অধীনে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এই উদ্যোগ গত ১০ বছর ধরে চলমান লিবীয় সঙ্কটের পথ থেকে দেশটিকে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে পরিচালিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর তা বাস্তবায়নের জন্য লিবিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধের অবসান করা হবে – সাধারণ লিবীয়দের মনেও এমন আশাই বাসা বেঁধেছে। কিন্তু জনসাধারণের প্রত্যাশা বাস্তবতার সাথে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ, তাই এখন বিবেচ্য বিষয়।
১৯৫১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে লিবিয়া রাজা ইদ্রিসের খেয়ালখুশি মতো হতে থাকে। ১৯৫৯ সালে তেল আবিষ্কার হলে পশ্চিমাদের সহায়তায় ক্ষমতায় আসা এই শাসক তেলসমৃদ্ধ লিবিয়ার অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তুলে দেন বিদেশি কোম্পানীগুলোর হাতে। ইদ্রিসের আমলে লিবিয়া সংযুক্ত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে কেন্দ্রশাসিত রাষ্ট্রের প্রবর্তন করা হয়। ইদ্রিসের স্বৈরাচার ও পশ্চিমাতোষণ তাকে দ্রুত জনবিচ্ছিন্ন ও বিরাগভাজন করে তোলে। আরব দেশগুলোতে তখন বামপন্থী আরববাদের জয়জয়কার। এর শুরু হয়েছিল পাশের দেশ মিসরের জামাল আব্দেল নাসেরের হাতে। ১৯৬৯ সালে এক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। নাসেরকে নিজের রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা এই কর্নেল চাইতেন লিবিয়ায় এক সামজিক মহাবিপ্লব। নাসেরবাদী আরববাদে দীক্ষিত গাদ্দাফি খুব দ্রুত লিবিয়াকে সম্পূর্ণ বদলে দেন। আরব জাতীয়তাবাদ ও আরব সমাজতন্ত্রের আদর্শে এই নেতা এগিয়ে নেন দেশকে।
লিবিয়ার বিপুল তেলসম্পদসহ বেশির ভাগ শিল্প-ব্যবসায় জাতীয়করণ করা হয়। মার্কিন ও ইউরোপীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাতাতাড়ি গোটাতে বাধ্য করা হয়। ইতালীয় ও ইহুদিসহ বিদেশিদের ধীরে ধীরে লিবিয়া থেকে বিতাড়িত করা হয়। ১৯৭৩ সালে গাদ্দাফি লিবিয়ায় এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব’-এর ডাক দেন।
গাদ্দাফির অর্থনৈতিক সংস্কার লিবিয়ার লাখো দরিদ্র মানুষকে চাকরি ও অর্থনৈতিক সুবিধা লাভে সমর্থ করায় তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। কিন্তু উত্তর আফ্রিকার এক মরুময় ও জনবিরল এই দেশে এমন আমূল পরিবর্তন সহজ ছিল না। নিজের স্বপ্ন চরিতার্থ করতে কর্নেল গাদ্দাফি বিরোধীদের উপর সব ধরনের দমন-নিপীড়ন চালাতে দ্বিধা করেন নি। ফলে গাদ্দাফির লিবিয়া অচিরেই পরিণত হয় এক সামরিক একনায়কতন্ত্রে। গাদ্দাফি লিবিয়াকে নিজ অঞ্চলে অধিপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। বৈশ্বিক আরববাদের পতনের পর গাদ্দাফি বৈশ্বিক আফ্রিকানবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। সত্তরের দশকের শেষে গাদ্দাফি ভোল পাল্টে ইসলামী সমাজতন্ত্র তথা তৃতীয় আন্তর্জাতিক তত্ত্ব’ উপস্থান করেন। পাশাপাশি মার্কিন ও পশ্চিমা বিশ্বকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তাদের চক্ষুশূলে পরিণত হয় লিবিয়া। মার্কিন ও পশ্চিমাবিরোধী বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলার সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকার জন্য দায়ী করা হয় গাদ্দাফিকে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে লিবিয়ার উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়। তার জবাবে গাদ্দাফি মার্কিনবিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে লিবিয়ায় মার্কিন বোমবর্ষণ ও ১৯৮৮ সালে লকারবি বিমান হামলার পর লিবিয়ার সাথে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক সম্পূর্ণ ধসে পড়ে। একই সাথে ইসলামপন্থী সংগঠনগুলো এবং সরকার ও সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অসন্তোষধারী গোষ্ঠীগুলো গাদ্দাফির সশস্ত্র বিরোধিতা শুরু করে। অবশ্য এইসব সহিংসতা কঠের হস্তে দমন করা হয়। আশির দশকের মাঝামাঝি সমাজতান্ত্রিক-ধাঁচের অর্থনীতি আন্তর্জাতিক অবরোধের মুখে ভেঙে পড়লে গাদ্দাফি সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেন। নব্বইয়ের দশকের শেষে এসে গাদ্দাফি পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালু করেন। ইসলামী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ববে সহায়তা করা প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। বিদেশি রাষ্ট্র ও কোম্পানীগুলোর লিবিয়ায় বিনিয়োগের সুযোগ ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। গাদ্দাফির স্বৈরশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল লিবিয়ার মানুষ। তাদের মানবাধিকার চরমভাবে নিগৃহীত হয়েছিল বিয়াল্লিশ বছর ধরে। তাই ২০১১ সালে আরব বসন্তের শুরুতে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে স্বতস্ফূর্ত গণবিক্ষোভ শুরু হয়। গাদ্দাফির পুলিশ তা নির্মমভাবে দমন করা শুরু করে। এতে বিদ্রোহ পূর্ণ গৃহযু্দ্ধে রূপ নেয়।
বিদ্রোহীদের মধ্যে ছিল ইসলামপন্থী, সংস্কারপন্থী, উদারনৈতিক ও গাদ্দাফিবিরোধী বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী। কর্নেল গাদ্দাফি তার অনুগত সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও অন্য সশস্ত্র ব্যক্তিদের নিয়ে বিদ্রোহীদের দমন করা শুরু করেন। বিদ্রোহীদের সাহায্যে এগিয়ে আসে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্র। গাদ্দাফিকে সমর্থন দেয় রাশিয়া ও তার মিত্ররা। আট মাসব্যপী যুদ্ধ শেষে গাদ্দাফি সির্তে শহরে বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়েন এবং নির্মমভাবে নিহত হন। এতে কার্যত গৃহযুদ্ধ শেষ হয়।
কিন্তু গাদ্দাফিবিরোধী এই যুদ্ধ শেষে কে বা কারা লিবিয়া পরিচালনা করবে সে বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যায়। ফলে বিভিন্ন বিদ্রোহীদের সশস্ত্র সংগঠন একে অপরের সাথে সংঘাতে লিপ্ত থাকে। ২০১২ সালের নির্বাচনে জয়ী হয় ইসলামপন্থী দল জাস্টিস অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন পার্টি’। তাদের নেতৃত্বে গঠিত হয় প্রতিনিধি পরিষদ জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেস’ (জিএনসি)। কিন্তু অভিযোগ ওঠে জিএনএ দেশে শরিয়া প্রবর্তনের চেষ্টা চালাচ্ছে। ২০১৪ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা থাকলেও তা পালিত না হওয়ায় জিএনসির অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এমন গোলযোগ চলতে চলতে ২০১৪ সালে নির্বাচনে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয় সদ্য গঠিত সংসদ হাউস অব রিপ্রেসেন্টেটিভ’ (এইচওআর)-এর কাছে। কিন্তু সাংবিধানিক আদালতে এই নির্বাচন অসাংবিধানিক বলে ঘোষিত হয়। প্রতিপক্ষরা নতুন করে জিএনসিকে দেশ চালানোর অনুরোধ করে। কিন্তু এইচআরও নতুন জিএনসিকে মেনে নিতে অস্বীকার করে। শুরু হয় জিএনসি ও এইচওআরের মধ্যে লিবিয়ার কর্তৃত্ব নিয়ে টানাপোড়েন। অন্য দিকে এইচওআরের মিত্র যুদ্ধনেতা খলিফা হাফতারসহ নানা সংগঠন তাদের সহিংস কর্মকাণ্ড অব্যহত রাখে। হাফতার ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন।
ফলে নতুন করে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ২০১৫ সালে জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে সৃষ্ট ‘গভার্নমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড’ (জিএনএ) লিবিয়ার বৈধ সরকার হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। প্রথমে স্বাগত জানালেও ২০১৬ সালে এইচওআর জিএনএকে অস্বীকার করে। ফলে চলমান গৃহযুদ্ধ তবরুক-ভিত্তিক এইচওআর ও ত্রিপোলি-ভিত্তিক জিএনএ - এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন যুদ্ধ চলার পর গত ২৩ অক্টোবর এইচওআর ও জিএনএ জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে সাক্ষর করে। আর এর ফসল হল নবগঠিত রাষ্ট্রপতি পরিষদ।
কিন্তু এত কিছুর পর যুদ্ধ আসলেই শেষ হয়েছে - এমন দাবিটি প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষত লিবিয়াকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে কোনো সমঝোতা হয়নি। লিবিয়া প্রশ্নে প্রতিবেশি মিসর ও তুরস্ক সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে অবস্থান নিয়েছে। মিসরের সামরিক একনায়ক আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসি এবং তুরস্কের ইসলামপন্থী রাষ্ট্রপতি রজব তাইয়িব এরদোগান নিজ নিজ স্বার্থকে সামনে রেখে লিবিয়ায় নাক গলাচ্ছেন। এল-সিসি এইচওআরকে সমর্থন দিচ্ছেন নিজের গদি বাঁচাতে। লিবিয়ায় ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় এলে তার জন্য তা সুখকর হবে না। পাশাপাশি মিসরের আরব মিত্রদেশ জর্দান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সর্বোপরি সৌদি আরব এইচওআরকে সমর্থন দিচ্ছে। এর পাশে আরো আছে রাশিয়া, ইরাক, সিরিয়া ও ইরান। হাফতারের সমরবাদী স্বৈরাচারী মনোভাবকে পুঁজি করে তাকে ক্ষমতায় বসাতে চায় দু’পক্ষই।
অন্য দিকে তুরস্ক চায় ইসলামপন্থীদের জন্য জায়গা তৈরি করতে। পাশাপাশি ভূমধ্যসাগরের তেলগ্যাস নিয়ন্ত্রণের সুযোগটিও লোভনীয় এরদোগানের কাছে। আর জিএনসি সমর্থক ন্যাটো- বিশেষত ফ্রান্সও ভূমধ্যসাগর নিয়ন্ত্রণে উদ্বাহু হয়ে আছে। এতে তুরস্ক-ন্যাটো/ফ্রান্সের মধ্যে তুমুল মনমালিন্য চলছে। তুরস্ক, কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো এইচআর্ওকে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু হাফতারের ব্যাপারে তারা ততখানি একমত নয়। তুরস্ক-কাতার হাফতার ক্ষমতা আসার কট্টর বিরোধী। কিন্তু তারা আবার ইসলামপন্থীদের প্রতি নমনীয়। অন্যদিকে পশ্চিমারা চরম আইসিসবিরোধী। আইসিস লিবিয়ায় ঘাঁটি গাড়ার পর তাদের দমনে অভিযান চালায় মার্কিনীরা। আইসিস অবশ্য পুরোপুরি নির্মূল হয়নি। তাই ইসলামপন্থীদের পুনরুত্থানের বিষয়টিও এখনো বর্তমান।
এইসব জটিল বাস্তবতার সামনের দাঁড়িয়ে লিবিয়ায় শান্তির ক্ষণগণনা করা আশাব্যঞ্জক নয়। কিন্তু লিবিয়ার সাধারণ মানুষ গত ১০ বছর ধরে যুদ্ধের পর যে দুর্বিষহ জীবনযাপন করেছে, তা থেকে মুক্তির দাবি করতেই পারে। তবে সে দাবি পূরণ হবে কি না- সময়ই তা বলে দেবে।