আইসেনহাওয়ার পার্কে

ড. মাহবুব হাসান | Mar 20, 2021 05:23 pm
আইসেনহাওয়ার পার্ক

আইসেনহাওয়ার পার্ক - ছবি সংগৃহীত

 

৩১ অক্টোবর, ২০২০।
নিউ ইয়র্কের তাপমাত্রা নেমে এসেছিল হিমাঙ্কের কাছাকাছি। বাংলা মাসের হিসাবে সবে শারদীয় পূজা শেষ হলো। যদিও এখানে বাংলাদেশের মতো শরৎকালের মেঘের শাদা/কালো নাচ দেখতে পাইনি। এখানে গত চার দিন ধরে আকাশ গুমোট অবস্থায়। তবে ২৯-৩০ অক্টোবর, এই দুই দিন রিমঝিম অবিরল বৃষ্টি আমাদের দিয়েছিল ইলিশ মাছ ভাজা, গরুর গোশত আর খিচুড়ির স্বাদ নেয়ার ঘরোয়া পরিবেশ। এখানকার আবহাওয়া প্রচারকদের ভাষ্য কদাচ মিথ্যা হয়। ৩১ অক্টোবর, শনিবার মেঘশূন্য ঝকঝকে রোদের দিন রেখেছিল প্রকৃতি আমাদের জন্য। আমরা ঘুম থেকে জেগেই চনমনে একটি দিনের সাম্রাজ্যে ঢুকে পড়লাম।

আজ আমরা বেড়াতে যাবো লং আইল্যান্ডের আইসেনহাওয়ার পার্কে। এই পার্কে যাওয়ার জন্য ডানা ইসলাম আমাদের ইগনাইট করেছেন। পার্কের অনেক তথ্যই তিনি দিয়েছেন আমাদের হন্টন ক্লাবের গ্রুপে। আইসেনহাওয়ার বিশাল পার্ক। আমি কখনোই যাইনি, যাওয়ার সুযোগ হয়নি। এই লং আইল্যান্ডে যে কত পার্ক আছে জানতে পারছি একটু একটু করে, বেড়ানোর সুবাদে। এ দ্বীপ নিউ ইয়র্ক সিটির ৫ বোরোর বাইরে, যদিও জামাইক্যা থেকে লং আইল্যান্ডে যাওয়ার পথে কোনোবিচ্ছেদ চিহ্ন মেলে না। মানে বোঝাই যায় না যে, এটা সিটির বাইরে। দ্বীপটি দু’টি কাউন্টিতে ভাগ করা হয়েছে। কুইন্স-এর গা লাগোয়া নাসাউ কাউন্টি আর বাদবাকি অংশ নিয়ে সাফোক কাউন্টি। নিউ ইয়র্ক হারবার থেকে মনটাক পয়েন্টতক এর ব্যাপ্তি। লং আইল্যান্ড ১৯০ কিলোমিটার বা ১১৮ মাইল লম্বায়। নিউ ইয়র্কের পুবদিকে। আর পাশে গড়ে ১২ মাইল। ম্যাপে লং আইল্যান্ডকে দেখলে কেমন হাস্যকর মনে হয়। মনে হয়, কোনো শিল্পী তার তুলিতে একটা টানে দ্বীপটিকে বসিয়ে দিয়েছে।

কুইন্সের দিকে ও নাসাউ কাউন্টি ছাড়িয়ে অনেক দূরতক এ-দ্বীপের ব্যাস বেশ মোটাই মনে হয়। কিন্তু এর শীর্ষতক যেতে যেতে সরু হয়ে এসেছে। মনটাক পয়েন্টের স্ট্রাকচার দেখলেই মনে হয়, ঝড়ে কবে না তা ভেঙে যায়। এই বোধ জাগে ম্যাপ রিডিংয়ের সময়। বাস্তবে বোধহয় এতটা নাজুক নয় মনটাক পয়েন্ট। না-হলে সেপ্টেম্বরতক প্রতিদিন শত শত মানুষ বেড়াতে যেত না মনটাক পয়েন্টে।

ম্যাপে দেখলে মনে হয় ছোটো এই দ্বীপটি। আসলে কিন্তু তা নয়। আটলান্টিক উপকূলের এই দ্বীপের আয়তন এক হাজার ৪০১ বর্গমাইল। আমেরিকার ১১তম বড় দ্বীপ এটি। আর বিশ্বের বড় দ্বীপগুলোর মধ্যে এর অবস্থান ১৪৯তম। আমি তো এতদিন ভেবে এসেছিলাম লং আইল্যান্ডের আয়তন তেমন বড় নয়। কিন্তু এই দ্বীপের মাঝামাঝিতে অবস্থিত, ব্রুকহেভেনের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে যেতাম আমি প্যান্ডামিকের সূচনা থেকে। এল আই হাইওয়ের কখনো ৬৫ কখনো ৬৬ এক্সিট নিয়ে ঢুকতো আমাদের গাড়ি। ৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যেতাম হর্সব্লক রোডে। এক ঘণ্টা লাগতো কুইন্সের হিলসাইড থেকে হর্সব্লকে পৌঁছাতে। তখন বুঝেছি, যতটা ভাবতাম তত ছোটো নয় লং আইল্যান্ড। মনটাক পয়েন্টের কথা বলেছিল অনেকেই গল্পচ্ছলে। ভেবেছি, একদিন যাবো। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। ১১৮ মাইল গিয়ে সেখানকার পার্ক ও পিকনিক স্পটে সময় কাটিয়ে ফিরে আসাটা কষ্টকর। আর এখন তো তাপমাত্রা হিমাঙ্কের দিকে দ্রুতই নেমে যাচ্ছে। মনটাক পয়েন্ট তো আটলান্টিকের খোলা হওয়ার সাথে মিতালি করে বাস করছে, অবারিত হাওয়ায় সেখানে এমনিতেই থাকা যায় না। এটা ভেবেই আর ওই দিকে মন দিইনি।
আইসেনহাওয়ার পার্কটি ম্যানহাটানের সেন্ট্রাল পার্কের চেয়ে আকারে বড়। ৯৩০ একর জায়গা নিয়ে এটি গড়ে উঠেছে। এই পার্কের আগের নাম ছিল সালিসবেরি পার্ক। নাসাউ কাউন্টির ইস্ট মিডো আর হাম্পস্টিড টার্নপাইক হচ্ছে এর দক্ষিণের বর্ডার। ওল্ড কান্ট্রি রোড হচ্ছে উত্তরের সীমানা। এই পার্কে আছে একটি গল্ফ কোর্স, ইনক্লুডিং রেড কোর্স। এই পার্কেই বসে কমার্স ব্যাংক চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতা। এখানে আছে আমেরিকার বহুযুদ্ধে প্রাণদানকারীদের নামের স্মৃতিস্তম্ভ। আর বিশেষ করে ৯/১১-এ নাসাউ কাউন্টির নিহতদের স্মারক স্তম্ভ।
আমাকে বলা হয়েছিল, পান-সুপারি আর মুড়ি নিতে। কেন না বলনেওয়ালার স্টকে এর কোনোটাই নেই। আমি সেগুলো সংগ্রহ করে হিলসাইডেই অপেক্ষা করলাম। ১২টায় রওনা হওয়ার কথা থাকলেও সেটি হলো না। তাতে কোনো রকম ক্ষতি নেই। আজকে রোদ উঠেছে তাপমাত্রা ২/৩ ডিগ্রি হলেও উত্তরে বাতাস নেই। ফলে তীব্র নয় ঠাণ্ডা। বেশ আরামেই দাঁড়িয়েছিলাম কিং-কাবাব রেস্তোরাঁর সামনে। বলা উচিত মীম অ্যায়ারলেস নামের সেলফোন স্টোরের সামনে। এর মালিক প্রিয়ভাজন হিমু।

আমাকে তুলে নিয়ে জহিরের অডিসি ছুটল মনজু ভাইয়ের বাসার উদ্দেশে। তাদের উঠিয়ে নিউ ইয়র্কের জটিল স্ট্রিট ধরে জিপিএস নির্দেশনা মেনে আধা ঘণ্টার মধ্যেই চলে এলাম পার্কের ভেতরে। গাড়ি পার্কিংয়ের বেশ কয়েকটি জায়গা ছিল। ডানা আপা বলেছিলেন পার্কিং-৬-এ যেন গাড়ি রাখে। সেটিই করল জহির। সেটা এখানকার যে অসাধারণ লেক, তার পাশেই। নেমেই আমরা লেকের চারপাশের ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটতে গেলাম। তার আগে জহির খোঁজ নিলো ডানা আপার। তিনি জোহরের নামাজ পড়ে বেরুবেন।

লেকের চার দিকে হাঁটতে যাওয়ার সময়ই হাতের ডানে পড়ল প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ¢। লেকের একপাশে স্টেইনলেস স্টিলের অনেক লম্বা রড দিয়ে বানানো স্তম্ভ¢। রোদ পড়ে পুরো এলাকা এমন হাসছিল যে কি বলব! কয়েকটি ছবি তুলে দেখতে পেলাম লেকে ভাসমান হাঁসগুলোকে। তারা পারের দিকেই ছিল। তাকিয়েছিল আমাদের দিকেই। আরো অনেক লেক প্রদক্ষিণকারী মানুষ আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। কেউ বা জোরে হাঁটছিলেন, কেউ কেউ দৌড়াচ্ছিলেন। ঘামে তাদের টি-শার্ট ভিজে গেছে। স্বাস্থ্য উদ্ধারের কাজে অনেকেই আসেন এখানে। এমন খোলামেলায় কয়েক ঘণ্টা কাটানোর ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের উপকার যেমন হয়, তেমনই শরীরের মেদ ঝরিয়ে নিজেকে তরতাজা করেও তোলা যায়। সেটা মহানগরে বসবাসকারীরা বোঝেন। মূলত তারাই আসেন। নাসাউ কাউন্টির বাসিন্দারা। অন্য কাউন্টি বা কুইন্স বা সিটি থেকে যারা আসেন তাদের জন্য কিছুটা কড়াকড়ি আছে। নাসাউয়ের বাসিন্দার আইডি বা রেজিস্ট্রেশন থাকলে যদি জিজ্ঞাসিত হয়, তাহলে উত্তর দেয়া সহজ। আমাদের জন্য সে-রকম রক্ষাকবচ আসছেন, শিরিন আপা, ডানার বড় বোন এবং আমাদের নজরুল একাডেমির এক্সিকিউটিভ সদস্য। তিনি ইস্ট মিডওয়ের বাসিন্দা। ডানা থাকেন সাফোকে।

আমরা লেকের চারপাশে চক্কর মারা শেষ করে ওপরের দিকে উঠে গেলাম। এদিকে বসার জন্য বড় বেঞ্চ নেই। পার্কিং ৬-এ এলাম। কারণ এখানেই আছে কাছাকাছি রেস্টরুম। আছে অনেক বেঞ্চ ও টেবিল, একসাথে লাগানো। তারই দুটোতে, রোদ পিঠে নিয়ে বসলাম আমরা। কে যে চানাবুট তৈরি করে এনেছেন জানি না। মনজু ভাইকে সেই চানাবুটের বাটি খুলতে দেখে বুঝলাম সেটা মনিভাবীর কাজ। কাজী ফৌজিয়া তার বাটি খুলে বললেন, আজ কিন্তু গরুর গোশত শেষ করতে হবে। দেখে বললাম, এটুকু তো আমারই লাগবে, অন্যেরা খাবে কি? তিনি হাসতে হাসতে বললেন, কি করব বলেন, কোরবানির গোশত আর কতদিন রাখা যায়। জহির বললেন, আপনি তাহলে বেশি খান। আমি চানাবুট আর মুড়ি নিয়ে খাচ্ছিলাম। সেটা শেষ করে নিলাম আরেকটু মুড়ি, তার ওপর দু-টুকরো গরুর গোশত। মনি ভাবী প্যাগেটি করে এনেছিলেন। নভো আর সারাফকে প্যাগেটি দিলেন মুক্তি ভাবী। দেখাদেখি প্রায় সবাই যার যার বাটিতে তুলে নিলেন প্যাগেটি। আমিও নিলাম। না, তাতেও ক্ষুধা মেটেনি আমার। সকালবেলায় একটা সেদ্ধ ডিম খেয়েছি। আমি আরেকটু মুড়ি আর চানাবুট নিলাম। আর নিলাম আরো দু-টুকরো গরুর গোশত। কাজী ফৌজিয়া বলল, আমি কিন্তু এনেছি পায়েস উইথ কালোজাম মিশানো ডেসার্ট। খেয়ে আমি চমৎকৃত। সেটা জানাতেই সবাই সেই পায়েস খেলেন। আমি ডায়াবেটিসের রোগী, লোভ সামলে নিলাম।

এ সময় ডানা ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন আমরা কোথায়। লোকেশন জেনে নিয়ে তিনি এলেন। তখনো খাওয়া চলছে। ডানা বললেন, তিনি ফাস্টিং করছেন। মানে রোজা। ২০০৬-এ তিনি হজ পালন করেছেন। সে থেকেই ধর্ম-রিচুয়ালের অনেক কিছু পালন করেন। তিনি নিয়ে এসেছেন সেদ্ধ ডিম। সেগুলো খেলেন অনেকেই। আমি কাগজের বাটি গার্বেজে ফেলে চা নিলাম। মুক্তি ভাবী চা এনেছেন। চা দিয়ে শেষ করলাম খাবার। খাওয়া সেরে আমরা পার্ক প্রদক্ষিণে বেরুলাম। প্রথমেই গেলাম গল্ফ কোর্সের দিকে। সেটা যে আজ বন্ধ জানা ছিল না আমাদের। এর মধ্যে ফোন এলো শিরিন আপার। তিনিও এসে যোগ দিলেন আমাদের সাথে। মনুমেন্টগুলো ভালোভাবে দেখা হয়নি। আমি আর মনজু ভাই গেলাম সবার আগে। দেখে চমৎকৃত হলাম। এবারই প্রথম টের পেলাম, এই সব যুদ্ধাস্ত্র বিনা মোটরে চলে। আবিষ্কারটা মনজু ভাইয়ের। তিনিই বললেন সব। ট্রিগারে আঙুলের চাপে যে হিট লাগে বুলেটের পেছনে, সেই আঘাতেই লক্ষ্যে ছুটে যায় গুলি এবং আঘাত হানে। মোটর বা বিদ্যুৎ ছাড়া এই যে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, এ নিয়ে আমরা কখনোই ভাবিনি। কিন্তু যারা বা যিনি বন্দুক, রাইফেল বা পিস্টল বা রিভলবার আবিষ্কার বা তৈরি করেছেন, তাদের স্যালুট জানাতে হয়। আজকের যুদ্ধাস্ত্র তো বিদ্যুৎ ছাড়া অচল। কম্পিটারাইজড যুদ্ধাস্ত্র তো পাওয়ারবিহীন হলে অচল। তখন তার আর মূল্য কি?

দুই বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভের পাশেই আছে কোরিয়ান যুদ্ধে প্রাণদাতাদের নামের খোদাই করা তালিকা। আবার ভিয়েতনামসহ অন্যান্য যুদ্ধে নিহতদের উদ্দেশেও একটি স্তম্ভ রচিত হয়েছে। এ-সবই বাগানের সবুজ ও নীল রঙের ল্যাভেন্ডার ফুলের সাথে সাজানো সোপানে। সবুজ পাতা আর গাঢ় নীল ফুলের এই মিলিত রূপ এই স্মৃতিস্তম্ভকে মনোরম করে তুলেছে।

ডানা ইসলাম চলে গেলেও শিরিন আপা আরো কিছুক্ষণ থাকলেন আমাদের সাথে। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে ডুব সাগরের দিকে। আমরাও ভাবলাম এবার ফেরা যাক। নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে কাজী জহির বললেন কবিতা পড়া যাক। আমি পড়ব না জানালাম। ফলে সেও উৎসাহ হারাল। অন্যরা নীরব। ফলে উঠবার তাগিদটাই পেলাম সবার মধ্যে।
শিরিন আপাকে নতুন করে চিনলেন কাজী ফৌজিয়া। আগে নাকি তারা ফোনে বহুবারই কথা বলেছেন। সেটা জানালেন ফৌজিয়া। এর মধ্যেই গাড়ির দিকে রওনা দিয়েছেন মুক্তিভাবী নভো আর সারাফকে নিয়ে। আমরাও তার পিছু নিই।

শিরিন আপাকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসি।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us