হেলেনা পর্ব দুই

রহমান মৃধা | Apr 08, 2021 03:56 pm
হেলেনা পর্ব দুই

হেলেনা পর্ব দুই - ছবি সংগৃহীত

 

রাতের আড্ডা শেষে জোসনা রাতে আমরা হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে ফিরে এলাম। রাত তখন শেষের পথে। ঘুম নেই চোখে। হোটেলের লবিতে বসে আছি দুজনে। গল্পের শেষ নেই। হেলেনা নানা বিষয়ে কথা বলতে বলতে একসময় বলল, তার মা-বাবা সুইডিশ। আমি নতুন করে অবাক হলাম! জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে তো তুমিও সুইডিশ? উত্তরে বলল, হ্যাঁ, তবে আমি সুইজারল্যান্ডের জুরিখে বসবাস করছি কয়েক বছর ধরে। আমার কৌতূহল একটু বেশি বেড়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, জুরিখে বসবাস করার কারণ কী?এতক্ষণে আমি রীতিমতো ইংরেজি ছেড়ে সুইডিশে কথা বলতে শুরু করলাম। হেলেনা সুইডিশ কলেজ শেষ করে জুরিখে মূলত চাকরির কারণে বসবাস করছে। গল্প বেশ জমে উঠেছে, হঠাৎ হেলেনা বলল, চলো দুটি টাওয়াল নিয়ে সাগর পাড়ের বালুতে যাই, সেখানে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে যাব, পরে রোদ যখন চড়া হবে, দেখবে ঘুম ভেঙে যাবে।

মনে মনে ভাবছি, মেয়েটির মাথায় হঠাৎ হঠাৎ এসব উদ্ভট আইডিয়া কোত্থেকে এসে হাজির হয়? গত দিন ভোর রাতে সাগরে গোসল, আজ আবার হোটেল ছেড়ে সাগর পাড়ে বালুতে ঘুমানো, আগামীকাল আবার কী বায়না করে বসে তাইবা কে জানে! এদিকে আমি নিজেও একা, তারপর এসেছি ছুটিতে। কী আছে জীবনে, সারাজীবন তো খাটেই ঘুমিয়েছি, এবার আটলান্টিক সাগরের পাড়ে সুন্দরী রমণীর সাথে এক সকাল কাটানোর অনুরোধ। বললাম চল যাই।

বলতেই ভীষণ খুশির সাথে লবি থেকে দুটি টাওয়াল নিয়ে আমার হাত নয়, এবার কোমর ধরে হাঁটতে শুরু করল। হেলেনার সাথে সময় পার করা এবং ঘুরাঘুরি করা, সব মিলে মনে হচ্ছে যেন সে অনেক দিনের চেনা। হৃদয়ে-হৃদয়ে চেনা। এ চেনা অনুভবের, এ অনুভব কেবলই অনুভব করা যায়, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। দুটি প্রায় অচেনা অজানা মানুষের হৃদয়ের বন্ধনের অনুভব।

তখনো অন্ধকার কাটেনি, পুবের আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। সাগরের পাড়ে টাওয়াল বিছিয়ে শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না। হঠাৎ গায়ের উপর গরম বালু পড়ছে, ঘুম ভেঙে গেল। চেয়ে দেখি, হেলেনা বালু দিয়ে আমার পুরো শরীর ঢেকে ফেলেছে। কী ব্যাপার কখন জেগেছ? বলল, বেশ কিছুক্ষণ। এতক্ষণে তোমার ঘুম দেখছি আর দেখছি তোমাকে। ভোরের নরম আলোয় তোমার শরীরটা দেখছি। প্রাণ ভরে দেখছি। নীরবে ঘুমিয়ে থাকা মানুষটাকে দেখার পর এবার বিরক্ত করে দেখতে চাই। বললাম তা এখন আমাকে কীভাবে বিরক্ত করে দেখতে চাও? উত্তরে বলল, অনেকভাবে বিরক্ত করতে চাই, যেমন খুশি তেমন করে বিরক্ত করতে চাই, বিরক্ত করতে করতে অস্থির করে তুলতে চাই। কিন্তু সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। বিরক্ত করার আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণই থেকে যাক। চলো হোটেলে ফিরে যাই।

দুজনে সাগর ছেড়ে হোটেলে ফিরে এলাম। লাঞ্চ সেরে নিলাম। তখন দুপুর একটা। আমাদের ভ্রমণের সময় শেষ, আজ রাতেই ফিরতে হবে যার যার দেশে। রুমে গিয়ে সব কিছু গুছিয়ে সন্ধ্যায় রওনা দিলাম এয়ারপোর্টের দিকে। বিদায় বেলা শুধু বলেছিল চিঠি দিও মোরে।

সুইডেনে ফিরে আসার পর মনে হলো 'Life is never be the same life is changing'. ক্যানেরি আইল্যান্ডের স্মৃতিগুলো মনের মাঝে সকাল, বিকেল ও সন্ধ্যায় বেশ নাড়া দিয়ে চলছে। কাজ শেষে বাসায় এসে স্মৃতিচারণ করি প্রতিদিনের ঘটনাগুলো। আমি কী কারো প্রেমে পড়েছি তাহলে? কয়েক দিন এভাবে কাটতে থাকে। আজ সকাল সকাল ঘুমোতে হবে। কাল জব ইন্টারভিউ নিতে হবে কয়েকজনের। আমার ডিপার্টমেন্টে দুজন কেমিস্ট নিয়োগ দিব।

সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজে এসেছি। যারা ইন্টারভিউ দিতে আসবে তাদের সিভি দেখছি। কফিরুমে গিয়ে সবাইকে হাই হ্যালো বলে বসে গেলাম ভাইবা বোর্ডে। ভাইবা শেষে যাকে মনোনীত করলাম, তার নাম মারিয়া। মারিয়া চাকরি পেয়েও নিজ থেকে না করল আমার ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে। একটু অবাক হলাম। তারপরও বুঝতে পারলাম কেন সে না করেছে। মারিয়া ফার্মাসিয়ার অ্যানালিটিক্যাল ডিপার্টমেন্টে কাজ নিয়েছে। আমি অন্য দু'জনকে আমার ডিপার্টমেন্টে কাজ দিয়েছি। সময় চলছে তার গতিতে, এর মাঝে প্রায় দু'মাস পার হয়ে গেছে আমার সাথে হেলেনার শেষ দেখা। এদিকে আমার কোম্পানিতে বড় পার্টি। বড় জাহাজ ভাড়া করেছি স্টকহোম ট্যু হেলসিংকি। আমাদের স্টকহোমের ইমপ্লাইমেন্টের সংখ্যা নয় শ'। পুরো জাহাজে শুধু ফার্মাসিয়ার ইমপ্লাই। রাতের ডিনার শেষে বিনোদনের পালা। নাচগান চলছে। এসময় বস বা কর্মীদের মধ্যে তেমন জড়তা থাকে না। সবাই বেশ মন খুলে মেলামেশা করার একটি ভালো সুযোগ পায়, যাকে আমরা বলে থাকি ‘টিম বিল্ডিং’।

হঠাৎ মারিয়া এসে পরিচয় দিল, আমি তাকে চিনতে পেরেছি কি? বললাম, হ্যাঁ চিনেছি, তুমি আমার ডিপার্টমেন্টে কাজ পেয়েও না করেছিলে। মারিয়াকে বেশ রিলাক্স মনে হলো, দিব্যি এ কথা সে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বলল, চলো একটু ডান্স করি। বেশ কিছুক্ষণ এক সঙ্গে নাচগান করার পর বেশ জড়িয়ে একটু হ্যাগ দিলো। বুঝতে সমস্যা হয়নি যে এ হ্যাগ সাধারণ হ্যাগ নয়, এর মধ্যে 'কিন্তু' আছে। আমি তার ম্যাসেজ বুঝতে পেরেছি। হঠাৎ গুড নাইট বলে সে তার রুমে চলে গেল, আমি তাকিয়ে রইলাম, আমার বলার কিছু ছিল না। আমিও কিছুক্ষণ পরে ঘুমতে গেলাম, সকালে উঠতে হবে। হেলসিংকিতে ল্যান্ড করলাম পরের দিন সকালে। সবাই বেশ মনের আনন্দে ঘুরছে, মজা করছে।

সারাদিন ঘুরাঘুরির পর ফিরে এলাম জাহাজে। রাতের ডিনার জাহাজে, ডিনার শেষে আবার পার্টি। মারিয়ার সঙ্গে বেশি সময় দিয়েছি, বেশ কাছের মানুষ বলে মনে হয়েছে। তারপরও কেন যেন ভাবনায় হেলেনার কথা আসছে, এটাই জীবন। কথায় বলে ‘show must go on.’ খুব দ্রুততার সাথে আমার সাথে মারিয়ার একটি ইন্টিমেট সম্পর্ক হতে চলেছে।

একদিন সন্ধ্যায় সিনেমা দেখার পর সুইডিশ ফিকায় (কফিশপে আড্ডা) মারিয়া তার পরিবার সম্পর্কে বলতে হঠাৎ বলল, তার এক বোনের মেয়ে থাকে সুইজারল্যান্ডে, নাম হেলেনা। মারিয়ার দুই বছরের ছোট হেলেনা, সম্পর্কে ভাগ্নি হলেও তাদের মধ্যের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো। আমি হঠাৎ থমকে গেলাম, কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে ভরাট গলায় বলে উঠলাম, 'হেলেনা'? সুইজারল্যান্ডের কোন শহরে? তোমার কাছে কি তার কোন ছবি আছে?

মারিয়া আমার কিউরিসিটি দেখে কোনোরকম সন্দেহ করেনি। বরং বেশ আগ্রহের সঙ্গে ওয়ালেট থেকে একটি ছবি বের করে দেখালো। ছবি দেখার পর মারিয়া আমাকে প্রশ্ন করল কী ব্যাপার তুমি হঠাৎ এমন আনমনা হয়ে গেলে কেন? কোনো সমস্যা? আমি কোনোরকম জড়তা ছাড়া মারিয়াকে ক্যানেরিয়ার পুরো ঘটনা তুলে ধরলাম। মারিয়া শুধু জিজ্ঞেস করল, আমাদের মধ্যে ইন্টিমেট কিছু ঘটেছে কি? বললাম, না, দৈহিক কিছু ঘটেনি, তবে অনুভবে হৃদয়ের মাঝে তাকে নিয়ে ভেবেছি। মারিয়া বলল, তার কী অবস্থা? উত্তরে বললাম, সেটা দেখা বা জানার সুযোগ হয়নি। হেলেনার বিষয় আর কোনো কথা হয়নি ওই দিন।

আমার সাথে বেশ কিছু দিন হলো হেলেনার কোনো যোগাযোগ নেই, মারিয়ার সঙ্গে পরিচয় হবার পর। হেলেনাও আর ফোন করে না। মনে মনে ভাবলাম, তাহলে মারিয়া কি হেলেনাকে আমার কথা বলেছে! যাই হোক আমি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। জিজ্ঞেস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিনি। দিন চলে যাচ্ছে। ডিসেম্বর মাস, খ্রিস্টমাসের ছুটি।

হঠাৎ মারিয়া বলল, চলো সুইজারল্যান্ড ঘুরে আসি। হেলেনার সাথে কয়েক দিন ঘুরব। আমার বুকের ভিতর একটু ধড়পড় শুরু হলো। কিছু না হলেও মনে মনে তো সে আমার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। কিভাবে এমন একটি ঘটনাকে ফেস করব! মারিয়া কী তাহলে সত্যের সন্ধানে আমাকে হেলেনার মুখামুখি করতে চায়, নাকি সত্যি বেড়ানোর জন্যই সেখানে যেতে চায়! সবকিছুর পর সান্ত্বনা একটাই- ছুটিতে একসাথে ঘুরেছি, মজা করেছি, প্রেমপ্রীতি মনে মনে হলেও তার বহিঃপ্রকাশ কেউ করিনি। সব ভেবেচিন্তে শেষে রাজি হয়ে গেলাম সুইজারল্যান্ডের জুরিখে যাবার জন্য।

এদিকে তিন-চার মাস হয়েছে হেলেনার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। জানি না কেমন আছে সে!-

আমি ও মারিয়া স্টকহোম আরল্যান্ডা এয়ারপোর্ট থেকে রওনা দিলাম, ডাইরেক্ট ফ্লাইট ট্যু জুরিখ। হেলেনা এয়ারপোর্টে আসবে আমাদের রিসিভ করতে। বুক ধড়পড় করছে, মাঝেমধ্যে উথাল পাথাল, জানি না কী অবস্থা হবে! শেয়ার করতেও পারছি না মারিয়ার সঙ্গে। স্কুলজীবনে বাংলা ব্যাকরণে এককথায় প্রকাশ পড়েছি, কী করিতে হবে তা বুঝতে না পারা- কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই জটিল শব্দটার বাস্তব অর্থ পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করলাম।

মারিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী বলেছ যে আমিও তোমার সাথে আসছি? মারিয়া উত্তরে বলল, না, তাকে সারপ্রাইজ দেব। হঠাৎ মনে হচ্ছে পৃথিবীটা সত্যি কত ছোট? পৃথিবীটা সত্যিই সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, সাথে ঘুরছে আমার মাথা। যাইহোক ল্যান্ড করলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি দাঁড়িয়ে আছে শান্ত হয়ে আমার মনের বুলবুলি। একদিকে অনেক বছর পর মারিয়ার সঙ্গে তার দেখা, তারপর আমি। বেচারা কী করবে, কী বলবে, কীভাবে বিষয়টি নেবে বুঝতে পারছে না। সে পুরোপুরি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হেলেনার এমন একটি মুহূর্তকে মারিয়া সহজ করে দিলো অল্প সময়ে। বলল, রহমান আমাকে বলেছে তোমার সাথে তার ক্যানেরিয়ায় দেখা হয়েছে। হেলেনা সাথে সাথে বলল, তা আমার সাথে তোমার সম্পর্ক তা কীভাবে রহমান জানল?

মারিয়া পরে সব ঘটনা বলল হেলেনাকে। কেন যেন মনে হয়েছিল হেলেনা আমাকে মারিয়ার মাঝে খুঁজে পেয়েছে এটাই ছিল তার মধ্যে এক আনন্দঘন সময়। দেশে থাকতে সিনেমা হলে ত্রিভুজ প্রেমের বাংলা ছবি দেখেছি। আর বিদেশে এসে নিজেই হয়ে গেলাম ওই ত্রিভুজ প্রেমের বাংলা ছবির বাস্তব নায়ক। আমি মারিয়ার সাথে সংসার করে চলছি সেই থেকে। আমাদের পরিচয়, পরিণয় সে আরেক বিশাল ঘটনা যা আমার একটি লেখা 'প্রেম করেছি বহুবার বিয়ে করেছি একবার' পড়লে জানা যাবে। জীবনে কাউকে মনে মনে ভালোবাসার পরও না পাওয়ার মাঝে যে আনন্দ থাকতে পারে তা বুঝতে পেরেছিলাম ওই দিন। সে এক নতুন দেশে, অনেক বছর আগের কথা। হেলেনা সেই আগের মতোই আছে। ফেসবুকে মাঝে মধ্যে কথা হয়।

হেলেনা বাংলা জানে না তবে তাকে বলেছি 'আমি তোমাকে নিয়ে লিখছি এত বছর পর। তোমার সেই পুরোন ছবিটি লেখায় ব্যবহারও করেছি।' ওই সব জেনেও সম্মতি দিয়েছে। জীবনে এমন অনেক ভালোবাসা রয়েছে যা মুকুলেই ঝরে যায়, তার পরও কেন যেন মনে হয় ভালোবাসার মধ্যে রয়েছে শুধু ভালোবাসা।

লেখক : সুইডেনপ্রবাসী, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার rahman.mridha@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us