বাসেম আওয়াদুল্লাহর মাধ্যমে জর্দানে কলকাঠি নেড়েছিল সৌদি আরব!

অন্য এক দিগন্ত | Apr 12, 2021 08:49 am
বাসেম আওয়াদুল্লাহ

বাসেম আওয়াদুল্লাহ - ছবি : সংগৃহীত

 

জর্দানে কথিত অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সাথে সৌদি আরবের জড়িত থাকার অভিযোগ জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন সৌদি কর্মকর্তারা।

এক সপ্তাহ আগে জর্দানের জনপ্রিয় সাবেক যুবরাজ ও বাদশাহ আব্দুল্লাহর সৎ ভাই প্রিন্স হামজাকে গৃহবন্দী করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা ভঙ্গ করার অভিযোগ আনা হয়।

প্রিন্স হামজার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয় যে তিনি বিভিন্ন গোত্রের নেতাদের সঙ্গে বেশ কিছু সভায় অংশ নিয়েছেন যেখানে তিনি তার সৎ ভাই বাদশাহ আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে খোলামেলা বক্তব্য দিয়ে তার সমালোচনা করেছেন।

সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় যে প্রিন্স হামজা সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গোত্রের নেতাদের দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলেন। এ ব্যাপারে অনেক দিন ধরেই তদন্ত চলছিল।

প্রিন্স হামজাকে গৃহবন্দী করার পাশাপাশি মোট ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয় - যার মধ্যে বাদশাহ আবদুল্লাহর একজন উপদেষ্টা এবং রাজপরিবারের একজন সদস্য আছেন।

উচ্চপর্যায়ের এসব লোকদের গ্রেফতার করার ঘটনাকে 'অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সাথে সম্পর্কিত' বলে উল্লেখ করা হয়।

প্রিন্স হামজার বক্তব্য
এর পর প্রিন্স হামজা বিবিসির কাছে দুটি ভিডিও পাঠিয়েছেন। ওই ভিডিওতে তিনি তার দেশের সরকারকে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অদক্ষ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে হয়রানির ভয়ে দেশের লোকজন এসব বিষয়ে কথা বলতে ভয় পায়।

প্রিন্স হামজা বলেন, গত ১৫-২০ বছরে প্রশাসন যেভাবে ভেঙে পড়েছে, সরকার কাঠামোয় যে অদক্ষতা ও দুর্নীতি দেখা গেছে তার জন্য তিনি দায়ী নন।

তিনি বলেন, 'জনগণ যে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে তার জন্যও আমি দায়ী নই।'

তিনি আরো বলেন, 'পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে কেউ কথা বলতে পারে না, নিগ্রহ-হুমকি-হয়রানি-গ্রেফতার শিকার না হয়ে কেউ কোন মত প্রকাশ করতে পারে না।'

ভিডিওতে প্রিন্স হামজা বলেন, দেশে এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে যেখানে কেউ সরকারের সমালোচনা করলেই গোপন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হবার আতঙ্কে থাকতে হয়।

বাদশাহ আব্দুল্লাহর এক চাচার মধ্যস্থতার পর এই সঙ্কট পরে আর খুব বেশি দূর গড়াতে পারেনি। তবে এই ঘটনার পেছনে সৌদি আরবের ভূমিকার বিষয়ে জল্পনা কল্পনা জোড়াল হতে থাকে।

সৌদি আরবের সমর্থন
সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে জর্দানের রাজধানী আম্মানে উড়ে যান। সৌদি আরবের কর্মকর্তারা বলেছেন, বাদশাহ আবদুল্লাহ ও তার সরকারের প্রতি পূর্ণ সংহতি জানানোর জন্য তাদের এই সফর।

সৌদি কর্মকর্তারা এও বলেছেন, এত ছোট একটি প্রতিবেশী দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টার সঙ্গে জড়িত থাকার ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেটা 'একবারেই অর্থহীন।'

তাহলে এই ঘটনায় সৌদি আরবের আসলেই কি ধরনের ভূমিকা থাকতে পারে?

সঙ্কট যখন চরমে ওঠে সেসময় জর্দানের কর্মকর্তারা জানান যে তাদের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো প্রিন্স হামজাসহ আরো বহু কর্মকর্তার কর্মকাণ্ডের ওপর কয়েকদিন ধরে নজর রাখছিল।

কারো নাম উল্লেখ না করে তারা রহস্যময় কিছু 'বিদেশি শক্তির' কথা বলে আসছিল যারা দেশটিতে ও রাজ পরিবারের ভেতর অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিল।

তবে প্রিন্স হামজা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনারের বিশ্লেষণ
নিরাপত্তাবিষয়ক বিবিসির সংবাদদাতা ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনার বলছেন, এখানে দুটি আলাদা বিষয় রয়েছে।

তিনি লিখেছেন, 'একটি বিষয় হচ্ছে প্রয়াত বাদশাহ হুসেইনের জনপ্রিয় জ্যেষ্ঠপুত্র প্রিন্স হামজা, সম্প্রতি যিনি বিভিন্ন গোত্রের ক্ষুব্ধ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে জর্দানের নিরাপত্তা প্রধানদের নাড়া দিয়েছেন। আর অন্য বিষয়টির সাথে বেশ কিছু কর্মকর্তা জড়িত যাদের বিরুদ্ধে অন্তত একটি বিদেশি শক্তির সাথে সম্পর্ক থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।'

এই সঙ্কটে যেসব সুপরিচিত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে একজন বাসেম আওয়াদুল্লাহ। তিনি জর্দানের রয়্যাল কোর্টের সাবেক প্রধান ও বর্তমানে তিনি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের একজন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।

জর্দান ও সৌদি আরব- দুটি দেশেরই নাগরিক তিনি। সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ফোরামেরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টে খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে এই বাসেম আওয়াদুল্লাহকে সাথে না নিয়ে সৌদি প্রতিনিধি দলটি জর্দান ছেড়ে যেতে রাজি হচ্ছিল না। তবে সৌদি কর্মকর্তারা এই খবরটিকে 'অসত্য' বলে মন্তব্য করেছেন।

বাসেম আয়াদুল্লাহর সঙ্গে বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক শক্তির যোগাযোগ রয়েছে। এছাড়াও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গেও তার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ এবং শাসকের সঙ্গেও তার ভালো সম্পর্ক। জেরুসালেমের আশেপাশে ফিলিস্তিনি ভূমি কিনে নেয়ার পেছনেও তার ভূমিকা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

বিবিসির সাংবাদিক ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনার বলছেন, সৌদি আরব ও জর্দানের মধ্যে অর্থনৈতিক দিক থেকে বড় ধরনের পার্থক্য থাকলেও, অনেক বিষয়ে তাদের মিল রয়েছে।

'এই দুটি দেশের মধ্যে কয়েক শতাব্দী ধরে চলছে গভীর ঐতিহাসিক সম্পর্ক। যৌথ মরু সীমান্তের ব্যাপারে রয়েছে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে যোগাযোগ।'

'আমি যখন দক্ষিণাঞ্চলীয় জর্দানে বনি হুয়াইতাত গোত্রের বেদুইনদের সঙ্গে বাস করেছি, আমি দেখেছি যে তারা প্রায়শই সৌদি আরবের ভেতরে ঘোরাঘুরি করে আবার জর্দানে ফিরে এসেছে। তাদের ভেড়া, ছাগল এবং উট চারণ করার সময় তারা বিভিন্ন পণ্য এবং খবর বিনিময় করতো,' তিনি লিখেছেন।

এক দশক আগে আরব দেশগুলোতে যে গণআন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল, যা আরব বসন্ত নামে পরিচিত, সুন্নি মুসলিম অধ্যুষিত ও শাসিত এই দুটি দেশের শাসকরাই তখন একে অপরের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন।

ফ্র্যাঙ্ক গার্ডনার বলছেন, জর্দানের ক্ষমতাধর দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র সৌদি আরব অথবা ইসরাইল, এরকম একটি ছোট ও তুলনামূলক দরিদ্র দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করবে- এর পেছনে যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন।

তিনি লিখেছেন, 'মরহুম বাদশাহ হুসেইন ও বর্তমানে তার ছেলে বাদশাহ আব্দুল্লাহর শাসনামলে জর্দানে হাশেমাইত রাজতন্ত্র মধ্যপ্রাচ্যের বহু রাজনৈতিক ঝড় সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে জর্দানের ভূমিকা
ইসরাইলের সাথে ১৯৯৪ সালে স্বাক্ষরিত একটি শান্তিচুক্তির প্রচণ্ড সমালোচনা হয়েছিল জর্দানে, কিন্তু এর ফলে কিছুটা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা তৈরি হয়।

জর্দানে প্রাকৃতিক সম্পদ খুব বেশি নেই। এছাড়াও ইরাক ও সিরিয়া থেকে যাওয়া প্রচুর সংখ্যক শরণার্থী সামাল দিতে গিয়েও দেশটিকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে জর্দানের পর্যটন শিল্পও আপাতত প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে যার প্রভাব পড়েছে দেশটির দুর্বল অর্থনীতির ওপর। সরকারের নানা অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভও বেড়েছে।

ওই অঞ্চলের সরকারগুলো বেশ ভালো করেই জানে যে জর্দানে রাজতন্ত্রের পতন ঘটলে তার বিপজ্জনক প্রভাব পড়বে আশেপাশের দেশগুলোতেও।

এর ফলে প্রতিবেশী দেশগুলো খুব দ্রুতই বাদশাহ আব্দুল্লাহর প্রতি সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছে।

দেশটিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে খুশি হবে আল কায়দা ও ইসলামিক স্টেট কারণ মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার পেছনে এই দেশটির স্থিতি অপরিহার্য।

কে এই প্রিন্স হামজা?
প্রিন্স হামজা হচ্ছেন প্রয়াত বাদশাহ হুসেইন ও তার প্রিয় স্ত্রী রানি নূরের সর্বজ্যেষ্ঠ পুত্র।

তিনি ব্রিটেনের হ্যারো স্কুল ও স্যান্ডহার্স্টের মিলিটারি একাডেমির গ্রাজুয়েট, এবং যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াশোনা করেছেন। কাজ করেছেন জর্ডানের সশস্ত্র বাহিনীতে।

তিনি বাদশাহ হুসেইনের প্রিয় পুত্র ছিলেন এবং ১৯৯৯ সালে তাকেই জর্ডানের যুবরাজ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।

কিন্তু বাদশাহ হুসেইনের মৃত্যুর পর তাকে উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করা হয়নি, কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল - তার বয়স অনেক কম, তিনি অনভিজ্ঞ।

ফলে তার পরিবর্তে তার সৎ ভাই আবদুল্লাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন, এবং তিনি ২০০৪ সালে প্রিন্স হামজার যুবরাজ খেতাব বাতিল করেন।

রানি নূরের জন্য এটি ছিল এক বড় আঘাত- কারণ তিনি আশা করেছিলেন যে তার ছেলেই একদিন রাজা হবেন।

সূত্র : বিবিসি


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us