মিথ্যা মামলায় ফেঁসে যাওয়া

সিরাজ প্রামাণিক | Jan 06, 2020 04:38 pm
মিথ্যা মামলায় ফেঁসে যাওয়া

মিথ্যা মামলায় ফেঁসে যাওয়া - ছবি : সংগ্রহ

 

সিরাজগঞ্জে ধর্ষণের মিথ্যা মামলা করায় এক নারীর পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। ২৮ নভেম্বর সিরাজগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক ফজলে খোদা মো. নাজির এ রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার সময় ওই নারী আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের ২৪ অক্টোবর কামারখন্দ উপজেলার এক নারী একই গ্রামের পাঁচজনের বিরুদ্ধে গণধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন। আদালতে গণধর্ষণের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। পরে তাদের একজন বাদি হয়ে ওই নারীর বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭ ধারায় মামলা করলে বিচার শেষে বিচারক ওই নারীকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, ২০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।

এ ধারায় বলা আছে, যদি কেউ ক্ষতি করার উদ্দেশে কারো বিরুদ্ধে এ আইনের অন্য কোনো ধারায় মামলা বা অভিযোগ করতে ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ না জেনেও মামলা বা অভিযোগ করেন বা করায় মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারী ব্যক্তি এবং যে অভিযোগ দায়ের করিয়েছেন, ওই ব্যক্তি অনধিক সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে। উপধারা (২) মতে, কোনো ব্যক্তির লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল উপধারা (১)-এর অধীন সঙ্ঘটিত অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ ও মামলার বিচার করতে পারবেন।

দেশে ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনের অপরাধগুলোর কঠোর শাস্তিবিধানের জন্য ১৯৮৩ সালে প্রথম নারী নির্যাতন (নিবর্তক শাস্তি) অধ্যাদেশ নামে একটি আইন জারি করা হয়। পরে ১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন নামে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা হয় এবং এর মাধ্যমে ১৯৮৩ সালের অধ্যাদেশটি রহিত করা হয়। পরে মামলা পরিচালনাকালে এ আইনেরও কিছু সীমাবদ্ধতা, অসঙ্গতি ও ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হওয়ায় ২০০০ সালে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন পাস করা হয়। ১৯৯৫ সালের ‘নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইনটি বিলুপ্ত করা হয়। ২০০০ সালের আইনটিই বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে প্রচলিত আইন হিসেবে বলবৎ আছে। ২০০৩ সালে আইনটিতে সংশোধনী আনা হয়েছে।

কিন্তু আইনটির কঠোরতা পুঁজি করে প্রতিপক্ষকে হয়রানির উদ্দেশে বহু মিথ্যা মামলা দায়ের হচ্ছে মর্মে অভিযোগও উঠছে। মামলা দায়েরের পর তদন্তে প্রেরণ করা হলে আগে থেকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেয়া লোকজন দিয়ে একতরফা জবানবন্দি দিয়ে মামলাটি আমলে নেয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পাদন করা হয়। এরপর ট্রাইব্যুনাল মামলাটি আমলে নিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। গ্রেফতার হওয়ার আগে পর্যন্ত আসামি জানতেও পারেন না প্রতিপক্ষ তার বিরুদ্ধে আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে এ মামলায় তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।

বাংলাদেশে পুলিশ বলছে, নারী নির্যাতনের মামলার ৮০ শতাংশের কোনো প্রমাণ মেলে না। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলায় জামিন পাওয়া সহজ নয় বলে অনেকে এর অপব্যবহার করছেন। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘যারা ফ্যাব্রিকেটেড মামলা দেন তাদের জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি বড় সুবিধা হলো; এই আইনে জামিন পেতে বেগ পেতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে জামিন পাওয়া যায়। তবে মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে আসামিকে জেলে থাকতে হয়। ফলে অনেকে পালিয়ে থাকেন। দ্রুততম সময়ে এ মামলায় হয়রানি করার একটা সুযোগ রয়েছে।

মামলা করার পর প্রতিপক্ষ যে একটা চাপে থাকে, হেনস্তা হয়- সে কারণে যাদের সাথে বিবাদ তারা হয়তো আপস করে ফেলেন।’ বিবিসির এক জরিপ বলছে, বাংলাদেশে জমিজমা সংক্রান্ত মামলাই সবচাইতে বেশি হয়ে থাকে। জমিজমার মামলা সময় সাপেক্ষ। প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবেও অনেক সময় নারী নির্যাতনের মামলা জুড়ে দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক খন্দকার ফারজানা রহমান বলছেন, এমন মিথ্যা মামলা মূলত হচ্ছে নানা জনের বুদ্ধিতে। তবে আইনজীবীরাই অনেক ক্ষেত্রে মন্ত্রণাদাতা। তিনি আরো বলেছেন, ‘মন্ত্রণাদাতা প্রথমত হচ্ছে পরিবারের মানুষজন, আত্মীয়-স্বজন। কিন্তু এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন উকিল। মানুষ যখন মামলা করে, শুরুতেই কিন্তু একজন উকিলের কাছেই যায়। অনেক সময় উকিলের কথায়ও এমন মামলা হয়।’

সুতরাং, মিথ্যা মামলা বা অভিযোগের শিকার হলে বিবাদী আইনের মধ্যে থেকে আদালতে লিখিত পিটিশন দায়ের করে প্রতিকার পেতে পারেন। মিথ্যা মামলা বা অভিযোগের দায়ে অপরাধীর সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। নারী নির্যাতন ঠেকাতে উল্লিখিত আইনটি যথার্থভাবে প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হোক। কোনো নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার যেন না হন তা সবার প্রত্যাশা। ১৭ ধারার প্রতিকার কিভাবে ফলপ্রসূ করা যায় বিষয়টি নিয়ে আইন-বিচারঙ্গনের বিশেষজ্ঞদের ভাবতে হবে।
লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও গ্রন্থ প্রণেতা
Email : seraj.pramanik@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us