ঘড়িরও বাহার দেখ!

আমীর হামযা | Jan 20, 2020 04:55 pm
ঘড়ি

ঘড়ি - ছবি : সংগ্রহ

 

‘শখ’ এমন একটি শব্দ যা প্রত্যেক মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। শখ পূরণের ইচ্ছা প্রত্যেক মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কেউ সহজে শখ পূরণ করতে পারে, কারো জীবনভর চেষ্টার পরও অপূর্ণ থেকে যায় শখ। কিছু মানুষের শখ নেহায়েতই ছোট, কারো শখ বিচিত্র ও বিলাসিতাপূর্ণ। প্রত্যেকের শখের ধরন আলাদা, অর্থের সাথে শখের রয়েছে মেলবন্ধন। দরিদ্রের শখ পূরণের বাসনা বেশির ভাগ সময় ইচ্ছাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু ধনীরা কিভাবে অর্থ ব্যয় করবেন সেটি ভেবেই কুল পান না। বাংলায় একটি কথার প্রচলন রয়েছে, ‘শখের তোলা আশি টাকা’। অনেক সময় শখ আর ফ্যাশনকে সমার্থক ভেবে আমরা গুলিয়ে ফেলি। ‘ফ্যাশন’ হলো সমকালের চলনসই জিনিসের ব্যবহার। অন্যদিকে, শখের ব্যাপ্তি বিস্তৃত। হাল আমলে আমাদের দেশের তরুণরা সবাই মুখে দাড়ি রাখতে পছন্দ করে। দাড়ি রাখাটা এখনকার তারুণ্যের আরেকটি ফ্যাশন।

সাম্প্রতিক সময়ে একটি প্রবণতা দারুণভাবে লক্ষণীয়। বর্তমানে সব বয়সীদের ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হিসেবে ফিরে এসেছে হাতঘড়ি। স্মার্টফোনের এই যুগে সময়ের হিসাব রাখতে ঘড়ির প্রয়োজনীয়তা খুব একটা নেই। স্মার্টফোনের কারণে বিশ^ব্যাপী হাতঘড়ির ব্যবহার একসময় কমে গিয়েছিল। সেই অবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। মানুষের ব্যস্ততা বাড়ার সাথে সাথে ঘড়ির ব্যবহারের মাত্রাও বাড়তে থাকে। শুধু উচ্চবিত্ত নয়, সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর মানুষও ঘড়ির প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারেন। ১৮৪৩ সালে প্রথমবারের মতো ঘড়ি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যায় ‘দ্য ব্রিটিশ ওয়াচ কম্পানি’। তার আট বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের ‘অ্যারন লাফকিন ডেনিসন’ ঘড়ি উৎপাদন শুরু করে। উনিশ শতকে ট্রেনে যাতায়াতের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ঘড়ির ব্যবহারের মাত্রাও বেড়ে যায়। বিংশ শতাব্দীতে ঘড়ি একটি নির্দিষ্ট মানে চলে আসে। ১৯২০-এর দশকে ঘড়ি পকেট থেকে বেরিয়ে মানুষের কব্জিতে এঁটে বসে। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে ঘড়ি হয়ে যায় ইলেকট্রনিক। এখন তো হাতঘড়ি প্রয়োজনের পাশাপাশি ফ্যাশনের অংশও।

পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে হাতঘড়ির বাজার প্রতি বছর ১৫-২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্ববাজারেও হাতঘড়ির চাহিদা বেড়েছে। চাকরিজীবী ও করপোরেট গ্রাহকেরাই মূলত ঘড়ি কেনেন বেশি। বিয়ের গিফট, ফেয়ারওয়েল প্রভৃতি উপলক্ষে ব্যবহারের জন্যও বহু ঘড়ি বিক্রি হয়। শুধু সময় জানাতে নয়, হাতের ঘড়িটি একজন মানুষের ব্যক্তিত্বও প্রকাশ করে থাকে। বর্তমানে ঘড়ি আভিজাত্য, শখ এবং ফ্যাশনের অনুষঙ্গ। উপহার হিসেবেও দারুণ। তাই তো তারুণ্যের হাতের ডানায় ফিরেছে হাতঘড়ি। ফ্যাশনে, সৌন্দর্যে, ব্যক্তিত্বে, আভিজাত্যে হাতঘড়ি এখন নান্দনিকতার প্রতীক। শুধু তারুণ্যের নয়, সব বয়সীদের কব্জিতেই শোভা পাচ্ছে হাতঘড়ি। কেতাদুরস্ত হতে এর ব্যবহারের কোনো বিকল্প দেখছে না বর্তমান তারুণ্য। যাদের ঘড়ি কেনার শখ, তাদের অনেকের ২০-৫০টি পর্যন্ত ঘড়ির সংগ্রহ আছে। জামা-জুতোর সাথে মিলিয়ে তারা হাতঘড়ি পরছেন। মোবাইল ফোনের ডিজিটাল পর্দা উপেক্ষা করে হাতের ঘড়িতেই সময় খুঁজছে মানুষ। ডিজিটাল ডিভাইসের ‘আলোর অন্ধকার’ থেকে চোখের মুক্তি চাইছেন মানুষ।

হাতঘড়িতেও লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। অতীতের তিন কাঁটায় সীমাবদ্ধ নয় হাতঘড়ির বাজার। সময়ের পাশাপাশি দিন, তারিখও জানাচ্ছে। কম্পাসের সাহায্যে দিতে পারে দিক নির্দেশনা। ইকোড্রাইভ-বৈশিষ্ট্যযুক্ত ঘড়িগুলো চলে সৌরশক্তিতে। স্প্রিং ঘুরিয়ে চালানো যায় মেকানিক্যাল ঘড়ি। এমনকি, পরিধানকারীর হাতের নড়াচড়া আর পালসেও চলতে পারে কাইনেটিক ঘড়ি। পানির পাশাপাশি, বৈদ্যুতিক শক প্রতিরোধ করতে পারে এমন ঘড়িও বাজারে পাওয়া যায়। মাত্র কয়েক শ’ টাকা থেকে শুরু করে একটা ঘড়ির দাম হতে পারে কোটি টাকা পর্যন্ত। সামর্থ্যরে সাথে পাল্লা দিয়ে অনেকে কিনছেন হাতঘড়ি।

ঢাকার বিত্তবান কিছু ব্যবসায়ীর হাতে কোটি টাকার ঘড়িও শোভা পাচ্ছে। কারো সংগ্রহে আছে মেয়েদের গয়নার মতো নানা ব্র্যান্ডের বহু ঘড়ি। পোশাকের সাথে তাল মিলিয়ে একেক দিন একেকটা পরেন তারা। বাংলাদেশে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘড়ি হলো- রাডো, টি সট, সিকে, সিটিজেন, ক্যাসিও, সিকো, টাইটান, রোমানসন, ক্রিডেন্ট আর ওবাকু। সুইস ঘড়ি লনজিসের দাম ৮০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত।
হাতঘড়ি যারা ব্যবহার করেন, তাদের পছন্দতালিকার শীর্ষে রয়েছে রোলেক্স কোম্পানির ঘড়ি। এটা দুনিয়ার সবচেয়ে দামি ঘড়ির একটি। ভিনটেজ রোলেক্স ঘড়ির একটির দাম প্রায় ১৫ কোটি টাকা। রোলেক্স সাবমেরিনার মডেলের সবচেয়ে কম দামে যে ঘড়িটি পাওয়া যায়, তার দামও পাঁচ হাজার ডলার বা চার লাখ ২৫ হাজার টাকা। রোলেক্স কোম্পানির ঘড়ির এতবেশি দাম হওয়ার কারণ হলো- এই ঘড়ি বানাতে সময় লাগে এক বছর। প্রতিটি ঘড়ির ওপর নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পরেই বাজারে ছাড়া হয়। আর বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর রোলেক্স বেশ লম্বা সময় ধরে ব্যবহারকারীদের ভালো সার্ভিস দিয়ে থাকে। একটি রোলেক্স ঘড়ি পাঁচ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায় অনায়াসে। আর যদি খুব যত্নসহকারে ব্যবহার করা হয়, তবে ১০০ বছরেও এ ঘড়ির হয়তো কিছুই হবে না।

ঢাকার অনেক শো-রুমে ঘড়ির দাম সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার টাকা। মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ ঘড়ির ক্রেতা। এছাড়া করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো হাজার হাজার ঘড়ি কিনে নিজেদের ডিলার নেটওয়ার্কে এগুলো বিতরণ করে। বিশেষ করে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমেও শত শত চিকিৎসককে ঘড়ি উপহার দেয়। কয়েকটি ব্যাংক নামীদামি ব্র্যান্ডের ক্রেতাদের ১২ মাসের কিস্তিতে ঘড়ি কেনার সুবিধা দিচ্ছে। তবে ঘড়ি আমদানিতে ৩৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ শুল্ক বিদ্যমান থাকায় এর আমদানি খরচ আকাশছোঁয়া।

ধনী বা কোটিপতি ব্যক্তিদের ব্যবহৃত ঘড়ির দাম শুনলে চোখ হয়ে পড়ে চড়কগাছ। আমাদের দেশে ঘড়ি ব্যবহারের শৌখিনতায় ধনকুবের মুসা বিন শমসেরকে বোধহয় কেউ ছাড়াতে পারেননি। দুর্নীতি দমন কমিশনে তাকে যখন ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর ডাকা হলো; তখন দুদকের ফটকে গাড়ি থেকে নামার মুহূর্তে তার ডান হাতে ছিল শুভ্র আলোর দ্যুতি; হাতে হীরকখচিত বিশ্বখ্যাত রোলেক্স ব্র্যান্ডের অতি দামি ঘড়ি। দাম ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। ২০০৯ সালের ১৪ নভেম্বর সংখ্যায় ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য উইকলি নিউজের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে মুসা বিন শমসেরের ব্যবহৃত ওই বিখ্যাত ঘড়ির দাম জানা গিয়েছিল। এ ধরনের ঘড়ি বিশেষ অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিতে হয়; প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সাধারণভাবে বিক্রির জন্য এটা তৈরি করে না। ভারতের রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রির চেয়ারম্যান, ধনাঢ্য মুকেশ আম্বানির সহধর্মিণী নীতা আম্বানি। তাকে ঘিরে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। নীতা আম্বানির ঘড়ির দামের তথ্য দিয়ে এক সময় খবর প্রকাশ করেছিল ভারতের এবেলা পত্রিকা। নীতা আম্বানির যে ঘড়িগুলো ব্যবহার করেন সেই ব্র্যান্ডগুলো হলো গুচি, কেলভিন ক্লেইন, বুলগারি ইত্যাদি। দাম সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

বেশ কয়েক দিন ধরে গণমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে সরকারদলীয় নেতা ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ব্যবহৃত ঘড়ি নিয়ে। গত মাসে সুইডেনভিত্তিক অনুসন্ধানী ওয়েবসাইট নেত্র নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, কাদের যে ঘড়িগুলো ব্যবহার করেন তার মধ্যে সাতটি বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের এবং ওই ঘড়িগুলোর বাজার মূল্য ৯ থেকে ২৮ লাখ টাকা। এ বিষয়ে ৯ জানুয়ারি এক সাংবাদিক ওবায়দুল কাদেরকে বলেন, ‘আপনি একজন কেতাদুরস্ত মানুষ, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ঘড়ি ব্যবহার করেন।’ সুইডেনভিত্তিক অনলাইনের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ওই সাংবাদিক বলেছেন, নির্বাচনের হলফনামায় দেয়া তথ্য ও বার্ষিক আয়ের সাথে তার ব্যয়বহুল ঘড়িগুলোর ব্যবহার অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি ওই সাংবাদিককে থামিয়ে বলেন, ‘আমার যত ঘড়ি আছে, একটাও আমার নিজের পয়সা দিয়ে কেনা নয়। ‘ফর গড’স সেক’ বলছি, এগুলো আমার কেনা না। আমি পাই। হয়তো আমাকে অনেকে ভালোবাসে।’ ওবায়দুল কাদের বলেন, অনেক কর্মী বিদেশে আছেন। তারা আসার সময় এগুলো নিয়ে আসেন। গতকাল সিঙ্গাপুর থেকে একজন তিনটা কটি নিয়ে আসছে। আমাকে তারা উপহার দেন। আমি কী করব?’ (১০ জানুয়ারি, ২০২০, প্রথম আলো)
ওবায়দুল কাদেরের এমন ব্যাখ্যাকে ‘অপর্যাপ্ত’ উল্লেখ করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি এক বিবৃতিতে প্রশ্ন তুলেছে, এসব সামগ্রী যদি উপহার হিসেবেই পাওয়া হয়ে থাকে, কেন সেগুলো রাষ্ট্রীয় তোশাখানায় জমা দেয়া হলো না? ২০১২ সালের জুনে হালনাগাদ করা তোশাখানা বিধি ১৯৭৪ অনুযায়ী, শুধু বিদেশি বিশিষ্টজনদের থেকে একজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ৩০ হাজার টাকা বা তার কম মূল্যের উপহার গ্রহণ করতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে এই মূল্যমানের সীমা ৫০ হাজার টাকা এবং সংসদ সদস্যসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীর ক্ষেত্রে এই পরিমাণ পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারণ করা আছে। এর বেশি মূল্যমানের উপহার বা উপহারটি যদি দুর্লভ বস্তু যেমন : পুরনো ছবি বা প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হয়, তাহলে সেটা সাথে সাথে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগকে জানিয়ে তোশাখানায় জমা দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই নিজের কাছে রাখা যাবে না বা ব্যবহার করা যাবে না।

কেউ এসব নিয়ম না মানলে তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে- সেটা তোশাখানা বিধিতে স্পষ্ট করে বলা নেই। তবে তথ্য গোপন এবং হলফনামায় দেয়া তথ্যের সাথে এসব উপহারের অসামঞ্জস্য পাওয়া গেলে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। এর আগে এরশাদ রাষ্ট্র্রপতি থাকাকালে যেসব উপহার পেয়েছিলেন, সেগুলো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দেয়ার কারণে, ঢাকার বিশেষ জজ আদালত তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল। অবশ্য হাইকোর্ট পরে সেই মামলা বাতিল করে দেন।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us