লকডাউনের জীবন : কাশ্মির থেকে দূরে

সানা আলতাফ | Apr 07, 2020 08:41 am
লকডাউনের জীবন : কাশ্মির থেকে দূরে

লকডাউনের জীবন : কাশ্মির থেকে দূরে - সংগৃহীত

 

দুই মাস আগে যখন করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের খবর প্রচারিত হয়, তখন আমি তাতে একেবারেই কর্ণপাত করেনি। আমার তখন পূর্ণ মনোযোগ ছিল ভারতকে আচ্ছন্ন করা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিকে।

অবশ্য প্রতিদিন ভাইরাসে লোকজন মারা যাওয়ার খবর আসছিল। আমি খবর পড়ছিলাম, কিন্তু এ নিয়ে খুব বেশি চিন্তা না করেই আমার স্বাভাবিক জীবন পরিচালনা করছিলাম। এমনকি দুবাইতেও যখন করোনার প্রথম খবরটি এলো, তখনো আমি আতঙ্কিত হইনি। নিজেকে বলেছিলাম, আমরা ঠিক থাকব।
এরপর স্কুল, নার্সারি, মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হলো। তারপর খবর আসতে লাগল হাজার হাজার লোক এতে প্রাণ হারাচ্ছে।
এখন ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার পর তিন মাস অতিবাহিত হয়েছে। পুরো পৃথিবী অচল হয়ে পড়েছে, বেশির ভাগ দেশই এখন লকডাউন অবস্থায় আছে। কোটি কোটি লোক চাকরি হারিয়েচৈ, অনেকের জীবিকা ঝুঁকির মুখে। লোকজন তাদের বাড়িতে বন্দী হয়ে আছে। কেউ জানে না, এমন অবস্থা কত দিন স্থায়ী হবে।
যেদিকেই তাকাই, আতঙ্ক দেখি, বেঁচে থাকার চিন্তা দেখতে পাই। আমি প্রতিদিনই মানবজাতির কল্যাণের জন্য নামাজের সময় দোয়া করি। কিন্তু তবুও পুরো বিষয়টি আমাকে অবাক করে। আমি যখন বাড়িতে নিরাপদ থাকছি, আমার পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভাবি, তখন সবকিছু নিঃসাড় হয়ে আসে। কারণ এটাও তো আমার জীবনের আরেকটি লকডাউন।

শৈশবে আমি লকডাউন, শাটডাউন আর ক্র্যাকডাউনের মধ্যে বড় হয়েছি।
আমার বয়স যখন ৬, তখন আমি ভোরে মসজিদের ঘোষণায় শুনতে পেতাম যে আমাদের এলাকাটি ঘিরে ফেলা হয়েছে, ক্র্যাকডাউন চলছে।
আমি জানতাম, মহল্লার অন্যদের সাথে এখন বাবাকেও বিশাল এক কম্পাউন্ডের সামনে যেতে হবে ধরা পড়া ‘জঙ্গি’দের শনাক্ত করার জন্য। আর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ক্ষিপ্রগতিতে প্রবেশের সময় নারীদের বাড়িতেই থাকতে হচ্ছিল।

আর ১০ বছর বয়সে আমি ক্রস ফায়ার, গ্রেনেড বিস্ফোরণ, টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জের অর্থগুলো ভালোমতোই বুঝতে পেরেছি। রেজর ওয়ার, বার্বড ওয়্যার আর ব্যারিকেডের মধ্যকার পার্থক্যও বুঝতে পেরেছি। কৈশোরে আমি বন্দুকধারী লোকজনকে দেখেছি, রাজপথে রক্ত দেখেছি।
আর যৌবনের শুরুতে নিরীহ শিশু ও যুবক হত্যার পর একের পর এক লকডাউন দেখেছি। ২০০৮ সালের পর এটা নিয়মিতই হতো। প্রতি বছরই মাসব্যাপী লকডাউন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়। পুরো কাশ্মিরের প্রতিটি কোণে নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে ঘিরে রাখা হয়।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়, মোবাইল সার্ভিসও থাকে না। সারক্ষণ আমাদের ঘরে থাকতে হয়, টিভিতে মৃত্যুর খবরে চোখ রাখতে হয়। আর সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ লকডাউন হয়েছে ২০১৯ সালে কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার পর।
ইন্টারনেট, মোবাইল, ল্যান্ডলাইন- সবকিছু বিচ্ছিন্ন করার মানে হলো যোগাযোগ করার কোনো মাধ্যম না থাকা। ক্যাবল টেলিভিশন নিষিদ্ধ। লকডাউনে থাকা পরিবারগুলোর অন্যদের সাথে যোগাযোগ করার কোনো উপায়ই থাকে না।
সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে শিশুরা তাদের মা-বাবার সাথে কথা বলতে পারে না। এমনকি জরুরি চিকিৎসা সেবা পাওয়ার জন্যও অ্যাম্বুলেন্স ডাকা যায় না।

একটি বাড়ি পুড়ে যাওয়ার সময়ও দমকল বাহিনীকে ডাকা যায়নি। ভার্চুয়াল ক্লাসরুম বলতে কিছু নেই, বাড়িতে বসে কাজ করার সুযোগ নেই, গরিবদের জন্য ত্রাণ সহায়তাও নেই।
বিশ্ব যখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে, তখন কাশ্মিরের লোকজন প্রতিনিয়তই ভুগছিল। সম্প্রতি কাশ্মিরে একটি দীর্ঘতম লকডাউনের পর আরেকটি এসেছে।
আজ আমি দুবাইতে আমার বাড়িতে আবদ্ধ রয়েছি। আমি জানালা দিয়ে তাকাতে পারি। আমি লোকজনকে রাস্তায় দেখতে পাই না বললেই চলে। আমি নিজের কাছেই প্রশ্ন করি, আমার পরিবার, আমার প্রিয়জন কখন স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পেরেছিল? সেটা ছিল ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের আগে।

গালফ নিউজ


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us