নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া ভাারতীয় সেনাবাহিনীকে ভেতর থেকে ক্ষয়ে দেবে?

সুবীর ভৌমিক | May 21, 2020 07:29 pm
ভাারতীয় সেনাবাহিনী

ভাারতীয় সেনাবাহিনী - সংগৃহীত

 

আমি ভিয়েতনাম যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আমেরিকার একটি সামরক টেলিভিশন ড্রামা সিরিজ ‘ট্যুর অব ডিউটির’ তিনটি পর্ব দেখেছিলাম। ১৯৮৭-৯০ সময়কালে সিবিএসে তিন মওসুমে তা দেখানো হয়েছিল। এতে রাজনীতি, ধর্মবিশ্বাস টিমওয়ার্ক, বর্ণবাদ, আত্মহত্যা, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, যৌনতা, মাদক অপব্যবহার ইত্যাদি ইস্যুগুলো আনা হয়েছিল।

ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন সম্প্রতি ‘ট্যুর অব ডিউটি’ স্কিমের কথা ঘোষণা করল তখন এই আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিল যে এটি হতে পারে বিশ্বর অন্যতম পেশাদার সেনাবাহিনীটি প্রতিভা আকৃষ্ট করার একটি পদ্ধতি। বিশেষ করে চীনা সাইবার যুদ্ধ অপারেশন মোকাবিলা করতে মেধাবী আইটি গ্রাজুয়েট, লজিস্টিকস সামাল দিতে ব্যবস্থাপনা পেশাদার, সামরিক বাহিনীর অর্থবিভাগ ব্যবস্থাপনা করার জন্য চার্টার্ড অ্যানালিস্ট নিয়োগ করা হবে এর মাধ্যমে। কারণ ভারতীয় সামরিক বাহিনতে এগুলো সত্যিই দুর্বল পয়েন্ট।

আসুন প্রথমেই দেখে নেয়া যাক, ‘টিওডি’র বৈশিষ্ট্য হিসেবে সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কী বলেছেন :
• এই মহৎ প্রস্তাবের উদ্দেশ্য হলো অব্যাহত অফিসার ঘাটতি পূরণ করা
• তরুণ ও উপযুক্ত স্বেচ্ছাসেবকদেরকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণসহ তিন বছরের জন্য সেনাবাহিনীতে নিয়োগ লাভের প্রস্তাব দেয়া হবে।
• নির্বাচন বা প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে কোনো শিথিলতা থাকবে না। কেবল উপযুক্ত প্রার্থীদেরই নিয়োগ করা হবে।
• এই সম্পৃক্ততা সেনাবাহিনী ও সেইসাথে ব্যক্তির জন্য বিপুল কল্যাণকর হবে। কী কী সুবিধা পাওয়া যাবে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং তা প্রধান প্রস্তাবের অংশ হবে। সরকার শিগগিরই তা প্রকাশ করবে।
• এই প্রস্তাব সমর্থন করার প্রধান যুক্তি হলো এই যে এটি সেনাবাহিনীর আর্থিক বোঝা লাঘব করতে সহায়ক হবে এবং আধুনিকায়নের জন্য আরা বেশি তহবিল নিশ্চিত করবে।
সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জে এম দেবদাস বলেন, এতে অর্থের সাশ্রয় হবে, কিন্তু কিসের বিনিময়ে?প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে মেশিন কোনো ব্যাপারই নয়, আসল কথঅ হলো মেশিনের পেছনে থাকা মানুষটি। করপোরেট দুনিয়া যখন মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে নজর দিচ্ছে, তখন ভারতীয় সেনাবাহিনী বন্দুকের পেছনে থাকা লোকটির বিনিময়েই আধুনিকায়নের দিকে নজর দিয়েছে।
এই জেনারেল ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এবং সেনাবাহিনীতে থাকার সময় একটি উভচর ব্রিগেড ও অন্যান্য ফরমেশনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
দেবদস বলেন, এই স্কিম সেনাবাহিনীর মূল্যবোধ ও নৈতিকতার জন্য জন্য ক্ষতিকারক হবে, জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হিতে বিপরীত হবে।

তিনি প্রশ্ন করেন, সশস্ত্র বাহিনীল আধুনিকায়নের জন্য তহবিল ব্যবস্থাপনা ও বরাদ্দ সেনাবাহিনীর না রাজনৈতিক নির্বাহীদের দায়িত্ব? সেনাবাহিনী নিজেই যদি আর্থিক বিষয়ের দিকে নজর দেয়, তবে সেনাবাহিনী তার মূল ভূমিকার সাথেই আপস করবে। সেনাবাহিনী কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়।
দেবদস বলেন, সীমিত সংখ্যকের ট্রায়াল সেনাবাহিনীতে সামগ্রিকভাবে টিওডি বাস্তবায়নের মাপকাঠি হতে পারে না। মানুষ বন্দুক বা ট্যাঙ্ক নয় এবং কোনো দুই ব্যক্তি একই রকম নয়।

তিনি বলেন, টিওডি সৈন্য ও অফিসারদেরকে তিন বছর পর ছেড়ে দেয়ার পর তারা তখনো ‘গ্রিন সোলজার্স’ (যদিও যুদ্ধ অভিজ্ঞতা অর্জন করেনি) হয়ে থাকবে, যা তাদের দুর্বল উপযোগিতার প্রমাণ দেবে।
ব্যবস্থাপনার অধ্যাপক সুব্রত রায় বলেন, করপোরেটগুলো যখন ইন্টার্নশিপ বাতিল করে দিচ্ছে, তখন সেনাবহিনী তা গ্রহণ করছে দেখে অবাক লাগছে। তিনি বলেন, ইন্টার্নরা তাদের সাংগঠিনিক সংস্কৃতি নষ্ট করে দেয়, সাংগঠনিক আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তিনি বলেন, রেজিমেন্টাল বন্ডিংয়ের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সেনাবাহিনীতে এর প্রভাব হবে খুবই খারাপ।
নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক তিন অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, গ্রিন ইন্টার্নদের দিয়ে রেজিমেন্টাল বন্ড ও ঐতিহ্য মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে। কারণ এখানে সম্পৃক্ত হতে ও খাপ খাইয়ে নিতে তাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকবে না।

তাদের একজন বলেন, নিয়মিত যুদ্ধই হোক বা শক্ত বিদ্রোহ দমন হোক- এসব গ্রিন ইন্টার্ন কঠিন যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবে, এমনটি কখনোই আশা করা ঠিক হবে না।
এক লে. জেনারেল বলেন, টিওডি হবে একটি অপচয়। আর টিওডি রিক্রুটরা যদি হয় রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিভাজনমূলক ধর্মীয় লাইনের, তবে তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনিবার্য সেক্যুলার মূল্যবোধের জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হবে। তিনি বলেন, এটি কাশ্মির বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জোনে সেনাবাহিনীর আচরণে প্রভাব ফেলবে।
আসামের কংগ্রেসে রাজনীতিবিদ ববিতা সরমাহ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ক্ষমতাসীন বিজেপি-আরএসএস নিয়োগপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। কারণ ‘শিক্ষার’ ক্যাডাররা অস্ত্রের (অনেক ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র) মৌলিক ব্যবহার ও শারীরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকে।

তিনি সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, আমরা ভবিষ্যতের হিটলারাইট ব্রাউন শার্টের পেশীশক্তি যোগানোর জন্য সেনাবাহিনীতৈ গেরুয়া তরুণদের যোগ দিতে ও বের হওয়ার ঢল দেখতে পারি। সঙ্ঘ পরিবারের এই সশস্ত্র শাখাটি তাদের যেই বিরোধিতা করবে বা সংখ্যালঘু বা বিরোধীদের উত্যক্ত করবে। তারা ক্রমবর্ধমান হারে অজনপ্রিয় হতে থাকায় তাদের ক্ষমতায় থাকার জন্য গেরুয়া ব্রিগেডের প্রয়োজন।

তিনি বলেন, তারা এখন সেনাবাহিনী হিসেবে ইন্টারেটে ট্রল হয়। শিগগিরই তারা সশস্ত্র গ্রুপে পরিণত হবে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সাধারণভাবে ও বিশেষভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে রেজিমেন্টেশনই শক্তি। সেনাবাহিনীর কার্যকারিতা ও সেনাবাহিনীর প্রতিযোগিতামূলকতার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
ব্রিগেডিয়ার দেবদস বলেন, রেজিমেন্টেশন রাতারাতি হয় না। এটি সময়ের পরিক্রমায় আন্তরিকতা ও ভ্রাতৃত্বাধের মাধ্যমে হয়ে থাকে। যুদ্ধের ডাক হলো রেজিমেন্টেশনের ইস্তেহার।
দেবদস উল্লেখ করেন, ‘ট্যুর অব ডিউটি’ রেজিমেন্টেশন বিকাশ ও সৌহার্দ্য সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় সময় দেবে না। রেজিমেন্টেশন গঠনের প্রয়অস ব্যর্থ হবে, কারণ সেনাবাহিনী থেকে মুক্তি দেয়ার ফলে তাদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সময় পাওয়া যাবে না।

স্বাভাবিক কোর্সে সাধারণ সিপাহি ১৫ বছর চাকরি করে, কিন্তু টিওডিতে সে চাকরি করবে মাত্র তিন বছর। গ্রিন সোল্ডাররা নিয়মিত সৈনিকদের কঠিন দায়িত্ব থেকে স্বস্তি দেবে, এমনটি কখনোই হবে না। কারণ প্রতি তিন বছর পরপর টিওডিতে নতুন লোক আসবে।
একটি ব্যাপকভিত্তিক মতবিনিময়ে দেবদস বলেন, ফলে কোনো নিয়মিত সিপাহি অবসরের আগে পর্যন্ত টিওডি থেকে স্বস্তি পাবে না। ক্লান্ত হয়ে পড়া ছাড়াও তার প্রতি তিন বছরের চেষ্টা বিফলে যাবে। নবাগতদের সাথে সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠাতেও সে আগ্রহী হবে না।

গ্রিন সোল্ডারদের জন্য ব্যাটালিয়নও হবে স্থায়ী বোঝা। নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দিতেই চলে যাবে অনেক সময়। আর্থিক ব্যাপারে বলা যায়, টিওডি হবে সামনে দিয়ে মশা গেলেও হিসাব হবে, কিন্তু পেছন দিয়ে হাতি গেলেও টের পাওয়া যাবে না। সাধারণ সৈনিক বা অফিসার ১৫ বছর চাকরি করেন, টিওডি করবে তিন বছর। নিয়োগ-প্রশিক্ষণ-আত্মস্থ করার চক্রটি ৫ গুণ বেশি হবে। একইভাবে ব্যক্তিগত পোশাক ও অন্যান্য সামগ্রীতে লজিস্টিক ক্ষতি হবে ৫ গুণ। এই মন্তব্য ডিফেন্স অ্যাকাউন্টেসর সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তা মিহির গুপ্তার।
ভারতজুড়ে তিন বছর পরপর নিয়োগ হবে একটি ক্লান্তিকর ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। বিজ্ঞাপন দিতে হবে, পরীক্ষা নিতে হবে, বাছাই করতে হবে, শিক্ষা ও নিরাপত্তা অবস্থা যাচাই করতে হবে, অনেক কিছু করতে হবে। এসব কাজ করার জন্য অতিরিক্ত লোকবল লাগবে।

তিন বছর পর টিওডিদের কী হবে? তাদের কে নিয়োগ করবে? শিল্পপতি আনন্দ মহিন্দ্র বলেছেন, তিনি তাদের নিয়োগ করতে আগ্রহ হবেন। কিন্তু ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ সুজিত রায় বলছেন, ভারতীয় করপোরেট সংস্কৃতি দ্রুত বদলাচ্ছে। ফলে তরুণ সৈনিকেরা সরাসরি করপোরেট শিক্ষার্থীদের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে ও প্রতিযোগিতা করতে সমস্যায় পড়বে।

রায় বলেন, তারা না হবে ভালো সৈনিক, না হবে ভালো ম্যানেজার। তবে তারা যদি বেতনভোগী স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কোনো দলে যোগ দেন, তবে তাদের রাজনৈতিক মূল্য বেশ হবে।

ভারতীয় সেনাবাহিনীল সাবেক ডেপুটি চিফ লে. জেনারেল রাজ কাদিয়ান দি ওয়্যারকে লিখেছেন যে টিওডি স্কিমটি সেনাবাহিনী ছাড়া অন্য সবার জন্য কল্যাণকর হবে। প্রস্তাবটির খারাপ দিক তথা সেনাবাহিনীর ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি সম্ভবত পরিকল্পনাবিদদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে বা তারা এটি আড়াল করে রেখেছেন। অফিসারদের প্রাক-কমিশন প্রশিক্ষণ দীর্ঘ ও বিভিন্ন বিষয়ে তাদের পড়াশোনা করতে হয়। টিওডিদের ইউনিফর্ম পরার মেয়াদ সংক্ষিপ্ত থাকায় তাদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ব্যয়সাশ্রয়ী হবে না।

সূত্র : এসএএম


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us