মানচিত্র পুড়িয়ে সীমান্ত সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেহরুর

নিজস্ব প্রতিবেদক | May 30, 2020 10:17 am
মানচিত্র পুড়িয়ে সীমান্ত সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেহরুর

মানচিত্র পুড়িয়ে সীমান্ত সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেহরুর - সংগৃহীত

 

আইয়ুব খানের মুখ্যসচিব কুদরাতুল্লাহ শাহাব তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন যে মনোরম মারিতে অবকাশের সময় অনানুষ্ঠানিক মতবিনিময়ের সময় নেহরু জানতে চান যে চীনের সাথে পাকিস্তান কোনো সীমান্ত চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে কিনা।

আইয়ুব হ্যাঁসূচক জবাব দিলে তিনি মানচিত্র সম্পর্কে ধারণা দিতে বলেন।
শাহাবের আত্মজীবনীতে উল্লেখ রয়েছে যে ওটা ছিল অনানুষ্ঠানিক সভা। এমনকি আইয়ুব পর্যন্ত মানচিত্রের একটি কপি পাঠাতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু নেহরু দিল্লি ফেরার পরপরই কূটনৈতিক আলোড়নের সৃষ্টি হয়, রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে ভারতের কাছে মানচিত্র হস্তান্তর করার জন্য পাকিস্তানের কাছে অনুরোধ জানানো হয়।

নেহরু এমনকি পার্লামেন্টে বলেন যে এটি হলো পাকিস্তান ও চীনের যৌথ ষড়যন্ত্র।
শাহাবের মন্তব্যের সাথে মিল রেখেই নূরানি তার সর্বশেষ গ্রন্থ ইন্ডিয়া-চায়না বাউন্ডারি প্রবলেম, ১৮৪৬-১৯৪৭ : হিস্টরি অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি (অক্সফোর্ড)-এ উল্লেখ করেছেন, কিভাবে পররাষ্ট্র দফতর নতুন একতরফা মানচিত্র সৃষ্টির জন্য পুরনো মানচিত্রগুলো পুড়িয়ে ফেলেছিল।
নূরানি সাবেক এক পররাষ্ট্র সচিবের (তিনি তখন ছিলেন জুনিয়র অফিসার এবং এই বাজে কাজটি করার নির্দেশ পালন করতে বাধ্য হয়েছিলেন) উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ১৯৫৩ সালের ২৪ মার্চ সীমান্তের নতুন সীমানা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়। পুরনো মানচিত্রগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়।

এ জি নূরানি তার মুম্বাইয়ের বাসভবন থেকে আনাদুলু এজেন্সিকে বলেন যে নেহরুর ইস্যু করা ১৭ প্যারার স্মারকে মন্ত্রণালয়কে সুস্পষ্টভাবে সব পুরনো মানচিত্র সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
নূরানি বলেন, আর্কাইভের প্রমাণ অনুযায়ী, উত্তর ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তের কোনো সীমারেখা প্রদর্শন ছাড়াই নতুন মানচিত্রগুলো ছাপানো হয়। নেহরু আরো নির্দেশ দেন যে এসব মানচিত্র বিদেশে দূতাবাসগুলোতে পাঠাতে হবে, তিনি পরামর্শ দেন, এগুলো সাধারণভাবে জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করা হবে এবং স্কুল ও কলেজগুলেতে ব্যবহৃত হতে পারে। তিনি কর্মকর্তাদের পরামর্শ দেন যে এই সীমান্তকে দৃঢ় ও সুনির্দিষ্ট বিবেচনা করতে হবে এবং কারো সাথে এ নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করা যাবে না।

পুস্তকে প্রকাশিত স্মারকটিতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয় যে তারা যাতে পুরনো মানচিত্রগুলো সম্পর্কে আলোচনা পর্যন্ত না করেন এবং কেবল নতুন মানচিত্রগুলোর কথাই উল্লেখ করেন।
নেহরুর স্মারকে বলা হয়, পুরো সীমান্তজুড়ে চেকপোস্ট ছড়িয়ে থাকার একটি সিস্টেম থাকা প্রয়োজন। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এমন সব স্থানে আমাদের চেক পোস্ট থাকা উচিত, যেগুলো বিরোধপূর্ণ এলাকা বিবেচিত হতে পারে।


নেহরুর নির্দেশনা আলোচনার দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল
নূরানি বিশ্বাস করেন যে এই নির্দেশনার ফলে সব ধরনের আলোচনা বা সীমান্ত ইস্যুতে লেনদেনের সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়। রূপকথার ‘অচিহ্নিত সীমান্ত’ ১৯৫৪ সালের নতুন মানচিত্রে পশ্চিম (কাশ্মির) ও মধ্য সেক্টরে (উত্তর প্রদেশ) ফেলা হয়, যা ১৯৪৮ ও ১৯৫০ সালের সরকারি মানচিত্রগুলোতে অস্তিত্বশীল ছিল।
পাকিস্তান তার কিছু ভূমি চীনের কাছে ছেড়ে দিয়েছে বা উপহার দিয়েছে বলে ভারতের সৃষ্ট ধারণা এবং এমনকি কাশ্মিরি নেতাদের কাছে ব্যাপকভাবে গৃহীত ধারণাটি প্রত্যাখ্যান করেছেন এই লেখক। আর্কাইভের প্রমাণে বরং দেখা যায় যে চীনই ১৯৬৩ সালের ৩ মার্চের পাকিস্তান-চীন সীমান্ত চুক্তির আওতায় পাকিস্তানকে ৭৫০ বর্গ মাইল এলাকা ছেড়ে দিয়েছে।

নূরানি বলেন, ভারত হয়তো প্রতিবাদ করে বলতে পারে যে এই চুক্তি করার কোনো কর্তৃত্ব পাকিস্তানের নেই। কারণ জম্মু ও কাশ্মির হলো বিরোধপূর্ণ এলাকা। কিন্তু চুক্তির ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে কাশ্মির নিষ্পত্তির পর এই চুক্তি সংশোধিত হতে পারে।

প্রখ্যাত মানচিত্রকর ও ওই সময়ের পাকিস্তানের সার্ভেয়র-জেনারেল চৌধুরী মোহাম্মদ আসলাম চীনের সাথে সীমান্ত চিহ্নিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে ঐতিহাসিক তথ্যের আলোকে নিখুঁতভাবে সীমান্তরেখা টানা হয়েছে।

তিনি ইরানের সাথে সীমান্ত চিহ্নিতকরণেও ভূমিকা পালন করেন। এর ফলে ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি তাকে নিশান-ই-হুমায়ূন খেতাবে ভূষিত করেন।
নূরানি বলেন, পাকিস্তানের সাড়া ছিল ঐতিহাসিক তথ্য ও বিদ্যমান বাস্তবতার ভিত্তিতে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান সরকার স্রেফ পুরনো মানচিত্রগুলোর ভিত্তিতে দাবি করেন এবং এতে করে চীনও ৭৫০ বর্গ মাইল এলাকার ওপর দাবি ছেড়ে দেয়।

ব্রিটিশরা সীমান্ত অচিহ্নিত রেখে দিয়েছিল
ব্রিটিশরা ১৮৪৬ সালের মার্চ মাসে অমৃতসর চুক্তির আওতায় জম্মু ও কাশ্মির রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় এর উত্তর ও পূর্ব সীমান্তগুলো অচিহ্নিত রেখেছিল। ১৮৪৬ ও ১৮৪৭ সালে সীমান্ত চুক্তি নিয়ে আলোচনার জন্য চীনকে হয়রানি করতে থাকে। কিন্তু চীন এতে সাড়া দেয়নি।
১৯৬৩ সালের চুক্তিটির ভিত্তি ছিল ১৮৯৯ সালে চীনকে দেয়া ব্রিটিশ প্রস্তাব। এতে পাকিস্তানের জন্য ভূখণ্ডগত লাভ হয়। অধিকন্তু নূরানির মতে, নিষ্পত্তির জন্য চীন কিন্তু পাকিস্তানকে চাপ দেয়ীন। বরং তারা প্রথমে ভারতের সাথে সীমান্ত নিষ্পত্তিতে আসতে চেয়েছিল।

কলকাতা ও নর্থ বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক বি এন গোস্বামীও বলেন যে সীমিত হলেও জানাশোনা লোকজন মনে করে যে এই রূপরেখাটি ছিল ন্যায়সঙ্গত ও উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য।
নূরানি সীমান্ত সমস্যাটি জিইয়ে রাখার জন্য বিভক্ত মন্ত্রিসভা, দায়িত্বহীন বিরোধীদল, বেখেয়াল ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও অবাধ্য পার্লামেন্টকে দায়ী করেন। তিনি আরো বলেন যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিস্টরিক্যাল ডিভিশনের পরিচালক কে জাকারিয়ার ব্যাপকভিত্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ সমীক্ষা এখনো গোপন রাখা হয়েছে।
সীমান্ত সমস্যা সম্পর্কে দৃশ্যত ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও ভারতের নীতির মধ্যে পুরোপুরি অসামঞ্জস্যতার কথা উল্লেখ করে লেখক বলেন যে কূটনীতিও অনড় হয়ে যায়। কারণ এটি এমন এক নীতিকে সমর্থন করে যা লেনদেনে বাধার সৃষ্টি করে।

ওই সময়ের চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইও ১৯৬০ সালের এপ্রিলে নয়া দিল্লি সফরের সময় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা যোগ্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয়- এই ভিত্তিতে একটি সমাধান গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন।
লেখক দাবি করেন, তিনি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। চীন তার একতরফাবাদ, সশস্ত্র বাহিনীর জয়লব্ধ পবিত্র ভূখণ্ড বজায় রাখার বিশেষ নীতিতে অগ্রসর হয়। তিনি বিশ্বাস করেন যে ভারত ও চীনের মধ্যকার গভীর হতে থাকা বিভাজনের পরিণতি অপরিমেয়, বিশেষ করে অন্যান্য প্রতিবেশী, বিশেষত পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে।

আনাদুলু এজেন্সি

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us