চীন-পাকিস্তান জোটের বিরুদ্ধে ভারত-ভিয়েতনাম?

মারিয়া সিয় | Aug 30, 2020 08:26 pm
চীন-পাকিস্তান জোটের বিরুদ্ধে ভারত-ভিয়েতনাম?

চীন-পাকিস্তান জোটের বিরুদ্ধে ভারত-ভিয়েতনাম? - ছবি : সংগৃহীত

 

চীনা নৌবাহিনী যখন চলতি সপ্তাহে চারটি সাগরীয় অঞ্চলে একইসাথে মহড়া চালাচ্ছে, তখন অনেকের মধ্যেই শক্তি প্রদর্শন সম্ভ্রম উদ্রেক করেছে, তবে কেউ কেউ কাকে উদ্দেশ্য করে এই আয়োজন, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।

দক্ষিণ চীন সাগর, পূর্ব চীন সাগর, উত্তর পীত সাগর ও বোহাই উপসাগরের মহড়াগুলো দেখে বিশেষজ্ঞরা প্রায় একমত যে এটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী তৎপরতার বেইজিংয়ের জবাব। ওয়াশিংটন সম্প্রতি বিমানবাহী রণতরী পাঠিয়েছে দক্ষিণ চীন সাগরে, তাইওয়ান প্রণালীতে একটি ডেস্ট্রয়ার পাঠিয়েছে, ওই অঞ্চলে গোয়েন্দা বিমান ও বি-১বি বোমারু বিমান পাঠিয়েছে। এর পাশাপাশি চীনের সাথে ভূখণ্ডগত বিরোধে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর পক্ষেও অবস্থান গ্রহণ করেছে।
সাংহাইয়ের ইস্ট চায়না নরম্যাল ইউনিভার্সিটির রাজনীতির অধ্যাপক যোশেফ গ্রেগরি মোহানি বলেন, দক্ষিণ চীন সাগরে, বিশেষ করে তাইওয়ানকে নিয়ে সম্ভাব্য কোনো ঘটনা উস্কে দেয়ার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্তেজনা বৃদ্ধির শঙ্কার মুখে রয়েছে।

চীনের মহড়ায় যে জবাব দেয়া হচ্ছে, তা স্পষ্ট : যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ চায় না চীন। তবে কেউ যদি যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়, যুদ্ধ করতে সক্ষম হয় তবে প্রয়োজনে কয়েকটি রনাঙ্গনে তা হতে পারে।
এই মহড়ার উদ্দেশ্য ওয়াশিংটন হতে পারে। তবে শক্তি প্রদর্শনী কাছাকাছি থাকা দেশগুলোর ওপর প্রভাব পড়বে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এতে করে বিশেষ করে ভিয়েতনাম ও ভারতের মধ্যে সামরিক অংশীদারিত্ব গড়ে ওঠতে পারে। আর এই অংশীদারিত্বের লক্ষ্য হতে পারে চীনকে মোকাবেলা করা, ঠিক যেভাবে ভারতকে মোকাবেলা করার জন্য গড়ে ওঠেছে চীন-পাকিস্তান জোট।

অভিন্ন স্বার্থ
দক্ষিণ চীন সাগরের বিরোধপূর্ণ প্যারাসেল আইল্যান্ডসের অন্যতম উডি আইল্যান্ডে চীন অন্তত একটি এইচ-৬জে ক্ষেপণাস্ত্রবাহী বোমারু বিমান মোতায়েন করেছে, এমন উপগ্রহ চিত্রে ভিয়েতনাম ক্রুদ্ধ হয়েছে।
এর জের ধরে ভিয়েতনামের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত সপ্তাহে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। তাদের ভাষায় এই উপস্থিতি এই অঞ্চলের শান্তিকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে।

গত শুক্রবার ভিয়েতনামি রাষ্ট্রদূত ফাম ষানহ চাউ ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সাথে বৈঠকের সময় ওই ছবিগুলো বেশ গুরুত্ব পেয়েছে বলেই মনে করা যেতে পারে। এই বৈঠকের জের ধরেই মঙ্গলবার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও তার ভিয়েতনামি প্রতিপক্ষ ফাম বিন মিনের সাথে ভার্চুয়াল সভার পরিকল্পনা করা হয়।

অস্ট্রেলিয়ান ডিফেন্স ফোর্স একাডেমির নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস প্রফেসর কারলাইল বলেন, এই প্রথম চীন প্যারাসেলসে বোমারু বিমান মোতায়েন করল তা নয়। ২০১৮ সালেও তারা কয়েকটি এইচ-৬কে দূরপাল্লার বোমারু বিমান পাঠিয়েছিল।
কিন্তু এবার ভিয়েতনাম ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, চীনা পদক্ষেপের ব্যাপারে রাজনৈতিক সমর্থন যোগানোর চেষ্টা করছে দেশটি।

বিষয়টি নিয়ে ভারতের কাছে ছুটে যাওয়ার অর্থ হলো, ভিয়েতনাম কেবল ভারতের সাথে কৌশলগত অংশীদারিত্বই প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে না, সেইসাথে দক্ষিণ চীন সাগরে নৌচলাচলের স্বাধীনতা নিয়ে ভারতের অবস্থানের প্রতিও সমর্থন ব্যক্ত করছে অব্যাহতভাবে।
ভিয়েতনাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সামাজিক বিজ্ঞান ও মানবিক শাখার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের লেকচারার হুন তাম স্যাঙ বলেন, ভারত ও ভিয়েতনাম এখন ভূকৌশলগত অভিন্ন অবস্থান সৃষ্টি করেছে। উভয় দেশই দক্ষিণ চীন সাগরকে চীনের পেছনের আঙিনা হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি নয়।

তিনি বলেন, ভিয়েতনামের কূটনৈতিক উদ্যোগের ফলে ভারত দক্ষিণ চীন সাগরে সম্পৃক্ত হতে আগ্রহী হতে পারে। এর ফলে বেইজিংয়ের প্রতি জোরদার প্রতিরক্ষা সহযোগিতার একটি বার্তা পাঠানো হতে পারে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের আঞ্চলিক কেন্দ্র নেসা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ভিজিটিং ফেলো মোহন মালিক ভারত-ভিয়েতনাম অংশীদারিত্বকে পাকিস্তানের সাথে চীনের সম্পর্কের সাথে সম্পর্কিত করেছেন।
মালিক বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে বেইজিং ও ইসলামাবাদ যেমন ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করছে, সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, সেরকম ভাবেই নয়া দিল্লি ও হ্যানয়ও বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে একে অপরের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতা জোরদার করছে। ভারত মহাসাগরে পাকিস্তান যেভাবে শক্তিশালী চীনা নৌউপস্থিতিকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করছে, ভিয়েতনামও একইভাবে দক্ষিণ চীন সাগরে ভারতীয় নৌউপস্থিতিকে গ্রহণ করছে।

একই রণাঙ্গনের যোদ্ধা
ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী অবস্থান নিয়ে ভিয়েতনাম অব্যাহতভাবে ভারতের মতো অভিন্ন উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। এই অভিমত ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক র্যা ন্ড করপোরেশনের সিনিয়র প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ডেরেক গ্রাসম্যানের।
অবশ্য অনেকে বলছেন, বর্ধিত সামরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় কিছু বাধাও আছে।

মালিক বলেন, ভারত এখন চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুই ফ্রন্টে সত্যিকারের যুদ্ধের মতো অবস্থায় আছে। ফলে ভিয়েতনামকে সে কতটুকু সহায়তা করতে পারবে, তা নিশ্চিত নয়।তবে চীনা নৌবাহিনীর উপস্থিতি নিয়ে দুই দেশ গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় করতে পারে।
ভারত ও ভিয়েতনামের মধ্যকার প্রতিরক্ষা সম্পর্ক ১৩ বছরের। এই সময়ের মধ্যে ভিয়েতনামের উপকূলীয় রক্ষী বাহিনীর কাছে ভারত চারটি ৩৫ মিটারের ওশ্যান টহল জাহাজ বিক্রি করেছে ১০০ মিলিয়ন ডলারের।
ভিয়েতনাম ২০১৪ ও ২০১৬ সালে ভারতের কাছ থেকে ব্রহ্ম ও আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার আলোচনা শুরু করে। কিন্তু ব্রহ্ম ক্ষেপণাস্ত্র ভারত ও রাশিয়া যৌথভাবে উৎপাদন করায় চীনকে ক্রুদ্ধ করার ভয়ে ভিয়েতনামের কাছে বিক্রি করা হয়নি।

তেল ও গ্যাস
ভারত ও ভিয়েতনামের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার আরেকটি সম্ভাব্য ক্ষেত্র হতে পারে দক্ষিণ চীন সাগরে ভিয়েতনামি উপকূলে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান।
এ ধরনের প্রকল্পে উভয় দেশই লাভবান হতে পারে।তবে বেইজিং তা অনুমোদন করবে কিনা তা বলা মুস্কিল। আর চীন সম্মতি না দিলে এখানে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে যাবে।

ভারতের জন্য কী ফায়দা?
দক্ষিণ চীন সাগরে নৌচলাচলের স্বাধীনতার বিষয়টি এড়িয়ে থাকতে পারে না ভারত। এই পথ দিয়ে ভারতের বছরে ২০০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়ে থাকে। আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির লুক ইস্ট নীতিতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক গভীর করার কথা বলা হয়েছে। আর এই কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ভিয়েতনাম।
গ্রসম্যান বলেন, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের নজর সরিয়ে দিতেও ভিয়েতনামের সাথে জোট গড়ার কাছে আগ্রহী হতে পারে ভারত।

ভিয়েতনামের মূল্য?
অবশ্য, হ্যানয় ও নয়া দিল্লি তাদের বিকাশমান অংশীদারিত্বে নিজেদের লাভ দেখতে পেলেও বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিশেষ করে ভিয়েতনামের জন্য সতর্কতা অবলম্বন করা হবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
মোহানি বলেন, চীনের সাথে বর্ধিত সঙ্ঘাত সহ্য করা ভিয়েতনামের জন্য হবে খুবই কঠিন। ভিয়েতনাম জানে, ওয়াশিংটন বা নয়া দিল্লির আগ্রহ আছে ভিয়েতনামের প্রতি। কিন্তু তাদের স্বার্থ আর হ্যানয়ের স্বার্থ পুরোপুরি একই রকম নয়। তাছাড়া এই দুই দেশে সরকার পরিবর্তন হলে ভিয়েতনামের জন্য বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

সূত্র : সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us