ফুসফুসের ক্যান্সার : কেন হয় কী করবেন

অধ্যাপক ডা: মো: ইয়াকুব আলী | Sep 08, 2020 02:12 pm
ফুসফুসের ক্যান্সার : কেন হয় কী করবেন

ফুসফুসের ক্যান্সার : কেন হয় কী করবেন - ছবি সংগৃহীত

 

ফুসফুসের ক্যান্সার একটি প্রাণঘাতী ব্যাধি। বর্তমান বিশ্বে পুরুষদের সব ধরনের ক্যান্সারের ভেতর ফুসফুসের ক্যান্সারের অবস্থান সবার শীর্ষে। পুরুষের মতো মেয়েদের ফুসফুসের ক্যান্সারের হার সর্বাধিক না হলেও এটি একটি অন্যতম কারণ এবং দিনে দিনে এই হার বেড়েই চলছে। ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর প্রতি পাঁচটির মধ্যে একটি হচ্ছে ফুসফুসের ক্যান্সারজনিত। মধ্যবয়স্ক এবং বয়স্কদের মধ্যে এই রোগের হার সবচেয়ে বেশি। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে এই ক্যান্সার নিরাময়ের সম্ভাবনা অধিক।

ফুসফুসের ক্যান্সার আসলে কী?
আমাদের দেহ কোটি কোটি ক্ষুদ্রতম একক কোষের সমন্বয়ে গঠিত। স্বাভাবিক অবস্থায় এই কোষগুলোর বৃদ্ধি ও বিভাজন চলে সুনিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া। কোনো কারণে দেহকোষের সুশৃঙ্খল বিভাজন অনিয়ন্ত্রিত হলে অস্বাভাবিক কোষগুলো থেকে সৃষ্টি হয় টিউমার। এই টিউমার শরীরের অন্যান্য অংশে যদি বিস্তৃতি লাভ না করে কিংবা না ছড়িয়ে পড়ে তাহলে এটিকে বলা হয় নির্দোষ টিউমার বা বিনাইন টিউমার।

পক্ষান্তরে, টিউমারটি যদি আশপাশের কলা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে বিস্তার লাভ করে এবং রক্তপ্রবাহ বা লসিকাপ্রবাহের মাধ্যমে দেহের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে তবে তাকে বলা হয় ক্ষতিকর টিউমার বা ক্যান্সার। রক্ত বা লসিকানালী পথে সংঘটিত ক্যান্সারের বিস্তারকে বলা হয় মেটাস্ট্যাসিস। বেশির ভাগ ফুসফুসের ক্যান্সারের উৎপত্তি হয় ব্রঙ্কাস বা শ্বাসনালীর অন্তর্গাত্রের আবরণী কোষ থেকে (আবরক কলা) তবে অল্প কিছু ক্ষেত্রে বায়ু কুঠুরির অভ্যন্তরীণ আবরণী কোষ থেকেও ক্যান্সারের জন্ম হতে পারে।

ফুসফুসের অভ্যন্তরে ক্যান্সারের বৃদ্ধির ফলে দেখা দিতে পারে কাশি বা রক্তমিশ্রিত শ্লেষ্মা। হৃদযন্ত্রসন্নিহিত রক্ত নালীগুলো কদাচিৎ বিস্তৃত হতে পারে এই ক্যান্সার। লসিকানালীর মাধ্যমে বিস্তৃতির ক্ষেত্রে দেখা দেয় লসিকাগ্রন্থির স্ফীতি। আর, রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে ক্যান্সারের ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, বিশেষ করে, যকৃৎ, অস্থি, মস্তিষ্ক বা অপর ফুসফুস আক্রান্ত হয়।

ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণ
ধূমপান ফুসফুসের ক্যান্সারের সর্বপ্রধান কারণ। ফুসফুসের ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর ৯০ শতাংশ ও সব ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর ২০ শতাংশ ঘটে থাকে ধূমপানের কারণে। তামাকের ধোঁয়ায় থাকে ক্যান্সার উৎপাদক বিভিন্ন উপাদান। ক্রমাগত ধূমপানের ফলে ফুসফুসের বায়ুপথের শ্বাসনালীর, অভ্যন্তরীণ দেওয়ালের আবরক কলায় দেখা দিতে পারে অস্বাভাবিক পরিবর্তন। এই পরিবর্তিত বা অস্বাভাবিক কোষগুলো দ্রুত বিভাজিত হয়ে জন্ম দেয় ফুসফুসের ক্যান্সারের। তবে, ধূমপায়ী ব্যক্তি ধূমপান ছেড়ে দিলে ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস পায়। আবার যারা ধূমপান করেন না অথচ ধূমপায়ীদের সংশ্রবে থাকেন তারাও ঘাতক ব্যাধি ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন। কারণ শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে ওই ধোঁয়া অধূমপায়ীর নাক দিয়ে ফুসফুসে যেয়ে ক্যান্সারের জন্ম দেয়। ধূমপানের ফলে অন্যান্য স্থান, যেমন- মুখ, জিহ্বা, বাকযন্ত্র বা ল্যারিঙ্কস, খাদ্যনালী ও মূত্রথলীতেও ক্যান্সার হতে পারে।

ফুসফুসের ক্যান্সারের উপসর্গ
ফুসফুসের ক্যান্সারের উপসর্গ নির্ভর করে মূলত ক্যান্সারের আকার ও অবস্থানের ওপর। রোগের প্রাথমিক অবস্থায় কোনো উপসর্গ নাও থাকতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে বুকের এক্সরে পরীক্ষায়ই এ- রোগ ধরা পড়ে। এই পর্যায়ে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ রোগীর ক্যান্সার ফুসফুসেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং অস্ত্রোপচারের সাহায্যে এর চিকিৎসা সম্ভব।

ফুসফুসে ক্যান্সারের সচরাচর উপসর্গ
ষ স্থায়ী কাশি ও শ্বাসকষ্ট, ষ বুক ব্যথা, ষ রক্তরঞ্জিত শ্লেষ্মা, ষ ওজন হ্রাস, ষ স্বরভঙ্গ।

আপনার বয়স যদি চল্লিশের উপরে হয় এবং উপরোক্ত এক বা একাধিক উপসর্গ যদি দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।

রোগ নির্ণয়
ধূমপানের অভ্যাসসহ রোগের ইতিহাস ও শারীরিক পরীক্ষা, বুকের এক্সরে, ক্যান্সারাক্রান্ত কোষের উপস্থিতি দেখার জন্য শ্লেষ্মার অনুবিক্ষণিক পরীক্ষা, ব্রঙ্কোস্কোপি (ফুসফুসের বায়ুপথে ব্রঙ্কোস্কোপ নামক যন্ত্র প্রবেশ করিয়ে এই পরীক্ষা করা হয়), বায়োপসি ও হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা, সিটি গাইডেড এফএনএসি করা হয়।

ফুসফুসের ক্যান্সারের চিকিৎসা
ফুসফুসের ক্যান্সারের চিকিৎসা তিন ভাবে করা যায়। সেটা নির্ভর করে ক্যান্সারের আকার, ব্যাপ্তি ও হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষার (কোষের ধরন) ওপর। কখনো কখনো একাধিক চিকিৎসাপদ্ধতি সমন্বয়ের প্রয়োজন হয়ে থাকে।

১. সার্জারি বা শল্যচিকিৎসা : এতে আক্রান্ত ফুসফুসের অংশটি শরীর থেকে অপসারণ করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ের ও ক্ষুদ্রাকৃতি ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে ফুসফুসের ক্যান্সার নিরাময়ে সম্ভাবনা সর্বাধিক।

২. রেডিওথেরাপি : এই পদ্ধতিতে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার জন্য উচ্চশক্তির বিকিরণ রশ্মি প্রয়োগ করা হয়। এ জন্য ব্যবহৃত হয় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এক্সরে মেশিন, লিনিয়ার এক্সিলেটার, কোবাল্ট ইউনিট ইত্যাদি যন্ত্র।

৩. কেমোথেরাপি : এই পদ্ধতির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় ক্যান্সারবিধ্বংসী ওষুধ। অধিকতর অগ্রসর বিশেষ ধরনের ফুসফুসের ক্যান্সারের চিকিৎসায় কেমোথেরাপির ব্যবহার করা হয়।

ফুসফুসের ক্যান্সার প্রতিরোধে করনীয় : ধূমপান করবে না। যদি ধূমপান না করেন, তবে আরম্ভ করবেন না। আর যদি ইতোমধ্যে শুরু করে থাকেন তাহালে এখনি বন্ধ করুন। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এক্সরে করান (অধিক মাত্রার ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে এক বছর অন্তর অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী)।

ধূমপান বর্জন করবেন কীভাবে : একটি তারিখ নির্ধারণ করে সেই তারিখ থেকে চিরতরে ধূমপান বন্ধ করুন। দু-তিন সপ্তাহের ভেতর ধূমপানের মাত্রা কমিয়ে আনুন এবং এরপরে চিরতরে বন্ধ করুন।

ধূমপান বর্জনে ইচ্ছা শক্তি গড়ে তুলুন
ষ কখনো সাথে সিগারেট রাখবেন না। ধূমপায়ীদের বর্জন করুন। দিনের সর্বাধিক ‘উপভোগ্য’ সিগারেটগুলো যেমন রাতের খাবারের পরে, চা বা কফির পরে বর্জন করুন।
ষ দৈনন্দিন কার্যসূচিতে পরিবর্তন আনুন। এমন কিছু করুন যাতে হাতের ব্যবহার হয় অথবা পায়ের ব্যায়াম (যেমন- হাঁটাহাঁটি, জগিং ইত্যাদি) হয়।
ষ বেশী করে পানি পান করুন এবং তাজা ফলমূল ও শাক-সবজি, গাজর খান। তবে অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ করবেন না
ষ অন্যদের জানতে দিন যে, আপনি ধূমপান বর্জনের চেষ্টা করছেন।
ষ ধূমপান ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরুন- এই চ্যালেঞ্জ আপনার জন্য শুভ ফল বয়ে আনবে।
ষ ধূমপান বর্জনের ফলে বেঁচে যাওয়া অর্থ সঞ্চয় করুন।
ষ ক্যান্সারের প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা আপনার জীবন বাঁচাতে পারে।
ষ প্রাণঘাতী ফুসফুসের ক্যান্সার হতে নিজেকে রক্ষা করুন।

আপনি যদি ধূমপায়ী হন এখনি ধূমপান ছেড়ে দিন। আপনি যদি অধূমপায়ী হন- ভবিষ্যতে কখনো ধূমপান করবেন না।
ক্যান্সারের সার্বিক প্রতিরোধ, দ্রুত ও সঠিক রোগ নির্ণয়ে এবং উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করে মারণব্যাধি ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসুন।

লেখক : টিউমার ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ, মেডিকেল অনকোলজি, শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, শেরে-বাংলা নগর, ঢাকা

মোবাইল : ০১৭৩২৪২৯৩৯০, ০১৬৪৪৪৩৩৪৯৮


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us