আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী : বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন | Dec 15, 2020 04:53 pm
আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী - ছবি সংগৃহীত

 

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব, ঢাকা বারিধারা জামিয়া মাদানিয়ার প্রধান পরিচালক, বরেণ্য আলিমে দ্বীন, আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ: ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। বয়োবৃদ্ধ এই জ্ঞানতাপসের ইন্তেকালে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত নামাজে জানাজায় লাখো মানুষের ঢল নামে। বহু মানুষকে কাঁদতে দেখা যায়। এতে তার গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার পরিমাপ করা যায়। জাতির এক সঙ্কট মুহূর্তে তার চিরবিদায় মেনে নিতে অনেকের কষ্ট হচ্ছে; কিন্তু মৃত্যু অমোঘ, আল্লাহ তায়ালার অলঙ্ঘনীয় বিধান। এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত্যে ছেয়ে, সব চেয়ে পুরাতন কথা, সব চেয়ে গভীর ক্রন্দন; যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।

কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী এই মনীষী গোটা জীবন ইলমে দ্বীন আহরণ ও বিতরণে অতিবাহিত করেন। সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থাকলেও পঠন-পাঠন থেকে বিচ্যুত হননি। বিশ^খ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দ হতে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করার পর ১৯৭২ সালে তিনি উত্তর প্রদেশের মুজাফফরনগর জেলায় আল্লামা কাসেম নানুতুভী রহ: প্রতিষ্ঠিত একটি মাদরাসায় পাঠদান শুরু করেন। এক বছর সেখানে শিক্ষকতা করার পর ১৯৭৩ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। শরীয়তপুর, ফরিদাবাদ ও মালিবাগ মাদরাসায় ১৫ বছর শিক্ষকতা করে ছিলেন। ১৯৮৮ সালে ঢাকার ডিপ্লোম্যাটিক জোন বারিধারা নতুনবাজার মোড়ে প্রতিষ্ঠা করেন জামিয়া মাদানিয়া নামে একটি দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। ৩২ বছরে তিলে তিলে তিনি এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ইলমি-আমলি উন্নয়নের পাশাপাশি এর অবকাঠামোগত অগ্রগতি রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। এখন এটি দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় মাদরাসা। তিনি এই মাদরাসার পূর্ণকালীন শায়খুল হাদিস ছিলেন। এ ছাড়া আরো বেশ কয়েকটি মাদরাসায় তিনি বুখারি শরিফের দরস দিতেন। তার হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু মাদরাসা। তিনি প্রায় ৪৫টি মাদরাসার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এর মধ্যে তুরাগ নদীর তীরে অবস্থিত জামিয়া সুবহানিয়া মাহমুদনগর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি এই মাদরাসারও প্রধান পরিচালক ছিলেন। এর ক্যাম্পাসে তিনি সমাহিত হলেন।

হাদিস শাস্ত্রে মরহুমের দক্ষতা ও পাণ্ডিত্য সর্বজন স্বীকৃত। হাদিসের দরস প্রদানে তিনি তার দেওবন্দ উস্তাদদের নিয়ম-রীতি অনুসরণ করে চলতেন। বিশেষভাবে, তার শ্রদ্ধাভাজন উস্তাদ দারুল উলুম দেওবন্দের শায়খুল হাদিস আল্লামা আনজার শাহ কাশ্মিরি রহ: ও আল্লামা সাঈদ আহমদ পালনপূরী রহ:-এর পাঠদান পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। ফলে তার কাছে হাদিস পড়ার জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহ লক্ষ করা যেত। কঠিন ও দুর্বোধ্য বিষয়গুলো বোধগম্য ভাষায় উপস্থাপনার দক্ষতার কারণে তিনি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সুদীর্ঘ ৪৮ বছর তিনি হাদিসশাস্ত্রে অধ্যাপনা করেন। গোটা দেশে ছড়িয়ে আছে তার লাখ লাখ শিষ্য, ছাত্র ও শুভাকাক্সক্ষী। হাজার হাজার বিজ্ঞ আলেম-ওলামার তিনি ছিলেন উস্তাদ।

বহুমাত্রিকতা ছিল আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ:-এর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের রাজনীতির সাথে তার সম্পৃক্ততা ছিল নিবিড়। ২০১৫ সালে এই দলের মহাসচিব নির্বাচিত হন। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার তথা কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের তিনি ছিলেন সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং হাইয়্যাতুল উলিয়া (৬টি কওমি শিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ে গঠিত সর্বোচ্চ পরিষদ)-এর কো-চেয়ারম্যান। এ ছাড়া আরো অনেক অরাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে ছিল তার সরাসরি সম্পৃক্ততা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ছিলেন সর্বদা সরব ও সোচ্চার। জাতীয় শিক্ষানীতি, স্কুলের পাঠ্যপুস্তক সংশোধন, নারীনীতি, আইনের শাসন, ধর্ষণপ্রবণতা, মাদকের আগ্রাসন, সন্ত্রাস, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, ফিলিস্তিন সমস্যা, কাশ্মিরিদের বিশেষ অধিকার, অবারিত দুর্নীতি, স্বজনতোষণ, ব্যাংক লুণ্ঠন প্রভৃতি বিষয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ মতামত পেশ এবং জাতিকে নির্দেশনা প্রদান করেন। তসলিমা নাসরিনের বহিষ্কার, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদ, থেমিস দেবির মূর্তি অপসারণ, ফ্রান্সে নবী সা: অবমাননার প্রতিবাদে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের ১৩ দাবি আদায়ে ঢাকা অবরোধে তিনি নেতৃত্ব প্রদান করেন। সে সময় তিনি ছিলেন হেফাজতের ঢাকা মহানগর সভাপতি। জীবনের শেষের দিকে হুইল চেয়ারে বসে রাজপথে মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক দলের নেতা হিসেবে তার ভূমিকা ছিল অনন্য। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার সাহসী ভূমিকা জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও জাতীয় অখণ্ডতার পক্ষে তার বক্তব্য ছিল দ্ব্যর্থহীন। খোলাফায়ে রাশেদিনের আদলে একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল তার আজীবন সাধনা।

আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে উঠে, কোনো প্রলোভন ও চাপের কাছে মাথা না করে সত্য ও ন্যায়ের পতাকাকে সমুন্নত রাখতে সক্ষম হন তিনি। হক ও আদর্শের প্রশ্নে ছিলেন অটল-অবিচল। কাদিয়ানিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে দেশব্যাপী সফর করে জনমত সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন। আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ:-এর মূল্যায়ন করে গবেষক এ মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য ‘আত্মবিক্রয়, আত্মপ্রতারণা, বীর সাজার অস্থিরতা, পার্থিব মোহের পিছু ধাওয়া এবং শাসকদের তুষ্টিবিধান ইত্যাদির মচ্ছবে তিনি বরাবরই নিজেকে আলাদা রেখেছেন।’ দেশ ও জাতির সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্তে তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সুচিন্তিত আর বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। ভারতে শায়খুল ইসলাম আল্লামা হোসাইন আহমদ মাদানী রহ: যেমন শিরক, বিদআত, কুসংস্কার ও ব্রিটিশ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন তেমনি বাংলাদেশে নূর হোসাইন কাসেমী রহ: একই ভূমিকা পালন করেন।

ব্যক্তিজীবনে আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী ছিলেন এক স্বীকৃত বুজুর্গ ও দরবেশ। নফল নামাজ, জিকির-আজকার, পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত, ইসলামী গ্রন্থ অধ্যয়নের প্রতি তার আগ্রহ ছিল। প্রতি রমজান মাসে ৩০ দিন মসজিদে অবস্থান করে ইবাদতে মশগুল থাকতেন। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া সেসময় দেখা-সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা সীমিত রাখতেন। পরিমিতিবোধ ও মধ্যমপন্থা অবলম্বন ছিল তার জীবনের অন্যতম বিশিষ্টতা। উগ্রবাদিতা বা অতিমাত্রিক শৈথিল্যের পথ তিনি পরিহার করে চলতেন। সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর জীবন পরিচালনায় অভ্যস্ত হলেও কমান্ডিং টোনে নির্দেশনা দিতে ভুল করতেন না। বিনয়, সৌজন্য ও অতিথিপরায়ণতা তার চরিত্রের আলোকিত দিক। যেকোনো দল-মতের মানুষকে সহজে আপন করে নেয়ার এক সহজাত গুণ ছিল তার। উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্টের মতো জটিল রোগ নিয়ে বার্ধক্যের ভারে ন্যুব্জ এই সাধক বুখারীর সবক প্রদান এবংপ্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আঞ্জাম দিতেন।

পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত, অর্থ অনুধাবন, কুরআনের বিধি-নিষেধ প্রতিপালন ও কুরআন চর্চার প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব ছিল তার। তিনি নিজেই প্রতিদিন বিশেষ করে রমজান মাসে অধিকতর সময় কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং বিভিন্ন আয়াতের প্রয়োজনীয় নোট নিতেন। তিনি সর্বদা বলতেন, কুরআন হলো ইলমে ওহির ফল্গুধারা এবং আল্লাহ তায়ালার মারিফাতের ধনভাণ্ডার। এই স্রোতধারায় অবগাহন ছাড়া প্রাজ্ঞ আলিম হওয়া সম্ভব নয়।’ তিনি দু’টি গুণ অর্জনের জন্য তার শিষ্য ও অনুসারীদের নসিহত করেন। এক : অহঙ্কার বর্জন (তাকাব্বুর); দুই পরমুখাপেক্ষিতা পরিহার (ইসতিগনা)। এই দু’গুণ অর্জন করতে পারলে আলেম-ওলামার শান-মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। বিত্তশালী ও শাসকশ্রেণীর সাথে অতি মাখামাখি তার অপছন্দ ছিল। বিপদে ধৈর্য ধারণে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তার প্রতিষ্ঠিত বারিধারা মাদরাসা কিছুদিনের জন্য হাতছাড়া হয়ে গেলেও ধৈর্য হারাননি। অন্য জায়গায় অপরিসর স্থানে মাদরাসা স্থানান্তর করে পড়ালেখা অব্যাহত রাখেন।

শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন উচ্চমার্গের এক আধ্যাত্মিক সাধক। ব্যক্তি চরিত্রের উৎকর্ষ, সামাজিক সংহতি ও রাজনৈতিক শুদ্ধতার জন্য আত্মপরিশুদ্ধিকে তিনি অপরিহার্য মনে করতেন। তাজকিয়ায়ে নাফস বা আত্মশুদ্ধি একটি পবিত্র সাধনা। এর মাধ্যমে মন্দকর্ম পরিহার ও সৎকর্মের প্রেরণা তৈরি হয়। অন্তরকে কলুষমুক্ত করতে পারা জীবনের বিরাট সাফল্য। এই ধারায় তিনি দিনের পর দিন মেহনত করে গেছেন। দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার অগুনতি রূহানি শিষ্য। ১৯৭৩ সালে শায়খুল হাদিস আল্লামা জাকারিয়া কান্ধলভির হাতে বাইয়াত নিয়ে সত্যসাধনার সবক নেন। ১৯৯৫ সালে বিশ^খ্যাত ফকিহ মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহির কাছে থেকে খিলাফত লাভ করেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত ‘মাহমুদিয়া খানাকাহ’-এর তিনি ছিলেন প্রধান। তিনি বিশ্বাস করতেন, দ্বীন শিখতে হলে ব্যাপক অধ্যয়ন ও আহলে দ্বীনের সান্নিধ্য লাভ জরুরি। সাহাবায়ে কেরাম আদর্শ মানুষ হয়েছেন রাসূলুল্লাহ সা:-এর সোহবত ও তারবিয়তের মাধ্যমে। পাপ ও তাকওয়া একসাথে চলতে পারে না। তাই পাপমুক্ত জীবনের সাধনা অপরিহার্য।

তার সাথে আমার নিজের মুহাব্বতের সম্পর্ক ছিল। ফোন করে আমার খোঁজ-খবর নিতেন। তার অনুপমস্নেহ ধন্য হয়েছি। সময় সুযোগ নিয়ে বারিধারা মাদরাসায় গিয়ে তার দোয়া নিয়েছি বেশ ক’বার। গত ১৫ নভেম্বর চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসায় হেফাজতে ইসলামের জাতীয় প্রতিনিধি সম্মেলনে তার সাথে শেষ দেখা হয় এবং তার বক্তব্য শোনার সুযোগ হয়েছে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। অনন্তের পথে তার এই যাত্রা মুবারক হোক। ব্যক্তিচরিত্র গঠন, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা, ইসলাম বিদ্বেষী মহলে বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং দ্বীনি শিক্ষার বিকাশধারায় তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। দেশ ও জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে তার মতো একজন অভিভাবক মনীষীর ইন্তেকাল এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করল। আখিরাতে আল্লাহ তায়ালা তার দারাজাত বুলন্দ করে দিন।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us