প্রাচ্যবাদের রাজনৈতিক অভিপ্রকাশ

মুসা আল হাফিজ | May 10, 2021 01:11 pm
নেপোলিয়ন

নেপোলিয়ন - ছবি : সংগৃহীত

 

নেপোলিয়ন বোনাপার্টকে (১৭৬৯-১৮২১) দিয়ে শুরু করা যাক। তার মিসর আক্রমণ ইসলামের ইতিহাসে একটি নতুন ও ভয়াবহ যুগের সূচনা ঘটায়। এর আগেও মুসলমানরা খ্রিষ্টানদের হাতে বহু যুদ্ধে হেরেছেন। কিছু দিন পরে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু ১৭৯৮ সালে উত্তর কায়রোর আমবাবাহ যুদ্ধক্ষেত্রে নেপোলিয়নের সেনাদের কাছে মিসরীয় মুসলিমদের পরাজয় কেবল সামরিক পরাজয় ছিল না। এটা ছিল ইসলামের একটি যুগের পরিসমাপ্তি এবং ব্যাপকতর পরাজয়।

এর পরই মুসলিমরা নিজেদেরকে পরাজিত ও শাসিত জাতি হিসেবে ভাবতে শুরু করল। পশ্চিমারা নিজেদেরকে বিজয়ী ও শাসক শক্তি হিসেবে দাঁড় করাল। মুসলিম জীবনের তখন ঘোর দুঃসময়। মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ শক্তি লুপ্তির দিকে ধাবমান। মুসলিম সভ্যতা হারিয়ে ফেলেছে গতি ও উদ্যম, প্রাণের সাড়া ও তরঙ্গ। বৃহত্তর সমাজ হয়ে উঠেছে জীবনের পোড়োভূমি। শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তা, রাজনীতি, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, জাতিগত আত্মপরিচয়, ঐক্যবোধসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই এসেছে অবক্ষয়, গতিরিক্ততা। মানসিক পরাজয় সঙ্কীর্ণ করে দিচ্ছিল মুসলিম সভ্যতার বোধের জমি। ধর্ম হয়ে উঠছিল আচরিত প্রথা ও পদ্ধতির নাম। পশ্চিমা জীবনের যে সব প্রবণতা দু’দিন আগেও মুসলিমদের চোখে ছিল হেয়তর, বানের পানির মতো তা ঢুকতে শুরু করল মুসলিম জীবনে। এই যখন পরিস্থিতি, নবজাগরণের তরঙ্গে উদ্দাম ফরাসিদের কাছে মিসর বিজয় হয়ে উঠল সহজ ব্যাপার। দেশ দখলের পর দেশ শাসনের প্রশ্ন এলো। এখানকার মানুষ মুসলিম। তারা পরাধীন হয়েছে। তাদের জীবনাদর্শ ইসলাম। সে কি কোনো শক্তি? কোনো প্রতিরোধ? কোনো হুমকি? সে কি মৃত কোনো অতীত? প্রাণহীন স্মৃতিচিহ্ন? কিংবা কোনো অসুখি ব্যবস্থা, যার মৃত্যু খুবই বাস্তব? নেপোলিয়ন এ প্রশ্নের জবাব খুঁজলেন কনস্টান্টাইন ফ্রান্সিসকো কোঁতে ডি ভোলনির (১৭৫৭-১৮২০) কাছে।

ভোলনির রচনায় নেপোলিয়ান দেখলেন এক গোয়েন্দা রিপোর্ট। মুসলিম সংস্কৃতির অন্তরতলে ঢুকে পড়া এক দৃষ্টিবান প্রতিবেদকের বয়ান। ভোলনি থেকে নেপোলিয়ন লাভ করেন ক্রমানুসারে সাজানো সমস্যা এবং ফরাসি দখলাভিযানে সেনাবাহিনীকে যে সব বাধার মোকাবেলা করতে হবে, তার তালিকা। বলা বাহুল্য, সেসব বাধার প্রথমটিই হচ্ছে ইসলাম।

নেপোলিয়ন ইসলামকে জানতেন গভীর অর্থে। কৈশোর থেকে তিনি পাঠ করছিলেন ইসলামকে। তরুণ বয়সে লিখেছিলেন ম্যারিনির ইস্তওয়ার দ্য এরাবস-এর একটি সারসংক্ষেপ। তার আস্থা ছিল ভোলনির ইসলাম বিশ্লেষণে। ফরাসি এই প্রাচ্যবিদ ১৭৭২ সালে ভ্রমণ করেন মিসর ও সিরিয়া। ভ্রমণকাহিনী লিখেন ফরাসি ভাষায় ‘ভয়েজ আঁ মিসর আঁ সিরিয়া’। যার ইংরেজি অনুবাদ দুই খণ্ডে, Travels in Syria and Egypt নামে বিশ্বময় পঠিত। এ রচনা ছিল সফরনামার চেয়ে অধিক কিছু। এ ছিল এক গাইড বুক, প্রাচ্যবিজেতার জন্য। যে প্রাচ্যে অনাগ্রহী, এ ছিল তার জন্য আগ্রহের নতুন এক হাতছানি। ভোলনি জানতেন, তার রচনা পশ্চিমা যুবকদের করবে প্রাচ্য দখলে আগ্রহী। অভিযাত্রী আর রাজাদের উদ্বুদ্ধ করবে অভিযান পরিচালনায়।

তার বই চলে গেল পশ্চিমা শাসকদের হাতে। রাশিয়ার জার কাতরিনের হাতে। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের হাতে। কাজ হলো দ্রুত।

বিচক্ষণ ও সতর্ক ভোলনি ইসলামকে জানতেন একটি জীবন্ত শক্তি হিসেবে। ওসমানী সালতানাতের মোকাবেলা তার বিবেচনায় ছিল সাধারণ বিষয়। কিন্তু ‘ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ছিল সবচেয়ে কঠিন ও গভীর।
একজন পশ্চিমা দখলদার মুসলিম জগতের মুখোমুখি কিভাবে হবেন, ভোলনির রচনায় এর প্রতিটি ধাপ পরিষ্কার। তার সফর বিবরণকে ভাবা হতো পাখির চোখে দেখা মুসলিম জীবন ও ভূগোলের চিত্র হিসেবে। যা প্রাচ্যে-পাশ্চাত্যের দখলদারিকে স্বাভাবিক করে তোলে। কিন্তু গ্রন্থটির আবেদন ছিল আরো বেশি। কারণ দখলদারির পরে দেখা গেল তার আসল উপযোগিতা। সে উপদেষ্টার কাজ করল এবং বলল, এবার লড়াই অন্যরকম, এবার প্রতিপক্ষ ইসলাম।
অতএব, ইসলামের বিরুদ্ধে নির্বাচিত ও দৃষ্টান্তহীন একটি যুদ্ধ শুরু করার গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে নেপোলিয়ান সবার জন্য সমান সুযোগের বিপ্লবাত্মক ভাবাদর্শের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। মুসলিমদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য নিয়োগ দেন একদল প-িত আর চিন্তা চর্চার জন্য গড়ে তোলেন আধুনিক ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রতিষ্ঠান।

এ ছিল এক অভিযান, ইসলামের বিরুদ্ধে; কিন্তু নেপোলিয়ন সর্বত্র প্রমাণের চেষ্টা করেন, এ প্রয়াস ইসলামের জন্যই। তিনি যা বলতেন, তার সবই কুরআনের ব্যবহৃত ভাষা আরবিতে অনূদিত হতো। ফরাসি সেনাবাহিনীর উপরস্থ কামান্ডারদের ওপর নির্দেশ ছিল, যেন সব সময় ইসলামের ধর্মীয় আবেগের কথা মনে রাখা হয়। নেপোলিয়নের বক্তব্য থেকে ইসলামের প্রতি ঝরে পড়ত শ্রদ্ধা ও অনুরক্তি।

কুরআনের উদ্ধৃতি তিনি দিতেন এবং পৃথিবীকে ইসলামের পরিবার বানানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করতেন। জামে আল আজহারের প্রধান আলেমদের আমন্ত্রণ জানাতেন আপন ডেরায় এবং তাদের জানানো হতো সামরিক সম্মান। যখন নেপোলিয়ন পরিষ্কার উপলব্ধি করলেন মিসরীয়দের উপর দখলদারিত্ব বজায় রাখার জন্য তার সেনাবাহিনী খুবই অপ্রতুল, তখন তিনি স্থানীয় ইমাম, কাজি, মুফতি ও আলেমদের দিয়ে কুরআনের এমন ব্যাখ্যা প্রচার করালেন, যাতে মনে হয় তার সেনাবাহিনী ইসলামের পক্ষের শক্তি। অচিরেই দখলদারের প্রতি নিজেদের ঘোরতর অবিশ্বাসের কথা ভুলে গেল মিসরের মানুষ। নেপোলিয়ন যখন মিসর ছাড়বেন, তখন তার ডেপুটি জন ব্যাপ্টিস্ট ক্লেবারকে (১৭৫৩-১৮০০) কড়া নির্দেশ দিলেন তার এই কর্মপদ্ধতি অবলম্বনের জন্য। কারণ অন্য যেকোনো রাজনীতি খুবই ব্যয়সাপেক্ষ মূর্খতা।

ফরাসি কবি ভিক্টর মেরি হুগো (১৮০২-১৮৮৫) নেপোলিয়নের এই কৌশলী যুদ্ধজয়কে অভিনন্দিত করেছেন তার কবিতায়। তাকে সকৌতুকে অভিহিত করেছেন পশ্চিমের মেহমুত (মুহাম্মদ) হিসেবে! মুসলিমরা সরল বিশ্বাসে তাকে মুসলিম হিসেবে ভাবতে চেয়েছে। আজো বহু মুসলিম নেপোলিয়নকে ইসলামের একজন হিসেবে ভেবে তৃপ্তি পায়। লেখালেখি করেন, নেপোলিয়ন কিভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন বা ইসলামের প্রেমে পড়েছিলেন? নেপোলিয়নের চারপাশের মুসলিমরা ছিলেন অধিকতর বাহ্যিকতায় বিশ্বাসী। পোশাকি উপস্থাপন তাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল এবং তারা হেরে গেলেন।

জয়ী হলেন নেপোলিয়ন। তার জয় কেবল যুদ্ধ ও শাসনে সীমিত থাকল না। মিসরে সংক্ষিপ্ত সময়ের অবস্থানকালে তিনি পাল্টে দিলেন মুসলিম আইন। রাষ্ট্রীয়ভাবে জারি করা হলো ফরাসি আইন ও বিচারব্যবস্থা। ইসলামী আইনকে আবদ্ধ করা হলো বিয়ে, তালাক ও উত্তরাধিকারের আওতায়। এ হয়ে উঠল কেবল ব্যক্তিগত রীতি। মুসলমানদের গোটা ইতিহাসে এ ছিল প্রথম ঘটনা। ব্রিটিশ, ডাচ ও পর্তুগিজরা এত সহজে এটা ভাবতেই পারছিল না। তারা জানতে চাচ্ছিল, কিভাবে এটা সম্ভব হলো ফরাসিদের দ্বারা? কিন্তু যা ঘটার, ঘটে গিয়েছিল। মুসলমানরা মোহগ্রস্ত তখন নেপোলিয়নের আলেম ও প্রাচ্যবিদদের পরিবেশিত ইসলামে।

সেন্ট হেলেনায় জেনারেল হেনরি জেটিয়েন বার্ট্রান্ডকে (১৭৭৩-১৮৪৪) শুনানো স্মৃতিচারণে নেপোলিয়ন মিসর ও সিরিয়ায় তার সাফল্যের জন্য প্রাচ্যবিদ ভোলনির রচনাবলির ণ স্বীকার করেছেন। ভোলনি তাকে বলে দিচ্ছিলেন, কী করতে হবে এবং কী না করা উচিত। প্রাচ্য তার কাছে ছিল দুর্বোধ্য এক জটিল জগত, কিন্তু ভোলনি প্রাচ্যের অজ্ঞাত অংশগুলোকে নেপোলিয়নের হাতে তুলে দিলেন মটরের দানার মতো। তিনি বাতলে দিলেন দখল ও শাসনের ক্ষেত্রে সমস্যা ও তার সমাধান।

অরিয়েন্ট নামক ফ্ল্যাগশিপে বসে মিসরীয়দের উদ্দেশে নেপোলিয়ন যখন ঐতিহাসিক বক্তৃতা দেন, তখন তার চারপাশে ছিলেন একদল প্রাচ্যবিদ। মিসর শাসনের জটিল মুহূর্তগুলোতে তিনি যখন বিশেষ কক্ষে অস্থির পায়চারি করতেন, তখনো তার পাশে থাকতেন কিছু প্রাচ্যবিদ। মিসর আক্রমণের আগ থেকেই তিনি ব্যবস্থা করে রাখছিলেন যথেষ্ট সংখ্যক সৈন্যের আর যথেষ্ট সংখ্যক প্রাচ্যবিদের। যার প্রমাণ মেলে ১৭৯৩ সালের ৩০ মার্চ আরবি, ফারসি ও তুর্কি ভাষা শিক্ষা দেয়ার জন্য ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে ইকোল পাবলিক প্রতিষ্ঠার ঘোষণায়।

ইকোল পাবলিকের প্রথম আরবি শিক্ষক ছিলেন সিলভেস্ত্র দে সেসি (১৭৫৮-১৮৩৮)। তার বহু ছাত্র ছিলেন মিসর আক্রমণে নিপোলিয়নের সঙ্গী। তারা কেউ অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি। কিন্তু তারা ছিলেন নেপোলিয়নের সবচেয়ে মূল্যবান যোদ্ধা। বোনাপার্ট তাদেরকে দক্ষ হাতে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এ ব্যবহারের কৃতিত্ব তার একার নয়। কারণ তার আগে ও পরে ইউরোপ প্রাচ্যবিদদের কাজে লাগিয়েছে গোপন, প্রবল অস্ত্র হিসেবে।

অসমাপ্ত


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us