খাবার টেবিলের আদবকেতা

তাসফিয়া তাজিন | Sep 03, 2019 02:13 pm
খাবার টেবিলের আদবকেতা

খাবার টেবিলের আদবকেতা - ছবি : সংগ্রহ

 

রেস্তরাঁয় খাওয়া, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের দাওয়াত রক্ষা বা অফিসিয়াল ডিনার বা লাঞ্চ, সব জায়গাতেই খাবার টেবিলের কিছু আদবকেতা মানা জরুরি; নয়তোবা লোকে আড়ালে ‘আনকালচার্ড’ বলবে। খাবার টেবিলের আদবকেতাকে ইংরেজিতে বলা হয় টেবিল ম্যানারস। টেবিল ম্যানারস জানা থাকলে সবরকম সামাজিক পরিবেশেই খাওয়ার অভিজ্ঞতা সুখকর হয়। টেবিল ম্যানারস এক্সপার্টদের কাছ থেকে আপনাদের জন্য খাবার টেবিলের নানারকম নিয়ম কানুন জেনে নিয়ে লিখেছেন কাজী তানজিলা মেহনাজ। 

যদিও এলাকা বা দেশ ভেদে টেবিল ম্যানারস কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। ফর্মাল এবং ইনফরমাল দাওয়াত বা রেস্তরাঁয় খাওয়ার ক্ষেত্রেও টেবিল ম্যানারস কিছুটা আলাদা হতে পারে, কিন্তু বেসিক কিছু নিয়ম আছে যা সব জায়গাতেই প্রযোজ্য। চলুন জেনে নেই নিয়মগুলো-

ন্যাপকিনের নিয়মকানুন
দাওয়াতে বা বিভিন্ন রেস্তরাঁয় খাবার টেবিলে খাবার প্লেটের পাশে একটি ন্যাপকিন সাজানো থাকে। এটি কখনো তিন কোণা করে ভাঁজ করা থাকে, কখনো ফুল, হাঁস ইত্যাদির আকৃতিতে সাজানো থাকে। অনেকেই দ্বিধায় ভোগেন যে এই ন্যাপকিনের কাজ আসলে কী?
১. নিয়ম হলো খাবার টেবিলে বসে খাবার শুরুর আগে এই ন্যাপকিনটি খুলে কোলের ওপর বিছিয়ে নিতে হবে। এতে করে খাবার বা ঝোল পরে আপনার কাপড়ে দাগ লাগার সম্ভাবনা কম থাকে।
২. শিশুদের ক্ষেত্রে এই ন্যাপকিন কোলের ওপর না বিছিয়ে পোশাকের কলারের সাথে ন্যাপকিনের একপ্রান্ত গুঁজে দিতে হবে, যাতে শিশুদের বুক ও পেট ঢাকা থাকে।
৩. খাবারের মাঝে যদি টেবিল ছেড়ে উঠতে হয় তখন ন্যাপকিনটি আপনার চেয়ারের সিটে রাখুন।
৪. খাবার শেষে ন্যাপকিনটি ভাঁজ করে আপনার প্লেটের বাঁ-পাশে রাখুন।

খাবার খেতে শুরু করবেন কখন?
খাবার পরিবেশন করার পর খাবার নিজের প্লেটে তুলে খেতে শুরু করবেন? একদমই না। টেবিলে বসা প্রত্যেক ব্যক্তির প্লেটে খাবার পরিবেশন করা হওয়ার পরেই খেতে শুরু করুন। খেয়াল রাখবেন মুখভরতি খাবার নিয়ে কখনোই কথা বলবেন না। মুখের খাবার ছিটে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি কেউ যদি কোনো প্রশ্নও করে, মুখের খাবার শেষ করে উত্তর দিন।

খাবার পাসিংয়ের নিয়ম
নির্দিষ্ট পাত্র থেকে খাবার নিজের প্লেটে বেড়ে নেয়ার পর নিয়ম হলো, পাত্রটি আপনার ডানদিকের যিনি বসেছেন তার হাতে দেয়া যাতে তিনিও খাবারটি নিজের প্লেটে তুলে নিতে পারেন। তারপর তিনি তার ডানদিকের ব্যক্তিকে খাবারের পাত্রটি পাস করবেন। কোনো খাবার টেবিলের অপর প্রান্তে থাকলে টেবিলের ওপর ঝুঁঁকে পড়ে সেই পাত্রটি আনতে যাবেন না। পাত্রটির কাছাকাছি বসেছে এমন কাউকে অনুরোধ করুন পাত্রটি পাস করতে।

খাবার শেষের সৌজন্য
১. আপনার খাবার খাওয়া শেষ হলেই উঠে পড়বেন না। অপেক্ষা করুন অন্যদের খাওয়া শেষ হওয়ার। যদি উঠে যাওয়া খুব দরকার হয় তাহলে সেটা টেবিলে বসা অন্য ব্যক্তিদের জানিয়ে তাদের অনুমতি চেয়ে তবেই উঠুন।
২. কোনো দাওয়াতে গেলে খাবার খাওয়া শেষ হলেই চলে যাওয়ার জন্য অস্থির হবেন না। খাবার খাওয়ার পর অন্তত ১ ঘণ্টা পর অনুষ্ঠানস্থল ছেড়ে যাবেন। পরিচিতদের সাথে গল্প করুন।
৩. রেস্তরাঁয় খেতে গেলে খাবার খাওয়া শেষ হওয়ার ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই রেস্তরাঁ ছেড়ে চলে যাওয়া ভালো।

যা যা করা যাবে না
হ খাবারে ফুঁ দেবেন না। খাবার খুব গরম হলে কয়েক মিনিট সময় দিন খাবারটি ঠাণ্ডা হতে।
হ যেসব খাবার হাত দিয়ে খাওয়া নিয়ম সেগুলো চামচ দিয়ে খাবেন না।
হ যদি হাত দিয়ে খাবার খান, তাহলে যে হাত দিয়ে খাবার খাচ্ছেন সেই হাত দিয়ে কোনো খাবারের পাত্রের চামচ ধরবেন না। চামচটি নোংরা হয়ে গেলে অন্যরা সেই পাত্র থেকে খাবার নিতে গেলে সমস্যার সম্মুখীন হবেন। খাবার নিতে হলে অন্য হাতটি ব্যবহার করে চামচ ধরুন।
হ কোনো দাওয়াতে গিয়ে রান্না ভালো হলে প্রশংসা করুন, কিন্তু রান্না খারাপ হলে সেটা কাউকে বলার প্রয়োজন নেই।

হ খাবার চামচ বা ছুরি ব্যবহার করে কাউকে ইশারা করে ডাকবেন না।
হ খাবার টেবিলের ওপর কখনোই কনুই তুলবেন না। হাতের কব্জি রাখতে পারেন টেবিলের ওপর। তার বেশি নয়।
হ শব্দ করে ঢেঁকুর তোলা একদম নিষেধ।
হ টেবিলে বসে সবার সামনে টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁচাবেন না।
হ খাবার চিবিয়ে খাওয়ার সময় মুখ বন্ধ রাখবেন। মুখ খোলা রেখে খাবার খাওয়ার মতো বিরক্তিকর কাজ খুব কমই আছে। আশপাশের মানুষ খুবই অস্বস্তি বোধ করে এরকম আচরণ দেখলে।
হ খাবার টেবিলের ওপর ফোন বা মানিব্যাগ রাখবেন না।
হ চামচ বা গ্লাস দিয়ে অযথাই শব্দ করবেন না। হাত দিয়ে টেবিল বাজাবেন না।
হ রেস্তরাঁয় খাবার খাওয়ার সময় জোরে জোরে কথা বলবেন না। এমনভাবে কথা বলুন যাতে আশপাশের মানুষের অসুবিধা না হয়।

যা যা করা উচিত
হ কাউকে কোনো খাবার আপনার কাছে পাস করতে অনুরোধ করার সময় বিনয়ের সাথে বলুন। প্লিজ শব্দটি ব্যবহার করুন।
হ খাবার খাওয়ার সময় বা ছুরি দিয়ে খাবার কাটার সময় যেন কনুই দিয়ে পাশের ব্যক্তির গায়ে খোঁচা না লাগে তা লক্ষ রাখবেন।
হ মাঝেমধ্যেই ন্যাপকিনে হাত ও মুখ মুছুন।

হ এমন কিছু আপনার মুখে চলে গেছে যা আপনি খেতে পারবেন না, যেমন মাছের কাঁটা, ছোট এক টুকরা হাড় বা এলাচ, তখন আপনার করণীয় হলো ন্যাপকিনটি নিয়ে মুখের কাছে ধরে এতে সেই কাঁটা বা এলাচ বের করে ফেলা। এতে করে আপনার মুখ থেকে যা বের হলো তা অন্যরা দেখবে না।
হ যদি খাবারের মাঝখানে আপনাকে ওয়াশরুম ব্যবহার করতে হয় তাহলে বলবেন ‘আমি একটু আসছি’। টয়লেটে যাচ্ছেন কি না তা বলার প্রয়োজন নেই। কারণ খাবারের মাঝে কেউ এসব কথা শুনতে চায় না।

হ অন্যের প্লেট থেকে কিছু খেতে চাইলে তাকে না বলেই তার খাবারে আপনার চামচ দিয়ে খাওয়া শুরু করবেন না। যার প্লেটের খাবার, প্রথমে তার অনুমতি নিন। তারপর অপেক্ষা করুন যেন সে নিজে আপনাকে তার প্লেট থেকে কিছু খাবার তুলে দেয়।
হ রেস্তরাঁয় খেতে গেলে ওয়েটারদের সম্মান দিন। তাদের তুমি করে সম্বোধন করবেন না, আপনি করে বলুন। তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বলুন। যদি কোনো খাবার খেতে ভালো না হয়, ভদ্রভাবে ওয়েটারকে বলুন। তার সাথে রাগারাগি করবেন না; কারণ খাবারটি তিনি রান্না করেননি।
হ রেস্তরাঁয় খাবার বিল যদি ভাগাভাগি করে দিতে চান, সবাই কথা বলে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখুন। বিল দেয়ার সময় ওয়েটারের সামনে এ বিষয়ে কথা বলবেন না।


তৈজসপত্রের নিয়মকানুন

ষ যেসব খাবার কেটে টুকরো টুকরো করে খেতে হয় সেগুলো খাওয়ার সময় ছুরি ও কাঁটাচামচ ব্যবহার করতে হয়। ছুরি ও কাঁটাচামচ ধরার দুটি উপায় আছে। আপনার যেটি পছন্দ সেটিই বেছে নিতে পারেন। প্রথম পদ্ধতিটি হলো বাঁ হাতে কাঁটাচামচ ধরবেন, ডান হাতে ধরবেন ছুরি। ছুরি দিয়ে এমন মাপে খাবারটি কাটতে হবে যেন কাটা অংশটুকু কাঁটাচামচ দিয়ে গেঁথে একবারে মুখে ঢোকাতে পারেন, তাই ছোট মাপে অল্প অল্প করে কাটা সুবিধাজনক। ছুরি দিয়ে কখনোই খাবার মুখে নেবেন না, এটি অভদ্রতা হিসেবে গণ্য করা হয়। আরেকটি পদ্ধতি অনুযায়ী বাঁ-হাতে কাঁটাচামচ ধরবেন, ডান হাতে ধরবেন ছুরি। খাবারটি একবারেই সম্পূর্ণ টুকরো টুকরো কেটে নিতে হবে, এমন মাপে কাটতে হবে যা চিবিয়ে খেতে সুবিধা হয়। কাটা শেষ হলে ছুরিটি প্লেটের উপরিভাগে আড়াআড়িভাবে রেখে দিতে হবে। এবার ডানহাত দিয়ে কাঁটাচামচ ধরে সেটি ব্যবহার করে খাবার মুখে দিতে হবে।

ষ স্যুপ খাবার জন্য স্যুপের চামচ ব্যবহার করতে হবে, সাধারণ চামচ দিয়ে স্যুপ খাবেন না। স্যুপ খাবার পাত্রটি যদি নিচে একটি প্লেটসহ পরিবেশন করা হয় তাহলে স্যুপ খাওয়া শেষে চামচটি প্লেটে রাখতে হবে, যদি প্লেট ছাড়া পরিবেশন করা হয় তাহলে চামচটি আপনার স্যুপের পাত্রেই রাখুন।
ষ অনেক সময় দুটি কাঁটাচামচ থাকে। বড় কাঁটাচামচটি মেইন কোর্স খাবার জন্য ও ছোট কাঁটাচামচটি সালাদ বা ডেজার্ট খাবার জন্য ব্যবহৃত হয়।
ষ খাবার টেবিলে বসে অনেকে দ্বিধায় ভোগেন যে সামনে রাখা কোন গ্লাসটি আপনার। বাঁ-পাশেরটি নাকি ডান পাশেরটি? মনে রাখবেন, আপনার ডান পাশে যে গ্লাসটি বা গ্লাসগুলো রাখা, সেগুলোই আপনার জন্য।

ষ খাবারের মাঝে একটু জিরিয়ে নিতে চাইলে আপনার কাঁটাচামচ ও ছুরি এমনভাবে রাখুন যা একটি উল্টো ভি তৈরি করে। ছুরি থাকবে ডানপাশ থেকে কোনাকুনিভাবে, কাঁটাচামচ থাকবে বাঁপাশ থেকে কোনাকুনিভাবে। চামচ ও ছুরির দুটিরই ডগা থাকবে প্লেটের ঠিক মাঝে, একটি অপরটিকে ছুঁয়ে। এই উল্টো ভি চিহ্ন দেখলে ওয়েটার বুঝবে আপনি জিরিয়ে নিচ্ছেন, আপনার খাবারের প্লেটটি সরিয়ে ফেলবে না।
ষ খাবার শেষে সাধারণত ছুরি ও কাঁটাচামচ প্লেটের ওপর লম্বালম্বি সমান্তরালভাবে রাখতে হবে।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us