স্মৃতিতে বিজয়ের প্রথম মাস

সারওয়ার মো. সাইফুল্লাহ্ খালেদ | Dec 15, 2019 05:45 pm
স্মৃতিতে বিজয়ের প্রথম মাস

স্মৃতিতে বিজয়ের প্রথম মাস - ছবি : সংগ্রহ

 

১৯৭১ সাল। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিসটিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (আইএসআরটি) একটি ডেমোগ্রাফিক প্রাইমারি ডাটা কলেকশনের প্রজেক্টে দ্বিতীয় শীর্ষপদ ডেপুটি ফিল্ড সার্ভেল্যান্স সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ১৯৬৬ সালে অনার্স, ১৯৬৭ সালে মাস্টার্স করে বেরিয়ে করাচির পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসে (পিআইডিই) স্টাফ ইকোনমিস্ট হিসেবে ১৯৬৮ সালে আমার প্রথম চাকরির পর ১৯৭১ সালে এটি আমার দ্বিতীয় চাকরি। পোস্টিং ঢাকার নবাবগঞ্জ থানার শোল্লায় প্রজেক্টের প্রধান ফিল্ড অফিসে। প্রজেক্টের ফিল্ড অফিসে শীর্ষপদ ফিল্ড সার্ভেল্যান্স সুপারভাইজারের পদটি শূন্য পড়ে আছে। ঢাকা এসে আইএসআরটি থেকে প্রতি মাসে বেতন তুলতে হয়।

৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। বেতন তুলতে ঢাকা এসেছি। পরিবাগের রেললাইনের ধারে পুবের বাসায় থাকি। মধ্য রাতের পর ভোরের আলো না ফুটতেই ঘুম ভেঙে গেল। বাসার দক্ষিণের কক্ষের পশ্চিমের জানালা দিয়ে দেখি উত্তর দিক থেকে দক্ষিণের আকাশে আগুনের হলকার মতো কী ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ বুঝে উঠতে পারিনি। উঠে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। বিমানবন্দর থেকে অ্যান্টি এয়ারক্রাফট শেল নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। বুঝলাম ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। সকালে উঠে শোল্লা চলে গেলাম। বাসায় বলে গেলাম আমি শিগগিরই জায়গা ঠিক করে সবাই ঢাকা থেকে নিতে আসব।
এক বিকেলে শোল্লা ডিসট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় অলসভাবে হাঁটছিলাম। দেখি আমার স্কুলের সহপাঠী আমিরুল করিম ব্যাগ কাঁধে আমার সামনে দিয়ে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে। এমন অপরিচিত জায়গায় তাকে দেখে অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম - ‘কিরে, তুই এখানে?’ সে বলল - ‘ঢাকা আর থাকা নিরাপদ নয়। গ্রামে চলে যাচ্ছি।’ ঢাকার তেজগাঁও ওদের নিজের বাড়ি। আমি বললাম - ‘কার বাড়ি যাচ্ছিস’? সে বলল- ‘আমাদের গ্রামের বাড়ি। তুই এখানে কী করছ?’

আমি তাকে জানালাম এখানে কী করি। এরপর বললাম- ‘তোদের গ্রমের নাম কী? এখান থেকে কতদূর?’ সে বলল- ‘কাছেই। আজিজপুর।’ সেটাই এর গ্রামের বাড়ি। জানতাম না। শোল্লা থেকে অল্প দক্ষিণে আজিজপুর গ্রাম। আমি বললাম - ‘আমার দু’ভাইবোন মা আব্বা ও স্ত্রীর জন্য একটা জায়গা দরকার। তাদের বলে এসেছি শিগগিরই তাদের ঢাকা থেকে গ্রামে নিয়ে আসব। আমাদের দাউদকান্দির রতনপুর গ্রাম ঢাকা থেকে অনেক দূর। এত দূর যাওয়া যাবে না।’ সে বলল- ‘আমাদের বাড়ি নিয়ে আয়। বেশ জায়গা আছে।’ আমি যেন সায়রে কূল পেলাম। বললাম- ‘বাড়ির নাম বলে যা। আমি কালই তোদের বাড়ি যাবো।’

সে ঠিকানা দিয়ে গেল। ফিল্ড এলাকায় চলাচলের জন্য আমাদের প্রত্যেকের মাঝিসহ একটি করে নৌকা আছে। পরদিন আমার মাঝি তিলকের নৌকায় চড়ে আজিজপুর গেলাম। সুন্দর ব্যবস্থা। পছন্দ হলো। আমিরুল করিমকে বললাম- ‘আমি কালই ঢাকা যাবো তাদের আনতে। তুই তৈরি থাকিস।’ এই বলে চলে এলাম। আমার সমপদে জুনিয়র সহকর্মী ফারুককে জিজ্ঞেস করলাম- সে কি করবে। সেও ঢাকা যাবে। পরদিন ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল সকালে দু’জনে ঢাকা রওনা দিলাম। গ্রাম থেকে ফসলি জমিতে নেমে আইল বেয়ে খানিক পুব দিকে হাঁটতেই পথে দেখা গেল এক লোক একটি টুকরি মাথায় করে গ্রামের দিকে যাচ্ছে। ফারুক তাকে জিজ্ঞেস করল -‘তোমার টুকরিতে কী?’ সে বলল- ‘মাছ?’ ফারুক বলল- ‘কি মাছ ? দেখি।’

টুকরিতে মধ্যম সাইজের বড় এক কাতল মাছ। ফারুকের লোভ হলো। বলল- ‘চলেন কাল যাই। আজ মাছটা খাই।’ আমি বললাম - ‘রওনা যখন দিছি আর ফিরমু না। চলে যাই।’ ফারুক এ মাছ না খেয়ে যাবে না। সে রয়ে গেল। আমি একাই চললাম। কিছুদূর এগিয়ে দেখি পিঁপড়ের সারির মতো লোক ক্ষেতের আইল বেয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে আসছে। লোক চলছে তো চলছেই। এর শেষ নেই।

ঢাকার কলাতিয়ার কাছে টিনের চালওয়ালা একটা স্কুলের বারান্দয় দেখলাম সাধারণ লুঙ্গি-শার্ট পরা রাইফেল হাতে কিছু যুবক বসে আছে। কারো হাতে এসএমজি। এদের ঘিরে গ্রামের কিছু লোক জড়ো হয়েছে। আমাকে দেখে রাইফেল হাতে এক যুবক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল- ‘কোথায় যাবেন?’ আমার বড় পানি পিপাসা লেগেছে। পুরো রাস্তা হেঁটে এসেছি। আমি বললাম- ‘আমাকে আগে একটু পানি খাওয়ান।’ সে রাইফেলটি পিঠে ঝুলিয়ে পানির অ্যালুমিনিয়ামের একটি জগ হাতে করে এনে কাচের একটি গ্লাস ধুয়ে এক গ্লাস পানি দিলো। পানি খেয়ে বললাম- ‘ঢাকা যাব।’ সে বলল- ‘যেতে পারবেন না। একটু আগেই শেলিং হয়েছে। আবার হবে।’ আমি বললাম- ‘যেতেই হবে। আমার পরিবার ঢাকা। তাদের গ্রামে আনতে যাচ্ছি।’ সে বলল- ‘দেখেন। যদি যেতে পারেন।’

আমি আবার হাঁটতে শুরু করলাম। কলাতিয়ার ঝোপঝাড় ও জঙ্গল এলাকার জায়গা-জায়গা কামানের গোলায় ছিন্নভিন্ন বিধ্বস্ত। বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পারের কাছাকছি আসতেই ভারতীয় মিগ-২১ বিমানগুলো শেলিং শুরু করল। ভয়ে খোলা মাঠে মরা গাছের কাণ্ড আঁকড়ে ধরে এর তলায় আশ্রয় নেই। ভয়ে ভয়ে মাথার উপরে যুদ্ধ বিমানগুলোর দিকে তাকাই। কখন কোথায় শেলিং হয় বা হবে কে জানে। নৌকায় চড়ে ভয়ে ভয়ে ওয়াইজঘাট এসে নামলাম। নৌকা থেকে নামতেই খাকি পরা দুই জোয়ান পথ আটকে বলল- ‘কোথা থেকে এসেছেন? কোথায় যাবেন?’

সত্যি কথাই বললাম। আমার হাতে জরিপের একটি শেডিউলের বান্ডিল ছিল। যখনই ঢাকা আসতাম এক বান্ডিল শেডিউল হাতে করে নিয়ে আসতাম। যদিও এসব বহন করা আমার কাজ নয়। এর জন্য আলাদা লোক আছে। নিরাপত্তার খাতিরে আনি। জানতে চাইল - ‘এগুলো কী?’ আমি বললাম - ‘আমাদের জরিপের কাগজ।’ পথ ছেড়ে দিলো। বলল- ‘যান’। এগিয়ে রাস্তায় উঠে দেখি রাস্তা জনমানব শূন্য। এক রিকশাওয়ালা খালি রিকশায় বসে ঝিমুচ্ছে। তাকে ডাকতেই সে আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে বসল। বললাম- ‘পরিবাগ চলো।’ তখন বিকেল প্রায় তিনটার উপর বাজে। সে আমাকে নিয়ে চলল। কি আশ্চর্য রাস্তায় কোনো লোক নেই! দোকানপাট বন্ধ। আমি রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করি- ‘কি মিয়া! রাস্তায় লোকজন নাই! দোকানপাট বন্ধ! ব্যাপার কি?’

সেও হতবাক। কিছু বলতে পারল না। শাহবাগ রেডিও অফিসের সামনে এলে রাস্তার পুবদিকের ফুটপাথ থেকে সামরিক খাকি পোশাক পরিহিত গৌরবর্ণের এক সিপাই, ডান হাতে চাইনিজ রাইফেল, বাম হাত তুলে রিকশা থামাতে বলল। আমি রিকশাওয়ালার কাঁধে হাত রেখে তাকে থামতে বললাম। সিপাই এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল - ‘আপ কোন হ্যায়।’ আমি সহজ করে বললাম- ‘হাম ইউনিভার্সিটিকা প্রফেসর।’ আমার পদটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপকের সমতুল্য। একই বেতন স্কেল। হাতের শেডিউলের বান্ডিলটি দেখিয়ে বললাম- ‘ইয়ে দেখিয়ে হামারা রিসার্চ পেপার।’ সে বলল- ‘শহরমে কার্ফু হ্যায় আপকা মালুম নেহি?’ আমি বললাম - ‘নেহি’। জিজ্ঞেস করল- ‘কিদর যাইয়ে গা।’ আমি আঙুল তুলে সামনের দিকে দেখিয়ে বললাম- ‘সামনে। মেরা ঘর’। সে বলল- ‘ঠিক হ্যায়। যাইয়ে।’ আমাদের স্কুলে উর্দু বিষয় পাঠ্য ছিল না। করাচি থেকে এ ভাষা কিছুটা রপ্ত করেছিলাম। সেটা কাজে লাগল।

আমি রিকশাওয়ালাকে চলতে বললাম। বাসার কাছে আসতেই সবাই হতবাক। এক বাল্যবন্ধু আত্মীয়ও বটে লুতু মামা চিৎকার করে উঠল- ‘আরে খালেদ! তুমি এই কার্ফুর মধ্যে কোত্থাইকা আইলা?’ আমি বললাম- ‘শোল্লা থেকে। কার্ফু যে জানি না। রিকশাওয়ালাও জানত না। কখন কার্ফু দিছে?’ লুতু মামা বলল- ‘এই তো একটু আগে। তিনটা থাইকা’। রিকশাওয়ালাও জানে না শহরে কখন থেকে কার্ফু জারি হয়েছে।
বাসায় এসে দেখি কেবল মা আর আব্বা বাসায়। ভাই বোন স্ত্রী গতকাল গ্রামের বাড়ি রতনপুর চলে গেছে। আমাদের পাশের বাসার ফ্রিস্কুল স্ট্রিটের ধানমন্ডি হাইস্কুলের হেড মাস্টার জিন্নত আলী সাহেবও সপরিবারে তার নরসিংদীর বাড়ি চলে গেছেন। তবে হেড মাস্টার সাহেবের স্ত্রী তাদের বাসার চাবি মা’র কাছে রেখে গেছেন। বলে গেছেন- ‘খালেদ ঢাকা এলে ইচ্ছা করলে বা নিরাপত্তার খাতিরে প্রয়োজনে আমাদের বাসায় থাকতে পারে’- মা বললেন।

ঢাকা এসে আমি আটকা পড়ে গেলাম। শোল্লা আর যেতে পারছি না। রাস্তাঘাট বিপদসঙ্কুল হয়ে পড়েছে। আমি প্রজেক্ট লিডার প্রফেসর ড. মাহবুব উদ্দিন আহমদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে তার বাসায় দেখা করি। তাকে বললামÑ ‘আমি আমার পরিবার পরিজন নবাবগঞ্জ নিয়ে যেতে ঢাকা এসে আটকা পড়ে গেছি। আমার আসার আগেই তারা গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। আমি আর শোল্লা যেতে পারছি না।’ তিনি উত্তরে বললেন- ‘ফিল্ডে চলে যান।’ রাস্তা ঘাটের অবস্থা তাকে বললাম। আর সবাই ফিল্ডে আছে- এ কথাও বললাম। তিনি চা খাওয়ালেন। চা খেয়ে চলে এলাম। শোল্লা আর গেলাম না।

দু’ভাইবোন আব্বা-মা ও স্ত্রীকে গ্রামে নিয়ে যেতে এসেছিলাম। তারা বাসায় থাকলেও নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা আর তখন ছিল না। বাসায়ই আছি ভয়ে ভয়ে। দুপুরের আর রাতের খাবারের সময় নিজ বাসায় আসি।

বাকি সময়টা শুয়ে বসে বই পড়ে হেড মাস্টার সাহেবের বাসার একটা রুমে পালিয়ে থাকি। বাসাটি বাইরে দিয়ে গেটে তালাবন্ধ। আমাদের বাসার পুব-দক্ষিণ কোণ দিয়ে দেয়াল ঘেঁষে সরু একটি পথে সে বাসায় যাওয়া-আসা করা যায়। সেটিই ব্যবহার করি।
আমাদের বাসার ভেতরের বাগানে নিজেই একটি ইরেজি ‘এল’ আকৃতির ট্রেঞ্চ কেটেছি। কাছেই বিমানবন্দর। বলা যায় না কখন কোনো দিকে শেলিং বা বম্বিং হয়। ভারতীয় মিগ-২১ ও ন্যাট জঙ্গি বিমানগুলো দিনে কয়েকবার করে বিমানবন্দরে শেলিং করে যায়। বোম্বিং ও শেলিংয়ের প্রধান লক্ষ্যস্থল বিমানবন্দর হলেও এর মধ্যে নিউমার্কেটের পুবে এলিফ্যান্ট রোডের পশ্চিম মাথায় কম্পালা বিল্ডিং শেলিংয়ের আওতায় এসেছে। চার-পাঁচতলা বিল্ডিংটির উপরতলার পুবদিকের দেয়ালের গায়ে জঙ্গিবিমান থেকে শেলিংয়ের ফলে বড় বড় ছিদ্র হয়ে গেছে। এলিফ্যান্ট রোডে দাঁড়িয়ে তা দেখা যায়। নিজেও দেখে এসেছি। কম্পালা বিল্ডিংয়ে শেলিংয়ের ফলে জনমনে এ কারণে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে যে ভারতীয় বিমান সিভিলিয়ান এলাকাও শেলিং করা থেকে বাদ দেবে বলে মনে হয় না। শহর থেকে বেরিয়ে যে যেদিকে পারছে গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে। শহর ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।

সন্ধ্যার পর বাসার সামনে পশ্চিমের রেললাইনের ধারের আলোহীন পুবের খোলা জায়গায় প্রায়ই এসে দাঁড়াই। সারা দিন বাসায় থেকে হাঁপিয়ে উঠি। তাই সন্ধ্যার পর এখানে দাঁড়িয়ে একটু নিঃশ্বাস নেই। আধ কী এক ঘণ্টা পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকি। আজ কী মনে করে সেখানে গেলাম না। দক্ষিণের দরজা খুলে দরজায় দাঁড়ালাম। দেখি- আমি যে জায়গাটায় রোজ দাঁড়াই সেখানে লুঙ্গি পড়া খালি গায় এক যুবক পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়ানো। খানিক বাদে পশ্চিম দক্ষিণের গলিপথে ত্বরিত গতিতে একটি ভক্সওয়াগন গাড়ি এসে রেললাইনের পশ্চিম পাড়ে দাঁড়াল। গাড়ির ভেতর থেকে দু’জন সশস্ত্র সিপাই দৌড়ে এসে যুবকটিকে টেনে হেঁচড়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল। এই দেখে আমি ভয়ে আস্তে দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে এলাম। মনে মনে ভাবলাম রাখে আল্লাহ্ তো মারে কে! সন্ধ্যায় সেখানে দাঁড়ানো আমি বন্ধ করে দিলাম।

আমাদের বাসার ভেতর উত্তর পশ্চিম কোণে ছাদখোলা গোসলখানা। সেখানে চেয়ার পেতে এর উপর দাঁড়ালে স্পষ্ট দেখা যায় কিভাবে ভারতীয় বোমারু বিমানগুলো ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়েতে এলোপাথাড়ি বোমা বর্ষণ করছে। দেখি। যুদ্ধ কী নির্মম। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় - ‘যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা/ যুদ্ধ মানে আমার প্রতি তোমার অবহেলা’। সত্যিই।

মাঝে মধ্যে দু’চার দিন শহরে বেরিয়েছি। একদিন দেখলাম একটি জলপাই রঙের হুডওয়ালা সামরিক বাহিনীর ট্রাক ভেতরে প্রায় আধট্রাক২ ভর্তি জলপাই রঙের ত্রিপলে ঢাকা কী নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাচ্ছে। এক পথচারি বলল ‘এতে পাকিস্তান সেনাদের লাশ।’ এর মধ্যে রটে গেল ভারতীয় সেনাবাহিনীর লোক সিভিল ড্রেসে শহরে প্রবেশ করে গেছে। এরা নাকি দেখতে লম্বা এবং গায়ের রং কালো। সাধারণত সাদা পোশাক পরে চলাফেরা করে। এমন একজন লোককে পাবলিক লাইব্রেরির সামনের রাস্তা দিয়ে এক বিকেলে একা রিকশায় চড়ে উত্তর দিকে যেতে দেখেছি। সাদা ফুলহাতা শার্ট কালো প্যান্টে ইন করে পরা। রাস্তার দু’দিক দেখছে। গায়ের রঙ কালো। তাকে বাঙালি বা পাকিস্তানি বলে মনে হলো না। আমি তখন রাস্তার পশ্চিমের ফুটপাথ ধরে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছিলাম। জনবিরল রাস্তা। আমার সন্দেহ হলো। আমি বাসায় ফিরে এলাম।

আজ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। সকাল ন’টার দিকে একটি ভারতীয় মিগ-২১ জঙ্গিবিমান এসে অনেক উপর থেকে রোদেলা ঢাকার পুব আকাশে চক্কর দিয়ে গেল। কোনো রকম শেলিং করল না। বিমানবন্দরের অ্যান্টি এয়ারক্রাফ্ট গানগুলোও গর্জে উঠল না। একটু অবাক হলাম। ব্যাপার কী! এমনটা তো এর আগে হয়নি! দুপুর ১২টার দিকে আমাদের বাসার পশ্চিম পাশে রেললাইনে কে একজন ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলল। ওদিকে পুবে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের দিকে তুমুল গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বাসা থেকে বেরিয়ে রেললাইনে এলাম। কে একজন বলল- ‘ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে মুক্তি বাহিনী আর ভারতীয় বাহিনী এসে গেছে। মুক্তি বাহিনী বাসের ভেতরে থেকে জানালা পথে ফাঁকা গুলি ছুড়ে বিজয় উল্লাস করছে।’

আমার গায়ে সাদা পাজামা ও ফুলহাতা সাদা ট্যাট্রনের শার্ট, পায়ে নীল রঙের স্পঞ্জের স্লিপার। পরিবাগের রাস্তা ধরে এগিয়ে ময়মনসিংহ রোডে উঠে হাতের ডান দিকের পেট্রলপাম্পের কাছে আসতেই এক মধ্য বয়সী কাঁচাপাকা দাড়িওয়লা লুঙ্গিপড়া সাদা হাফশার্ট গায়ে এক ভদ্রলোক আমাকে বললেন - ‘ওদিকে যাবেন না। উত্তর দিক থেকে পাকিস্তানি সেনারা আসছে। ওরা গুলি করবে।’

এই বলে তিনি পশ্চিম দিকে পরিবাগের দিকে চলে গেলেন। আমি তবু সামনের দিকে এগোলাম। সাকুরা বিল্ডিংয়ের সামনের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে মুক্তি বাহিনীর বিজয় উল্লাস দেখছি। ফুটপাথে দর্শনার্থীরা ভিড় করেছে। হোটেলের সামনের উত্তর দিকের রাস্তায় পশ্চিমমুখী একটি নিশ্চল বাসের ছাদে ভারতীয় বাহিনীর সেনারা বসে আছে। হোটেলের গেটের দু’ধারে দু’জন ভারতীয় সশস্ত্র সিপাই সটান দাঁড়িয়ে আছে। আরেক বাসের ভেতর সাদা পোশাক পরা এসএমজি হাতে যুবক ঠাসা। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের উত্তরের এক মন্ত্রীর লাল বাড়ির লাল দেয়ালের আড়ালে ক’জন ভারতীয় বাহিনীর সেনাসদস্য রাস্তার দিকে রাইফেল তাক করে ওঁৎ পেতে বসে আছে। মুক্তিবাহিনী রাস্তায় চলমান আরেকটি বাসের ভেতর বসে জানালা দিয়ে উপর দিকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে উল্লাস করছে।
একটু পরে সত্যি সত্যি উত্তর দিক থেকে খাকি সামরিক পোশাক পরা পাকিস্তান বাহিনীকে মার্চ করে দক্ষিণ দিকে আসতে দেখা গেল। এরা রাইফেল উঁচিয়ে পুবদিকে তাক করে অগ্রসর হচ্ছে। পাশের একজন বলল- ‘এরা রমনা রেসকোর্সে সারেন্ডার করতে যাচ্ছে।’

আমি বললাম- ‘বন্দুক তাক করা কেন?’ সে আর কিছু বলল না। কাছাকাছি এসে পাকিস্তান বাহিনী সত্যিই ভারতীয় বাহিনী আর মুক্তি বাহিনীর ওপর গুলি ছুড়তে শুরু করল। আমি এক দৌড়ে হোটেলের গেট দিয়ে ভেতরে চলে এলাম। হোটেলের গেট পেরিয়ে বারান্দায় উঠতেই পিছলে পড়ে গেলাম। ভাবলাম গুলি লাগল কি না। চট করে উঠে শরীরে হাত বুলিয়ে দেখলাম না। গুলি লাগেনি। পায়ের স্পঞ্জের স্লিপার পিছলে উবু হয়ে পড়ে গেছি। আমার নতুন পাজামাটার কিছু অংশ বারান্দার ফ্লোরে বাম হাঁটুর ঘর্ষণে ফুটো হয়ে গেছে। আবার দৌড় দিলাম। সিঁড়ি বেয়ে দোতলার করিডোরে এসে থামলাম।

এর আগে এর ভেতরে আমি কোনো দিন ঢুকিনি। এখানে আরো লোক আছে। কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে। মহিলাও আছে। হাঁটু তুলে বসা এক মহিলার পাট ভাঙা নক্শা করা সাদা শাড়িতে রক্তের দাগ। এর সাথের এক বাচ্চা ছেলের গায়ে গুলি লেগেছে। সে রাস্তায় পড়ে আছে। সে উদাসীন শূন্য দৃষ্টি মেলে বসে আছে। আমাদের প্রতিবেশী প্রাক্তন ডিপিআই আবদুল হাকিম তার বড় মেয়ের জামাই ড. শরফুদ্দিন আবদুল্লাহ্ আল মুতিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখতে দেখতে পুবে পশ্চিমে লম্বা করিডোরের দু’পাশ ভর্তি হয়ে গেল। সবাই সারিবদ্ধভাবে কেউ বসে বা কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

সন্ধ্যার আগখান দিয়ে পাড়ার পরিচিত অপরিচিত অনেকেই আমাদের বাসার সামনে রেললাইনে ভিড় জমালেন। সেদিন দুপুরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে যারা মুক্তিবাহিনীর বিজয় উল্লাস দেখতে গিয়েছিলেন তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন। কেউ কেউ বললেন যে গোলাগুলির সময় এরা রাস্তায় শুয়ে পড়েছিলেন। এদের মাথার উপর দিয়ে বন্দুকের নল ঘুরেছে। কেউ কেউ গোলাগুলি শুরুর সাথে সাথে গলিপথে ভাগতে পেরেছেন। এ সব বর্ণনা শুনছিলাম। হঠাৎ দেখা গেল উত্তরের আকাশে বিমানবন্দরের উপর ফড়িংয়ের মতো কালো কালো আট দশটি হেলিকপ্টার উড়ছে। এগুলো এখনই নামবে। কে একজন বললেন যে ভারতীয় সেনাপ্রধানরা পাকিস্তান বাহিনীকে রেসকোর্সে আত্মসমর্পণ করাতে এসেছেন।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us