যেসব কারণে বাংলাদেশীরা আর ভারতে যেতে চায় না

নীরাজ কৌশল | Jan 31, 2020 05:46 pm
যেসব কারণে বাংলাদেশীরা আর ভারতে যেতে চায় না

যেসব কারণে বাংলাদেশীরা আর ভারতে যেতে চায় না - ছবি : সংগৃহীত

 

অনেক ভারতীয় বিজেপির ভাষ্য বিশ্বাস করে মনে করে যে লাখ লাখ বাংলাদেশী ভারতে বাস করে এবং তাদের সংখ্যা দ্রুত বহুগুণে বাড়ছে, তাদের শনাক্ত করে আটককেন্দ্রে সরিয়ে রেখে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেয়া উচিত।

কিন্তু ভারতের আদমশুমারির তথ্যভিত্তিক সরকারি ভাষ্য কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। বাড়ার বদলে বরং ১৯৯১ সাল থেকে এই সংখ্যা ধীরে ধীরে কমছে। ভারতে বসবাসরত বাংলাদেশীরা হলো বিদেশে জন্মগ্রহণকারী গ্রুপগুলোর মধ্যে বৃহত্তম। তবে তারা ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.২ ভাগ। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে ভারতে বাস করছে ৪০ লাখ চার হাজার লোক। ২০০১ সালে তা কমে হয়েছে ৩৭ লাখ এবং ২০১১ সালে হয়েছে ২৭ লাখ। দুই দশকে এক-তৃতীয়াংশ লোক কমে গেছে।

এই তথ্যানুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে লোক যাচ্ছে না, বরং ভারত থেকে বাংলাদেশীরা চলে যাচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে পরবর্তী আদমশুমারিতে ভারতে বসবাসকারী বাংলাদেশীর সংখ্যা হবে ১৭ লাখ। পরের এক দশকে তা আরো ১০ লাখ হ্রাস পাবে। এটিকে যদি কোনো সমস্যা মনে করা হয়, তবে তা নতুন কোনো সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমাধান হয়ে যাবে।

আর্থিক সমস্যায় থাকা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি পরামর্শ হলো, অবৈধ বাংলাদেশীদের শনাক্ত করার জন্য দেশব্যাপী জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) করে তহবিলের অপচয় করবেন না। প্রস্তাবিত এনআরসি যখন শেষ হবে, তত দিনে তাদের সংখ্যা এমনিতেই হয়তো মাত্র ৫ লাখে নেমে আসবে। মনে রাখবেন, আসামে কাজটি করতে লেগেছে ১০ বছর এবং ব্যয় হয়েছে ১,২০০ কোটি রুপি। আর ভারতের জনসংখ্যা আসামের চেয়ে প্রায় ৪০ গুণ বেশি হওয়ায় সারা ভারতে তা করতে ব্যয় হবে ৫০ হাজার কোটি রুপি। এটি কি অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত?
সংশয়বাদীরা বাংলাদেশীদের সংখ্যা কম করিয়ে দেখানোর বিষয়টি বাতিল করে দেন। ওয়েব অনুসন্ধানে এই সংখ্যাটি ১৫ লাখ থেকে দেড় কোটি দেখানো হয। কিন্তু এটা ভুতুরে সংখ্রা, এর কোনো ভিত্তি নেই। এই হিসাব প্রণয়নে কোনো বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়নি।

সংশয়বাদীরা যুক্তি দেখান যে আটক বা বহিষ্কার হওয়ার ভয়ে বাংলাদেশীরা তাদের জন্মস্থানের কথা বলে না। এ কারণে তাদের প্রকৃত সংখ্যা আদমশুমারিতে ধরা পড়ে না। অনেক বাংলাদেশী তা করতেই পারে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি হ্রাস পাওয়ার চিত্র দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গেই। এখানেই আটক হওয়ার ভয় সবচেয়ে কম। ২০০১ সালে সেখানে ছিল ৩.০৪ মিলিয়ন, ২০১১ সালে নেমে হয়েছে ২.২ মিলিয়ন।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এনআরসির সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। তার সরকার নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস করেছে। ভুল তথ্য প্রদান এখানে নিশ্চিতভাবেই কম হবে। কারণ কেবল তৃণমূল নয়, কংগ্রেস ও সিপিএমও বাংলাদেশ থেকে আগহসহ মুসলিম ভোটের জন্য লালায়িত।
আচ্ছা, ২০১১-পরবর্তী বাংলাদেশী অভিবাসীদের কী হয়েছে? দুই প্রতিবেশী দেশের জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক ধারা অনুযায়ী, বাংলাদেশীদের জন্য ভারতের অর্থনৈতিক আকর্ষণ শেষ হয়ে গেছে। বিশেষ করে আসামে। এটি হলো ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গরিব ও অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে মন্থর।

ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। উপমহাদেশের বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ায় ভারত যৌক্তিকভাবেই পিছিয়ে থাকা প্রতিবেশী অর্থনীতিগুলো থেকে লোকজনকে আকৃষ্ট করবে। ২০০১-২০১১ দশকে ভারতের বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮ ভাগ, যা বাংলাদেশের ৫.৭ ভাগের চেয়ে বেশি।
কিন্তু ২০১১ থেকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে ভারতের চেয়ে। ২০১২-১৯ সময় কালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ ভাগ, যা ভারতের ৬.৮ ভাগের চেয়ে বেশি। সবচেয়ে নাটকীয় বিষয় হলো, চলতি বছরের জন্য ভারতের জিডিপি হবে ৮.১ ভাগ, যা ভারতের ৪.৮ ভাগের চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবেই শ্রমিকদের জন্য ভারতের চেয়ে বেশি আকর্ষণ সৃষ্টি করবে।
দুই দেশের জনসংখ্যার ধারাও বলছে যে বাংলাদেশের লোকদের ভারতে যাওয়ার কারণ দুর্বল। সাধারণত, উচ্চ জন্মহারের দেশ থেকে নিম্ন জন্মহারের দেশে লোকজন পাড়ি জমায়। বাংলাদেশে ১৯৮১ সালে মোট নারীপিছু জন্মহার ছিল ৬.২, ভারতে তা ছিল ৪.৮। কিন্তু এখন তা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। আর তা অনেক ভারতীয়ের জন্য বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের জন্মহার যেখানে ২.০৬, সেখানে ভারতে ২.২৪।

সামাজিক সূচকে, কয়েক দশক ধরেই ভারতকে পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে গড় আয়ু ৭২ বছর। আর ভারতীয়দের এর চেয়ে চার বছর কম। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক কম নবজাতক রয়েছে। বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর হার অনেক কম। বাংলাদেশে নারীদের সাক্ষরতার হার অনেক বেশি, শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি। ১৯৭১ সালে এসব সূচকে বাংলাদেশ ছিল ভারতের চেয়ে পিছিয়ে। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। আসামের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক ভালো।
এসব অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যা ধারা জোরালোভাবে ভারতে বাংলাদেশী অভিবাসী সম্পর্কে বিজেপির বাগাড়ম্বড়তা নাকচ করে দেয়। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাত তাদেরকে ‘উইপোকা’ ও ‘ঘুসপেটিয়া’ তথা অনুপ্রবেশকারী বলে অভিহিত করছেন। বিজেপি প্রণয়ন করেছে সিএএ এবং ভারতব্যাপী এনআরসির প্রস্তাব করেছে। হিন্দুত্ববাদীরা বিশ্বাসীরা আবেগময়ভাবে অবৈধ লোকদের বাড়ন্ত বন্যাকে ধরে ছুঁড়ে ফেলতে চাচ্ছে আবেগময়ভাবে। কিন্তু আদমশুমারি সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলছে। এতে বাংলাদেশীর সংখ্যঅ হ্রাস পাওয়ার কথা বলছে। মনগড়া তথ্য ও আবেগপ্রবণ গুজবে নয়, বরং ভারতীয়দের প্রয়োজন বাস্তব তথ্যে বিশ্বাস করা।

লেখক : অধ্যাপক, সোস্যাল পলিসি, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি
টাইমস অব ইন্ডিয়া

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us