মোদির ধর্ম-প্রকল্প

গৌতম দাস | Feb 08, 2020 05:48 pm
মোদি

মোদি - ছবি : সংগ্রহ

 

বিজেপির নরেন্দ্র মোদি ও তার ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ানোর তৎপরতা অব্যাহত আছে। মানে, বিতর্কিত সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ) বা সংশোধিত নাগরিক আইন পাস করার পরে এ নিয়ে বিজেপির হিন্দু-মুসলমান বিভক্তি বাড়িয়েই তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে লন্ডনের ‘ইকোনমিস্ট’ ম্যাগাজিন এই ইস্যুতে গত সপ্তাহে এক আর্টিকেল ছেপেছে। শিরোনাম ‘ইকোনমিস্ট এক্সপ্লেস, দ্যা ইরোশন অব সেকুলার ইন্ডিয়া’।

এমন লেখা অনেক তথ্যসমৃদ্ধ হয় যাতে পাঠক ওই ইস্যুর খুঁটিনাটি ওই লেখা থেকে জেনে নিতে আগ্রহী হয়। ইকোনমিস্টদের এই আর্টিকেলটা তেমনি ধরনের এক লেখা, যেটার শিরোনাম মানে হলো- আমরা ‘ইকোনমিস্ট ব্যাখ্যা করছি ভারতের সেকুলারিজমে ক্ষয় ধরে গিয়েছে’।

এই আর্টিকেলের লেখক দিল্লিতে বসে লিখেছেন তা নিজেই জানিয়েছেন, এ ধরনের লেখাকে পত্রিকার নিজের অবস্থান, অন্তত কিছু দায়দায়িত্ব নিয়ে লেখা মনে করা হয়ে থাকে।

এই লেখার সবচেয়ে বিরক্তিকর দিক হলো ‘সেকুলার’ শব্দ ও এর ব্যবহার। সারা ভারতে সেকুলার শব্দের এই বিশেষ আবিষ্কার ও বিরক্তিকর ব্যবহার প্রচলিত আছে সেই ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত। সেটা এখন ‘লন্ডন ইকোনমিস্ট’ পর্যন্ত সওয়ার হয়েছে এটা দেখতে পাওয়াটা বড়ই চমকপ্রদ ও তামাশার নিঃসন্দেহে! ইকোনমিস্ট এখানে ধরে নিয়েছে যে, ভারত একটা সেকুলার রাষ্ট্র, অন্তত সেকুলার রাষ্ট্র ছিল ইকোনমিস্ট এই সার্টিফিকেট এখানে বিতরণ করেছে। কিন্তু ‘সেকুলা’র মানে কী? আর কোনটা সেকুলার কোনটা না, তা চেনার উপায় কী?

যারা দাবি করবে যে সে সেকুলার অথবা তাদের অমুক রাষ্ট্র সেকুলার তা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে যে, তিনি সেকুলারিজম ও রাষ্ট্রবিষয়ক কনসেপ্ট সম্পর্কে আসলে কিছুই জানেন না। যেমন এটা ভারতীয় উপমহাদেশেই কেবল প্রশ্ন উঠতে দেখা যায় যে, ওমুক রাষ্ট্র বা ভারত সেকুলার কি না। ইউরোপে কোন রাষ্ট্র সেকুলার আর কোনটা না- এমন প্রশ্ন উঠতে দেখা যায় না। এমনকি আমেরিকা কি সেকুলার রাষ্ট্র? এই প্রশ্ন করতে দেখা যায় না কেন? কোনো রাষ্ট্রের সেকুলার হওয়া জরুরি কেন? এর জবাব কী তারা জানেন? অথবা আরো গোড়ার প্রশ্ন- কোনো রাষ্ট্র সেকুলার কিনা তা বুঝার উপায় কী?

ইকোনমিস্টের এই লেখায় কোথাও ব্যাখ্যা করা হয়নি যে, কী অর্থে ভারতে ‘সেকুলারিজম আছে বা ছিল’। এটা বলতেই বা আসলে কী বুঝান হয়েছে? তবুও ওই লেখায় লেখকের দাবি হলো- ‘১৯৮০ এর দশক পর্যন্ত ভারতে সেকুলার ভিশন বজায় ছিল এবং তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় নাই।’ অর্থাৎ এখানে দেখা যাচ্ছে, সেকুলার শব্দের পাশে একটা ‘ভিশন’ শব্দ লাগানো হয়েছে; মানে সেকুলার জিনিসটা নেহায়েতই একটা ‘দৃষ্টিভঙ্গির’ ব্যাপার যেন। এমনিতে অবশ্য ভারতের মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত ‘ভারত সেকুলার কি না’ এই গর্ব বা তর্কের মীমাংসা করার পদ্ধতিটা খুব সহজ। ভারতে একজন মুসলমানকে প্রেসিডেন্ট বানানো হলে এটাই তাদের কাছে সেখানে প্রমাণ-চিহ্ন হিসেবে গৃহীত হয়ে যায় যে, ভারত সেকুলার। অথচ ইস্যুটা অমন লোক দেখানোর নয়। রাষ্ট্র ধারণা বিষয়ে যারা সিরিয়াস তাদের কাছে এসব আমলযোগ্য কথা হতে পারে না।

এ ছাড়া ওই আর্টিকেলের শুরুতে বলা হয়েছে, ভারতের যারা মেইনস্ট্রিম রাজনীতিতে ছিল (মানে কংগ্রেসকে কল্পনা করা হয়েছে) এরা নাকি ‘সেকুলারিজমের স্বপ্ন’ ও ‘ইনক্লুসিভ রিপাবলিক’-এর স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু সরি, লেখক মহাশয়! আপনার এই কথা বাস্তবের সাথে মেলে না। ফলে, এটা অগ্রহণযোগ্য দাবি। কারণ ‘ইনক্লুসিভ’ শব্দ ব্যবহার করে রাষ্ট্রবিষয়ক কোনো ধারণা প্রকাশ করা আমেরিকানদের চালু করা শব্দ। এ ছাড়া কোল্ড ওয়ার যুগের আগে আমাদের এদিকে এই শব্দ দেখা যায়নি। বিশেষ করে গ্লোবালি ইসলামী রাজনীতিতে একালে তা বাধ্যতামূলক আমলযোগ্য ইস্যু হয়ে পড়ার পর এটা আমেরিকানদের সবচেয়ে ইতিবাচক অবস্থান প্রকাশের এক ভাষা হয়ে ওঠে। ইসলামী রাজনীতিতে কোনো রাষ্ট্র বা শাসন ধারণার বিপরীতে আমেরিকার আপত্তি তারা এভাবেই প্রকাশ করে থাকে।

কংগ্রেস কখনই ‘ইনক্লুসিভ রিপাবলিক’ বলে কোনো ধারণা ব্যবহার করে নাই। এমনকি ১৯৪৯ সালে ভারতের কনস্টিটিউশন রচনার সময় ছাড়া ‘রিপাবলিক’ শব্দটাই ব্যবহার করা হয়নি। আর শব্দটার ব্যবহার কংগ্রেস যদি বুঝেই থাকত, তবে পাকিস্তান আলাদা হওয়ার দিকে গিয়েছিল কী করে? তাহলে নেহরুর ‘অখণ্ড ভারত’ দখলের ও পাওয়ার আকাক্সক্ষা ষোলোআনা ছিল, তার কী হবে? আমরা তো এখনো সহজেই এর প্রমাণ পাই। মনে রাখতে হবে, অখণ্ড ভারত পাওয়ার আকাক্সক্ষা আর সবাইকে নিয়ে ‘ইনক্লুসিভ’ ভারত রাষ্ট্র গড়া- এ দুটো শুনতে কাছাকাছি মনে হয় হয়তো। কিন্তু এ দুটো- একই বলে চালিয়ে দিতে চাইলেও, এরা একেবারেই ভিন্ন বিষয়। আসলে একটা হলো, স্রেফ ভূখণ্ডের লোভ। আর একটা হলো সবাইকে একই ও সমান নাগরিক মানুষ হিসেবে একত্রে এক রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত করে গড়ে তুলতে চাওয়া।

ওদিকে, গান্ধী ‘নাগরিক’ শব্দ ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন; এর প্রমাণ দেখা যায় না। সারাজীবন তিনি হিন্দু আর মুসলমান- এভাবে আওড়ায়ে গেছেন। আসলে মূলত তিনি ‘হিন্দু-মুসলমান এক করতে হবে’ এই হাল্কা ভাষ্য আউড়িয়ে গেছেন। একটা রাষ্ট্র গড়তে চাইলে দুটো আলাদা ধর্ম হিন্দু-মুসলমান, এদের এক করতে হবে কেন? এর চেয়েও বড় কথা- দুটো আলাদা ধর্মকে এক করা কি আদৌ সম্ভব, না এর দরকার আছে?

দুনিয়াতে ‘আধুনিক রিপাবলিক’ রাষ্ট্রধারণা আসা ও গড়ার চিন্তা এসেছে কবে থেকে? জবাবে সবাই মেনে থাকে যে, এটা মোটাদাগে ১৬৫০ সালের পর থেকে। একটা ভুল ধারণাও এখানে আছে যা অনেকে ধারণ করে থাকতে পারে। ১৬৫০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত জন্ম নেয়া সব রাষ্ট্র একই ধরনের রিপাবলিক বা গণপ্রজাতন্ত্রী, রাষ্ট্রধারণা কিন্তু তা নয়। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের আর পরের ধারণা আলাদা। এই যুদ্ধ সব বদলে দিয়েছিল। ফারাকটা হলো, ইউরোপের প্রায় সব রাষ্ট্রই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ছিল ‘নেশন-স্টেট’ বা জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র। আর পরে এগুলো সবই হয়েছে অধিকারভিত্তিক ‘রিপাবলিক রাষ্ট্র’। এর সবচেয়ে ভালো প্রমাণ হলো, ১৯৫৩ সালে ইউরোপের ৪৭ রাষ্ট্রের ‘কাউন্সিল অব ইউরোপ’ গঠনকে লক্ষ করা। এর উদ্দেশ্য ছিল এক হিউম্যান রাইটস কনভেনশন ডাকা (নাম ছিল ইউরোপীয় কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস)। যাতে ওই কনভেনশন শেষে একমত হওয়া ও প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা, এরপর তা রক্ষা করতে গিয়ে নিজ নিজ রাষ্ট্রগুলোকে জাতিরাষ্ট্র থেকে হিউম্যান রাইটসভিত্তিক রিপাবলিক রাষ্ট্র আকারে ভিত্তি বদলে নেয়া যায়।

অতএব যে ইউরোপের কথা আমরা শুনি জানি, যার এক নমুনা হলো সেকালের কলোনি-মালিক ব্রিটিশ রাষ্ট্র; এটা আসলে সেকালে ছিল এক জাতিরাষ্ট্র বা নেশন স্টেট; মানে অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র নয়। আর তাই যে জ্ঞান-বুদ্ধি নিয়ে সেকালের রেনেসাঁ-চিন্তা ব্রিটিশের হাত ধরে ভারতবর্ষে এসেছিল সেই রেনেসাঁ ছিল মূলত একটা জাতিরাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন ও ধারণা। কমিউনিস্ট সার্টিফিকেট অনুসারে যাকে ‘ভারতীয় রেনেসাঁর আদিগুরু’ মানা হয়- সেই রামমোহনের সক্রিয়তার কাল (১৮১৫) থেকে পরিশেষে ১৯৪৭ সালের আশপাশের সময়কালের নেহরু-গান্ধীর রাষ্ট্র ধারণা পর্যন্ত তো বটেই, এমনকি এখনো সেই রাষ্ট্রধারণাটা মূলত একটা জাতিরাষ্ট্রের ধারণা। ১৯৪৭ সালে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী ভারত’ আসলে এক নেশন-স্টেট হিসেবেই জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু তাতে কী সমস্যা?

রাষ্ট্র বলতে এক ‘জাতিরাষ্ট্রে’র স্বপ্ন-কল্পনা থাকলে গঠনকারীদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়, কাকে তারা ‘জাতি’ হিসেবে নেবে? যেমন রামমোহন ব্রিটিশ জাতিরাষ্ট্র দেখে এক ভারতীয় জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু খেয়াল করতে হবে তার এই জাতি ধারণাটা আসলে (এথনিক অর্থে) ধর্মীয়-জাতি ধারণা। যেমন এই বিচারে ব্রিটিশরা হলো, অ্যাঙলো-ক্যাথলিক খ্রিশ্চান, আর এই ধর্মের ভিত্তিতে তারা এক ব্রিটিশ জাতি। আর এখান থেকেই রামমোহন একক ধর্মের ভিত্তিতে এক ভারতীয় জাতির কল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এতে হিন্দুধর্ম তার ‘ওই’ প্রয়োজন মেটাতে পারবে, তা তিনি মনে করেননি। কারণ এই হিন্দুধর্ম অসংখ্য জাতে বিভক্ত। এ ছাড়া ভারতে আরো ধর্মও আছে। এ ছাড়া তিনি কোনো একটা একেশ্বরবাদী ধর্ম হলে তা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযুক্ত হবে বলে মনে করতেন। এসব চিন্তা থেকেই ১৮১৫ সালে তিনি ‘ব্রাহ্মধর্মের’ প্রচলন করেছিলেন।

কিন্তু এই ধর্ম-প্রকল্প বাস্তবায়ন রামমোহন বা তার অনুসারীরা কেউ করতে পারেননি। ১৮৩৩ সালে তার মৃত্যু হয়। আর ১৮৭২ সালের দিকেই, খোদ ব্রাহ্মধর্মই দু’ভাগ হয়ে যায়। এটা উদ্যোক্তাদের কাছে অবাস্তব প্রকল্প মনে হতে থাকে আর ততই বিবেকানন্দ-অরবিন্দ-বঙ্কিমচন্দ্রসহ সবার কাছেই হিন্দুধর্মভিত্তিক ভারতীয় জাতিরাষ্ট্র ধারণা একমাত্র বাস্তবতা বলে নিরুপায় ‘সাফাই’ উঠতে থাকে। কংগ্রেসের জন্মের (১৮৮৫) পর থেকে হিন্দুধর্মভিত্তিক ভারতীয় জাতিরাষ্ট্র ধারণা- এটাই মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে গান্ধী কংগ্রেসের হাল ধরেন ১৯১৪-১৫ সালের দিকে। তখন থেকেই এবং মূলত ১৯২৩ সালের ‘লক্ষৌ প্যাক্ট’-এর ঐক্য ফেল করার পর থেকে হিন্দুধর্মভিত্তিক ভারতীয় জাতিরাষ্ট্র ধারণা একেবারে নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তবে গান্ধীর কৌশলে, এটা হিন্দুধর্মভিত্তিক বা এটা আসলে হিন্দু জাতীয়তাবাদ, সে কথা আবছা করে রাখা হয় বা বিপদে পড়লে হিন্দু শব্দটা ঠিক ধর্ম নয়, সভ্যতা বলে বুঝতে হবে বলে দাবি করার চাতুরী তারা করে গেছেন।
আসলে জাতিরাষ্ট্র বুঝের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এখানে ‘জাতি’ মানেই কোনো একটা আইডেনটিটি মানে, ভাষা ধর্ম বা অন্য কোনো পরিচয়কে ভিত্তি ধরে আগাতেই হয়। আর এতেই অন্যান্য ধর্ম অথবা অন্য আইডেনটিটিগুলোও কেন জাতির ভিত্তি হিসেবে নেয়া হবে না, সে প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু সবচেয়ে অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব খাড়া হয় যে একটা না একটা নাগরিক-অসাম্য নিয়মিত তৈরি হতে থাকে।

অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্রে এই প্রশ্নগুলো মীমাংসিত। তবে বাস্তবায়ন করাটা মূল কাজ যে, ধর্ম বা যেকোনো পরিচয় নির্বিশেষে বৈষম্যহীন নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

মূল বিষয় হলো গান্ধী-নেহরুর হিন্দুধর্মভিত্তিক ভারতীয় জাতিরাষ্ট্র ধারণা আঁকড়ে থাকাতে তারা জিন্নাহ বা মুসলিম লীগের বা কোনো মুসলমানের প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব তৈরি করতে পারেননি। পরিণতিতে আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তানের দাবি বড় হয়ে শেষে তারা আলাদা হয়ে যায়; যদিও অনেক মুসলমান দেশত্যাগ করলে নিজের বৈষয়িক অবস্থা অনিশ্চিত হয়ে পড়ার ভয়ে আপসে ভারতেই থেকে যান।

এর সার কথাটা হলো, হিন্দুধর্মভিত্তিক ভারতীয় জাতিরাষ্ট্র ধারণার কারণে ভারতের সব প্রধান দলই কমবেশি ‘হিন্দুত্ব’- এই জাতিবাদের অনুসারী থেকে যায়। এর মধ্যে সেকালের আরএসএস কে (একালের বিজেপি) বলা যায় ‘চরম’ হিন্দুত্ববাদের দল। এ কারণে বিজেপির চোখে ‘নাগরিক’ বলে কোনো ধারণা নেই, মুসলমান বা অন্য নাগরিকের নাগরিক অধিকার রক্ষার কোনো দায় অনুভব করে না বিজেপি। তাদের কোনো দলিলেও এর স্বীকৃতি নেই।
তাহলে কংগ্রেসের কি আছে? না তাও নেই। কারণ ভারত মূলত ‘জাতিরাষ্ট্র’ ধারণার দল দিয়েই গঠিত; ‘নাগরিক অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র’ ধারণা ও বোধের দল দিয়ে নয়, সে দল কমিউনিস্ট হোক কি বিজেপি!

উনিশ শ’ আশির দশকের শেষের দিক থেকে ভারতে কংগ্রেস দলের প্রভাব ও আধিপত্যের পতন শুরু হয়ে যায়। আর এটা লক্ষ্য করেই ইকোনমিস্টের লেখক দাবি করছেন সেকুলারিজমের ক্ষয় তখন থেকে। তিনি ‘কংগ্রেস’ শব্দের জায়গায় ‘সেকুলারিজম’ বসিয়ে কাজ সেরেছেন যেন এর আগে ভারত বিরাট সেকুলার ছিল। এর আগে যেন বছর বছর দাঙ্গা হয়নি। কাশ্মিরে নির্বাচনে ভোটে কারচুপি করে ভোটের রাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠানো আর রাজনীতিতে সশস্ত্রতার আমদানি কি ১৯৮৭ সালে কংগ্রেস আমলে হয়নি? একা বিজেপি সব দোষের ভাগী এ কথা ভিত্তিহীন। রাহুল গান্ধী কি একালে ‘সফট হিন্দুত্ববাদের’ রাজনীতি করছেন না?

চিনতে হয় কী করে, রাষ্ট্র সেকুলার কিনা? রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা ও বোধের অভাব আর সুবিধাবাদী রাজনীতির কারণে সেকুলারিজম সম্পর্কে সব অদ্ভুত ধারণা আমরা দেখতে পাই। সেটা মুসলমান রাষ্ট্রপতি দেখানো মানে, তা সেকুলারের লক্ষণ পর্যন্ত। এমনকি এটা কনস্টিটিউশনে ওই রাষ্ট্র সেকুলার বলে ঘোষণা দেয়া আছে কিনা অথবা রাষ্ট্রের মূলনীতির একটা সেকুলারিজম কিনা, ইত্যাদি দেখিয়ে যারা দাবি করে, আমার বা অমুকের রাষ্ট্রটা সেকুলার তারা রাষ্ট্র বা সেকুলারিজমের কিছুই বুঝে, না। তাদের একটাই উদ্দেশ্য, ধর্মীয় সংখালঘুদের ভোট যেকোনো উপায়ে হাসিল করা।

রাষ্ট্র ক্ষমতাসীনদের কোনো অঙ্গ সংগঠনের প্রতি আইন ভঙ্গ করে হলেও ছাড় দিচ্ছে, বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে- এগুলো যথেষ্ট প্রমাণ যে, এই রাষ্ট্র সেকুলার নয়। ‘অ-সেকুলারিজম’ কথার মূল অর্থ হলো নাগরিক বৈষম্য। রাষ্ট্র ছাত্রলীগের মতো সংগঠনকে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে এটাই বৈষম্য করা। ধর্মের কারণেসহ যেকোনো কারণে নাগরিকের মধ্যে বৈষম্য করা, বৈষম্যের চোখে দেখা ও আচরণ করা এটাই মূলত সেকুলার নীতি ভঙ্গ করা। কেবল ধর্মীয় বৈষম্য নয়, বরং যেকোনো নাগরিক বৈষম্যই সেকুলার নীতি ভঙ্গ করা। সে কারণে আমাদের রাষ্ট্র সেকুলার, এটা কনস্টিটিউশনে লিখে রাখলে সেকুলারিজম কায়েম হবে না। রাষ্ট্রের চোখে দেশের সবার পরিচয় যাই থাক, মূল বিষয় হবে তাকে কমন নাগরিক পরিচয়ে আমল করা হচ্ছে কি না, সে সমান অধিকারের নাগরিক বলে মানা হচ্ছে কি না, কোন ধরনের বৈষম্যের শিকার সে হচ্ছে কি না, ন্যায়বিচার পাচ্ছে কি না ইত্যাদি। এগুলোর সদুত্তর হলো সেকুলার রাষ্ট্রের চিহ্ন। নাগরিক সাম্যের ব্যত্যয় ঘটলেই মানে, অধিকারে বৈষম্য ঘটলেই আসলে সেটা সেকুলারিজম ভঙ্গ করা।
আর অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র না হলে নাগরিক সাম্য বজায় থাকা বা বৈষম্যহীনতা রক্ষা করা আশা করা যায় না।

জন্ম থেকেই ভারত হিন্দুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্র। তাই ভারতের নাগরিক জীবনে নাগরিক সাম্য বা বৈষম্যহীনতা বজায় থাকার দাবি বা এই বোধ সরব বা সক্রিয় নয়। একই কারণে তাই সুপ্রিম কোর্ট বা নির্বাচন কমিশনের ওপর নাগরিকের দাবি বা চাপ তেমন নেই। জেলা শহরভিত্তিক মফস্বলে বিজেপি বা এর অঙ্গ সংগঠনের নেতারা মুসলমান বলে কোনো মানুষকে ধরে নির্যাতন করছে, তাকে শুইয়ে বুকের ওপর লাফ দিয়ে উঠছে। অথচ গোল হয়ে চার পাশে মানুষ নির্বিকারভাবে এই নির্যাতন উপভোগ করছে। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তাদের। এর মানে নির্যাতিতকে কেউ তারই মতো সমান অধিকারের নাগরিক মনে করছে না। গত নির্বাচনে নির্বাচনী আইন ভঙ্গের কারণে একমাত্র মোদির বিরুদ্ধেই নির্বাচন কমিশন কোনো শাস্তি বা রায় দেয়নি। কেন? বিজেপি দলের ম্যানিফেস্টোতে নাগরিক অধিকার প্রসঙ্গে কোনো বক্তব্য নেই কেন? নির্বাচন কমিশন কোনো আপত্তি তুলেনি কেন? আবার এদের মুসলমানবিদ্বেষী বক্তব্য দেয়ার উৎস হিসেবে দলের দলিল তালাশ করে দেখেছে; কখনো কোনো প্রশ্ন তুলেছে মনে হয় না। অথচ এগুলো সবই নাগরিক অসাম্যের মামলা। মানে সেকুলারিজমের ভঙ্গের মামলা। অথচ ধারণা দিয়ে রাখা হয়েছে সেকুলারিজম শব্দের আড়ালে ইসলামবিদ্বেষ করা ও উল্টা বৈষম্য করা বৈধ।
এভাবে এক হিন্দুত্ববাদ ছেয়ে বসছে চারদিকে; যেন হিন্দুত্ববাদই, অর্থাৎ এর এই বৈষম্য ও অবিচারের আধিপত্যই একালের নিয়ম!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

goutamdas1958@hotmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us