করোনার করুনা : মাস্কে মুনাফা

মীযানুল করীম | Mar 21, 2020 05:03 pm
করোনার করুনা : মাস্কে মুনাফা

করোনার করুনা : মাস্কে মুনাফা - ছবি : সংগ্রহ

 

করোনাভাইরাস সারা দুনিয়ায় অভূতপূর্ব আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। কেউ কেউ করোনাকে ভুলবশত ‘করুণা’ বলছেন। আসলে করুণা বা দয়া এখন খুব জরুরি আর তা গোটা মানবজাতির জন্যই। সে করুণা একমাত্র পরম করুণাময়ের। অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার। অনেকেই বলছেন, করোনাভাইরাস মূলত ‘আল্লাহর গজব’ বা অভিশাপ। কিন্তু অহেতুক বা অতিরিক্ত আতঙ্কিত হওয়ার কোনো যুক্তি নেই। কারণ মহান আল্লাহ মানবজাতিকে বিপদ-বিপর্যয় যেমন দিয়েছেন, তেমনি তা থেকে উত্তরণের উপায়ও দিয়েছেন। বিপদ আপদ পার্থিব জীবনে অপরিহার্য এবং এ কারণে তা স্বাভাবিক। তবে এটা থেকে শিক্ষা নিয়ে সাবধান হওয়াই বড় কথা। ইসলাম দোয়া ও দাওয়া-দুটোকেই গুরুত্ব দিয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর রহমত এবং মানুষকে তাঁর প্রদত্ত উদ্ভাবনী প্রতিভাজাত ওষুধপত্র, উভয়ই মানুষের সুস্থতা ও সুস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। একইভাবে বলতে হয়, বিশ্বজুড়ে যে করোনাতঙ্ক বিরাজ করছে এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে, এর থেকে কী শিক্ষণীয় রয়েছে, সেটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ বিপদ আমাদের ওপর আপতিত হওয়া অসম্ভব নয়।

এ পর্যন্ত পত্রপত্রিকা বা মিডিয়ায় যেসব আলোচনা, পরামর্শ, অভিমত প্রভৃতি প্রকাশিত হয়েছে, তার আলোকে বলা যায়, বিদ্যমান করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মহাঘটনা মানবজাতিকে কয়েকটি ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনের তাগিদ দিচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো করোনার উৎপত্তিস্থলের কিছু বিষয়। যেমন খাদ্যাভ্যাস, পরিচ্ছন্নতা, সীমালঙ্ঘন, আল্লাহর আনুগত্য থেকে বিচ্যুতি প্রভৃতি। সেই চীন থেকে করোনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেছে এশিয়ার ইরান থেকে ইউরোপের ইতালি হয়ে আটলান্টিক সংলগ্ন স্পেনে। শুধু চীন নয়, মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সব দেশ ও জাতি নিজেদের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে দেখা উচিত গভীরভাবে।

ডাক্তাররা বলছেন, করোনা রোধে সারাক্ষণ মাস্ক পরা জরুরি নয়। আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তার চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তার-নার্স কিংবা রোগীর সেবায় রত ঘনিষ্ঠজনরাই মাস্ক পরা বেশি দরকার। কিন্তু ভীতি জনমনে এত ব্যাপক যে, রাস্তাঘাটে, হাটবাজারে, যানবাহনে বেশির ভাগ মানুষ মাস্ক পরছেন কয়েক গুণ দামে কিনে। ৩০ টাকার মাস্ক চার-পাঁচ গুণ বেশি দামে কিনতে হয়েছে। সরকার বাধ্য হয়ে নির্দেশ দিয়েছে, ‘মাস্কের মূল্য কিছুতেই ৩০ টাকার বেশি হতে পারবে না।’ এটা প্রযোজ্য মেডিক্যাল মাস্কের মতো বিজ্ঞানসম্মত ও উন্নত ধরনের মাস্কের বেলায়। সরকার ওই নির্দেশ দেয়ার পরদিনই মাস্কের দাম অর্ধেকে নেমে আসে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের ভয়ে বিক্রেতাদের কেউ কেউ ফুটপাথে মাস্ক রেখেই গা-ঢাকা দিয়েছিলেন। পরদিন মাস্কের দাম আরো কমে যায়। কর্তৃপক্ষের ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’র সুযোগে এখন একেকটি মাস্ক রাজধানীর কোথাও ৩০-৪০ টাকায়, আবার কোথাও বা এর ডাবল দামে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতাদের কথা বাদ দিলেও বলা যায়, মাস্কের বড় ব্যবসায়ীরা মানুষের করোনাভীতিকে পুঁজি করে ক্রেতাদের শুধু পকেট নয়, ‘গলাও কাটছেন’।

করোনাভাইরাস নিয়ে নানা অপপ্রচার এবং স্ববিরোধী বক্তব্যে দেশের মানুষ কম বিভ্রান্ত হচ্ছে না। ভাইরাস অত্যন্ত ক্ষুদ্র জীবাণু, যা খালি চোখে দেখা যায় না। কোনো কোনো মিডিয়াতে পর্যন্ত করোনাকে ‘কীট’ বলা হয়েছে, যা সত্যের অপলাপ। ‘কীট’ ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার তুলনায় অনেক বড়। সে কারণে কীট দেখার জন্য অণুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন হয় না; খালি চোখেই এগুলো দেখা যায়। প্রথম দিকে কোনো কোনো মন্ত্রীর বক্তব্যও ছিল বিভ্রান্তিকর। যেমন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের সূচনা হয়েছে চীনের যে উহান নগরীতে, সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রবাসী নাগরিকদের দেশে ফেরত আনা নিয়েও ‘নাটক’ করা হয়েছে। এই বিপন্ন প্রবাসীরা যখন করোনাক্রান্ত চীনে আটকা পড়ে দিশাহারা, তখন আমাদের এক মন্ত্রী বললেন, ‘তাদের আনার মতো খরচ বহন করা, অর্থাৎ প্রয়োজনীয় বিমান ভাড়া দেয়ার সাধ্য বাংলাদেশ সরকারের নেই বলে দেশে আনা যাচ্ছে না।’

এই অবিশ্বাস্য কথা শুনে সচেতন নাগরিকরা সাথে সাথে প্রশ্ন তুলেছেন, করোনার কবল থেকে বাঁচাতে প্রবাসীদের দেশে নিয়ে আসা কি আমাদের সরকারের দায়িত্ব নয়? দেশে ‘উন্নয়নের জোয়ার’ বইয়ে দেয়া এবং ক্ষমতাসীন মহলের অন্যায়-অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য টাকার অভাব না হলে জরুরি কাজে কেন হবে? এ অবস্থায় আরেকমন্ত্রী নিজেদের মুখ রক্ষার্থে বলেছেন, ‘আসলে টাকার অভাব নয়, টেকনিক্যাল কারণে প্রবাসীদের চীন থেকে আনতে দেরি হচ্ছে।’ তবে কথিত ‘টেকনিক্যাল’ বিষয় কী, সে রহস্য উন্মোচিত হয়নি। এ দিকে, ‘বিশেষজ্ঞ’দের কেউ বললেন, করোনাভাইরাস এ দেশের তাপমাত্রায় বাঁচার কথা নয়। কেউ বলেছেন, এটা বাতাসে ছড়ায় না। এ ধরনের সান্ত্বনার পাশাপাশি শঙ্কার কারণও দেখা গেছে। প্রচার করা হলো- করোনাভাইরাস জামাকাপড়ে কয়েক ঘণ্টাও বেঁচে থাকতে পারে। অপর দিকে শোনা গেল, ‘করোনার প্রধান লক্ষণ সর্দি-কাশি-হাঁচি।’ আর যায় কোথায়?

সাথে সাথে বিরাট বিপদে পড়ে গেলেন এ মৌসুমের সাধারণ রোগীরাও। মেট্রোরেল আর এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ধকলসহ অতিরিক্ত ধুলোবালু আর আবহাওয়ার ঠাণ্ডা-গরমের এ দিনে এখন অবস্থা আরো খারাপ। সর্দি, কাশি, হাঁচি ইত্যাদি বেশি হতে দেখা যায় এ সময়ে। গলাব্যথাও হয়ে থাকে অনেকের। এটাও নাকি করোনা সংক্রমণের একটা বড় লক্ষণ। এ অবস্থায় এসব রোগী আর চিকিৎসা পেলেন না। কারণ ডাক্তাররা তাদের সন্দেহ করেছেন ‘করোনা দ্বারা আক্রান্ত’ হিসেবে। অতএব, আগে পরীক্ষা করাতে হবে অথবা কোয়ারেন্টাইনে যেতে হবে। করোনার টেস্ট করানো বাংলাদেশে এত সোজা বা সস্তা নয়, যদিও ভীতি ও আতঙ্ক ব্যাপক। এই টেস্টের কিট (‘কীট’ নয়) নাকি আছে দেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্য কেবল হাজারখানেক। হঠাৎ প্রচার করা হলো, ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ খাবার বেশি খেলে করোনা কিছু করতে পারবে না। অতএব, সালাদ-সবজি মিলে এ ধরনের খাবার কেনা, মজুদ করা ও খাওয়ার তোড়জোড় শুরু হলো। কিন্তু দু-চার দিনের মধ্যেই ওয়াকিবহাল সূত্র জানালেন, “অতিরিক্ত ভিটামিন ‘সি’ গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই। এতে যে করোনার করুণা হবে, তার নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। এমনিতেই সব সময় আমাদের ভিটামিন ‘সি’ দরকার সেটা উপকারী বলে।” করোনা পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি হচ্ছে। তাই দেশের মানুষ আতঙ্কে। তদুপরি গুজবের বাজার রমরমা। করোনার ক্রমবর্ধমান হামলায় অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে, কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে, পণ্যের উৎপাদন সম্ভব হবে না, অসংখ্য মানুষ হবে বেকার, বিদেশ থেকে আমদানির উপায়ও থাকছে না- এসব কথা বারবার শোনা যাচ্ছে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপাতি দুই দিন পরে বেশি দামেও পাওয়া যাবে কি না ভেবে মানুষ উদ্বিগ্ন। তাই বাজারে, দোকানে, বিপণিতে দুই হাতে কেনার ধুম।

নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, উচ্চ আর মধ্যবিত্ত নির্বিশেষে সবাই দরকারি- কম দরকারি- বেদরকারি জিনিসপত্র কিনে মজুদ করছেন। এ জন্য সুপারমলে সুপার মমদের ভিড় কম দেখা যায়নি। এর কারণ, প্রচারণা ও ভীতি। ভবিষ্যতের ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত হয়ে কিছু বলতে পারছেন না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী, প্রতিযোগিতা প্রভৃতি ৩১ মার্চ, ১৫ বা ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত আপাতত বন্ধ। তবে এরপর কী হবে কিংবা ইতোমধ্যে পরিস্থিতির কী দশা দাঁড়াবে, তা কিন্তু নিশ্চয়তার সাথে বলার সাধ্য নেই। সুতরাং নেতিবাচক প্রচারণার পোয়াবারো। এর সোজা অর্থ, সত্যিকার সচেতনতা ও প্রস্তুতির চেয়ে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা অধিক। করোনা নিয়ে নানা ধরনের প্রচার-প্রপাগান্ডার বিরাট অংশই গুজব। দিশাহারা হয়ে, গুজবে কান দেয়া অনুচিত বলে যারা মনে করেন; তারাও বিভ্রান্তির কবলে পড়ছেন। কথায় বলে, ‘গুজবের হাত-পা নেই’। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তার দুটোই আছে। ‘হাত’ না থাকলে গুজব এত প্রভাবশালী হয় কী করে? আর ‘পা’ না থাকলে এত দ্রুত ছড়ায় কিভাবে?

দেশ-দুনিয়ার পরিস্থিতি দেখে মানুষের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। কর্তৃপক্ষ সময়মতো পরিস্থিতির মোকাবেলা না করলে সতর্কতা ও প্রস্তুতির পরিবর্তে ‘গুজব’ আর ‘গজব’ সবাইকে গ্রাস করে নিতে পারে। এ মুহূর্তে চাই আল্লাহর রহমত আর মানুষের হিম্মত (সেই সাথে হিকমত বা বুদ্ধি-কৌশল-প্রযুক্তিও)। ‘হুজ্জতে বাঙ্গাল’ আর ‘হিকমতে চীন’ বলে প্রবাদ চালু রয়েছে। তা যেন অন্তত বাঙালির বেলায় আর সত্য না হয়। চীন নাকি তার অসাধারণ হিকমতের জোরে রাতারাতি হাসপাতাল গড়ে; যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি নিয়ে করোনা ঠেকিয়েছে এবং তাকে রাজধানী বেইজিং কিংবা প্রধান বন্দর সাংহাইয়ের দিকে যেতে দেয়নি। অথচ আমরা বাংলাদেশে হাসপাতালের নোংরা বেডে পরিষ্কার বেডশিট বিছিয়ে করোনা মোকাবেলার কৃতিত্ব পেতে চাচ্ছি।

পাদটীকা :

১. ফুটপাথে এক লোক চুটিয়ে বিক্রি করছে মাস্ক। করোনা প্রতিরোধের মহৌষধ ভেবে সবাই অনেক বেশি দামে তা কিনছেন। এক ক্রেতা সেই বিক্রেতাকে দেখে বললেন, ‘কী রে তুই না বাজারে মাছ বেচতি?’ তার জবাব, ‘হ স্যার ঠিকই কইছেন। তয় আপনাগো দোয়ায় অহন মাছ ছাইড়া মাস্ক বেচতাছি।’

২. দু’লোক গলাগলি করে হাঁটছে। তা দেখে চোখ কপালে তুলে আরেক ব্যক্তি বললেন- ‘আপনারা একজন আরেকজনের বিরাট দুশমন। আজ দেখছি গলায় গলায় ভাব। ব্যাপার কী?’ দু’জনের একজন বললেন, ‘ব্যাপার কিছু না। উনি পেঁয়াজ বিক্রি করে ভালোই মুনাফা করেছেন। আর এখন আমি কামাচ্ছি মাস্ক বেশি দামে বেচে।’


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us