করোনা ও আইয়ুব আ:-এর আমল

জামান শামস | Apr 12, 2020 07:09 am
করোনা ও আইয়ুব আ:-এর আমল

করোনা ও আইয়ুব আ:-এর আমল - সংগৃহীত

 

পবিত্র কুরআন থেকে জানতে পারি যে, নবীগণের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন অসুখ হজরত আইয়ুব আ:-এর হয়েছিল। আল্লাহ নিজেই কুরআনে কারিমে সূরা আল আম্বিয়া ৮৩ ও ৮৪ আয়াতে সেটা বর্ণনা করেছেনÑ ‘এবং স্মরণ করুন আইয়ুবের কথা, যখন তিনি তাঁর পালনকর্তাকে আহ্বান করে বলেছিলেন : আমি দুঃখকষ্টে পতিত হয়েছি এবং আপনি দয়াবানদের চেয়েও সর্বশ্রেষ্ঠ দয়াবান। অতঃপর আমি তাঁর আহ্বানে সাড়া দিলাম এবং তাঁর দুঃখকষ্ট দূর করে দিলাম এবং তাঁর পরিবরাবর্গ ফিরিয়ে দিলাম, আর তাদের সাথে তাদের সমপরিমাণ আরো দিলাম আমার পক্ষ থেকে কৃপাবশত আর এটা এবাদতকারীদের জন্য উপদেশস্বরূপ।’

কুরআন থেকে শুধু এতটুকু জানা যায় যে, তিনি কোন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে সবর করে যান এবং অবশেষে আল্লাহর কাছে দোয়া করে রোগ থেকে মুক্তি পান। এই অসুস্থতার দিনগুলোতে তার সন্তান-সন্ততি, বন্ধু-বান্ধব সবই উধাও হয়ে গিয়েছিল। এরপর আল্লাহ তায়ালা তাকে সুস্থতা দান করেন।
হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘আল্লাহর নবী আইয়ুব আলাইহিসসালাম আঠারো বছর মুসিবত ভোগ করেছিলেন। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তাকে তার ভাই বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে দুইজন ছাড়া সবাই ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। এ দুইজন সকাল-বিকেল তার কাছে আসতেন। তাদের একজন অপরজনকে বললÑ জেনে নাও আল্লাহর শপথ! অবশ্যই আইয়ুব এমন কোনো গোনাহ করেছেন যার মতো গোনাহ সৃষ্টিজগতের কেউ করেনি। তার সাথী বললÑ এটা কেন বললে? জবাবে সে বলল : আঠারো বছর থেকে তিনি এমন কঠিন রোগে ভুগছেন অথচ আল্লাহ তার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাকে তা থেকে মুক্তি দিচ্ছেন না। এ কথা শোনার পর সাথীটি আইয়ুব আলাইহিসসালামের সাথে দেখা করতে গিয়ে ব্যথিত হয়ে কথাটি তাকে জানিয়ে দিলেন।’

তখন আইয়ুব আলাইহিসসালাম তাকে বললেন : আমি জানি না তুমি কি বলছ, তবে আল্লাহ জানেন পূর্বে আমি কখনো ঝগড়ায় লিপ্ত দু’জনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এটাও শুনতাম যে, তারা আল্লাহর নামে মিথ্যা কথা বলে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করত। তখন আমি বাড়ি ফিরে তাদের পক্ষ থেকে কাফফারা আদায় করতাম এই ভয়ে যে, তারা হক ছাড়া অন্য কোনোভাবে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করেনি তো?
ঘটনা বর্ণনা করতে করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : আইয়ুব আলাইহিসসালাম তার প্রাকৃতিক কাজে সারাতে বের হতেন। কাজ সারার পর তার স্ত্রী তার হাত ধরে নিয়ে আসতেন। একদিন তিনি তাঁর প্রাকৃতিক কাজ সারার পর তার স্ত্রীর কাছে ফিরতে দেরি করছিলেন এমন সময় আল্লাহ তায়ালা আইয়ুব আলাইহিসসালামের কাছে ওহি পাঠালেন যে, ‘আপনি আপনার পা দিয়ে ভূমিতে আঘাত করুন, এই তো গোসলের সুশীতল পানি ও পানীয়।’ [সূরা সোয়াদ : ৪২]

তার স্ত্রী তার আগমনে দেরি দেখে নিজেই এগিয়ে গিয়ে তার কাছে পৌঁছলেন। তখন আইয়ুব আলাইহিসসালামের যাবতীয় মুসিবত দূর হয়ে তিনি আগের মতো সুন্দর হয়ে গেলেন। তার স্ত্রী তাকে দেখে বললেন : হে আগন্তুক মানুষ! আল্লাহ আপনার ওপর বরকত দিন, আপনি কি ওই বিপদগ্রস্ত— আল্লাহর নবীকে দেখেছেন? আল্লাহর শপথ, যখন তিনি সুস্থ ছিলেন তখন ছিলেন আপনার মতোই দেখতে। তখন আইয়ুব আলাইহিসসালাম বললেন, আমিই সেই ব্যক্তি। আইয়ুব আলাইহিসসালামের দুটো উঠান ছিল। একটি গম শুকানোর অপরটি যব শুকানোর। আল্লাহ তায়ালা সে দুটোর ওপর দুই খণ্ড মেঘ পাঠালেন। এক খণ্ড মেঘ সে গমের উঠানে এমনভাবে স্বর্ণ ফেলল যে, সেটি পূর্ণ হয়ে গেল। অপর মেঘ খণ্ডটি অপরটির ওপর এমনভাবে রৌপ্য বর্ষণ করল যে, সেটাও পূর্ণ হয়ে গেল। [সহীহ ইবন হিব্বান: ৭/১৫৭, হাদিস নং ২৮৯৮, মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/৬৩৫, ৪১১৫]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : একবার আইয়ুব আলাইহিসসালাম কাপড় খুলে গোসল করছিলেন, এমতাবস্থায় একঝাঁক স্বর্ণের টিড্ডি (পঙ্গপাল) তার ওপর পড়তে আরম্ভ করল, তিনি সেগুলো মুঠি মুঠি তার কাপড়ে জমা করছিলেন। তখন তার প্রভু তাকে ডেকে বললেন : হে আইয়ুব আমি কি আপনাকে যা দেখছেন তা থেকেও বেশি প্রদান করে ধনী করে দেইনি? উত্তরে আইয়ুব আলাইহিসসালাম বললেন : অবশ্যই হে প্রভু! তবে আপনার দেয়া বরকত থেকে আমি কখনো অমুখাপেক্ষী হবো না। [বুখারি : ৩৩৯১, ২৭৯]

আইউব আ:-এর দোয়ার ধরন অত্যন্ত পবিত্র, সূক্ষ্ম ও নমনীয়! সংক্ষিপ্ত বাক্যের মাধ্যমে নিজের কষ্টের কথা বলে যাচ্ছেন এবং এরপর একথা বলেই থেমে যাচ্ছেনÑ ‘আপনি করুণাকারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।’ এরপরে কোনো অভিযোগ ও নালিশ নেই, কোনো জিনিসের দাবি নেই। তাতেই আল্লাহ খুশি হয়ে তার দোয়া কবুল করলেন। পরবর্তী আয়াতে দোয়া কবুল হওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। [দেখুন, ফাতহুল কাদীর]

বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর আইয়ুবের স্ত্রী ছাড়া আর সবাই তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করেছিল, এমনকি সন্তানরাও তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। এ দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলছেন, যখন আমি তার রোগ নিরাময় করলাম, সব পরিবারবর্গ তার কাছে ফিরে এলো এবং তার পর আমি তাকে আরো সন্তান দান করলাম। একজন বুদ্ধিমানের জন্য এর মধ্যে এ শিক্ষা রয়েছে যে, ভালো অবস্থায় আল্লাহকে ভুলে গিয়ে তার বিদ্রোহী হওয়া উচিত নয় এবং খারাপ অবস্থায় তার আল্লাহ থেকে নিরাশ হওয়াও উচিত নয়। তাকদিরের ভালোমন্দ সরাসরি এক ও লা শরিক আল্লাহর ক্ষমতার আওতাধীন। তিনি চাইলে মানুষের সবচেয়ে ভালো অবস্থাকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পরিবর্তিত করে দিতে পারেন আবার চাইলে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে তাকে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় পৌঁছে দিতে পারেন। তাই বুদ্ধিমান ব্যক্তির সব অবস্থায় তাঁর ওপর ভরসা এবং তাঁর প্রতি পুরোপুরি নির্ভর করা উচিত। [দেখুন, মুয়াসসার]

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত যে, আইয়ুব আলাইহিস সালামের অসুস্থতার সময় একদা শয়তান চিকিৎসকের বেশে আইয়ুব আলাইহিস সালামের পতœীর সাথে সাক্ষাৎ করেছিল। তিনি ওকে চিকিৎসক মনে করে স্বামীর চিকিৎসা করতে অনুরোধ করেন। শয়তান বলল, এই শর্তে চিকিৎসা করতে পারি যে, আরোগ্য লাভ করলে এ কথার স্বীকৃতি দিতে হবে যে, আমিই তাকে আরোগ্য দান করেছি। এ স্বীকৃতিটুকু ছাড়া আমি আর কোনো পারিশ্রমিক চাই না। স্ত্রী আইয়ুবকে এ কথা বললে, তিনি বললেনÑ তোমার সরলতা দেখে সত্যই দুঃখ হয়। ও তো শয়তান ছিল। এ ঘটনার বিশেষত তার স্ত্রীর মুখ দিয়ে শয়তান কর্তৃক এমন একটা প্রস্তাব তার সামনে উচ্চারিত করানোর বিষয়টা তিনি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারলেন না। তিনি খুব দুঃখ পেলেন। কারণ, প্রস্তাবটা ছিল শিরকিতে লিপ্ত করার একটা সূক্ষ্ম অপপ্রয়াস। তাই তিনি শপথ করে বসলেন যে, আল্লাহ তাআলা আমাকে সুস্থ করে তুললে স্ত্রীর এ অপরাধের জন্য তাকে এক শ’ বেত্রাঘাত করব। সে ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লাহ পাক নির্দেশ দিচ্ছেন, শপথ ভঙ্গ করো না, বরং হাতে এক মুঠে তৃণশলাকা নিয়ে তদ্বারা স্ত্রীকে এক শ’বার আঘাত করে শপথ পূর্ণ কর। তবে কোনো অসমীচীন কাজের প্রতিজ্ঞা করলে তা ভেঙে কাফফারা আদায় করাই শরিয়াতের বিধান। এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : ‘যে ব্যক্তি কোনো প্রতিজ্ঞা করে, অতঃপর দেখে যে, এ প্রতিজ্ঞার বিপরীত কাজ করাই উত্তম, তবে তার উচিত উত্তম কাজটি করা এবং প্রতিজ্ঞার কাফফারা আদায় করা। [মুসলিম : ১৬৫০]
আগামীকাল- আইয়ুব আ:-এর আমল থেকে শিক্ষা


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us