তখন করোনাভাইরাস মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর আজাব

হামিদ মীর | Apr 24, 2020 06:20 am
করোনাভাইরাস

করোনাভাইরাস - সংগৃহীত

 

সন্ধ্যা ৭টা। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আরোপিত বন্দিদশায় বিরক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিই, অল্প সময়ের জন্য হাঁটতে বের হবো। বাড়ির ছাদে হেঁটে মন ভরেনি। তাই মারগালা রোডের দিকে বের হলাম। এক মাস ধরে ইসলামাবাদের সব পার্ক বন্ধ। বৃষ্টির কারণে শালিমার গ্রাউন্ডে হাঁটার নির্দিষ্ট স্থানে পানি জমে ছিল। তাই গ্রাউন্ডের সামনে মারগালা রোডের ফুটপাথে হাঁটার জন্য গাড়ি দাঁড় করালাম। মুহূর্তেই ইসলামাবাদ পুলিশের একটি জিপ কাছে এলো। পুলিশের একজন সদস্য জিপ থেকে নেমে চেহারা থেকে মাস্ক সরালেন। ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে সতর্ক করে বলতে লাগলেনÑ জনাব, একটি চিতাবাঘ আমাদের জীবনকে বিপদে ফেলে দিয়েছে। কাল রাতেও চিতাবাঘটি এ স্থানে ঘোরাফেরা করেছে, যেখানে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। এরপর তিনি রাস্তার ধারে একটি বাড়ির দিকে ইশারা করে বললেন, তারা মোবাইল ফোনে চিতাবাঘের ভিডিও করে আমাদের এক অফিসারের কাছে পাঠিয়েছেন। এখন আমাদের ডিউটি হচ্ছে, সবাইকে এ চিতাবাঘ থেকে সাবধান করা।

এ কথা শুনে আমি মনোমুগ্ধকর বিস্ময়ে নিমজ্জিত হলাম। চেহারা থেকে মাস্ক সরিয়ে পুলিশের সদস্যকে বললাম, এ তো বেশ ভালো খবরÑ গ্রীষ্মের শুরুতেও ইসলামাবাদে চিতাবাঘ দেখা গেল। আমরা তো এটাই ভাবতাম, শীত মওসুমের তুুষারপাতের পর চিতাবাঘ মুরি ও গালিয়াতের জঙ্গল থেকে নিচে নেমে এসে মারগালার পর্বতমালায় চলে আসে এবং গ্রীষ্মকাল আসার আগেই ফিরে চলে যায়। আমি পুলিশের সদস্যকে বললাম, যদি আপনারা চিতাবাঘ দেখতে পান, তাহলে দয়া করে তাকে গুলি করবেন না। পুলিশের সদস্য আমাকে চিনে ফেললেন। চিতার জীবনের জন্য আমার আকুতিতে তিনি অবাক হয়ে বললেন, জনাব, ওই চিতা মারগালা রোডে কোনো সম্ভ্রান্ত নাগরিকের ওপর হামলা করে বসলে, তাকে ধরার জন্য আমাদের পর্বতমালার ওপর হন্যে হয়ে ঘুরতে হবে। সুতরাং আপনি সতর্ক থাকবেন। পুলিশ সদস্যের পক্ষ থেকে বারবার সতর্ক করা আমার বেশ ভালো লাগছিল। ইসলামাবাদে চিতার উপস্থিতির সংবাদও আমার বেশ ভালো লাগল। কেননা ইসলামাবাদে শূকর-কুকুর দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। করোনাভাইরাসের কারণে আংশিক লকডাউন অন্য শহরগুলোর মতো ইসলামাবাদেও মানুষের চলাফেরা সীমিত করে দিয়েছে। এর পরই অতি দ্রুত চক্রান্তের এ শহরে রঙ-বেরঙের পাখির আনাগোনা শুরু হয়। বহুকাল পর পাহাড়ি বুলবুলিসহ দীর্ঘ লেজবিশিষ্ট তিতির ও মাছরাঙারও দেখা মিলতে শুরু করল। খুব সকালে পাখিদের কিচিরমিচিরে অনেক নতুন সুর যুক্ত হলো। আর এ নতুন সুরগুলো করোনাভাইরাসে সৃষ্ট মানসিক চাপ হ্রাসে সাহায্য করছে, যে ভাইরাস লক্ষাধিক মানুষকে গিলে ফেলেছে। বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, এ ভাইরাস বাদুড়-চামচিকা ও বানরের গোশত ভক্ষণকারী মানুষরা ছড়িয়েছে।

বাদুড়-চামচিকা ধরা এবং তার স্যুপ বানিয়ে খাওয়া চীনের সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর মানুষের অন্যতম বিলাসিতা। পুরো বিশ্ব করোনাভাইরাসের মাধ্যমে তাদের বিলাসিতার খেসারত দিচ্ছে। আপনি এটা শুনে অবাক হয়ে যাবেন, ইসলামাবাদেও এমন কিছু লোক রয়েছে, যারা অর্ডার দিয়ে মারগালা পর্বতমালা থেকে বিভিন্ন ধরনের পাখিসহ শূকর, বানর ও বাদুড়-চামচিকা ধরে নিয়ে এসে বিক্রি করে এবং এগুলো চোরাই পথে না জানি কোথায় চলে যায়। মারগালা পর্বতমালায় সাড়ে তিন শতাধিক প্রজাতির পাখি, পঞ্চাশের বেশি প্রজাতির প্রজাপতি, ছয় প্রজাতির সাপ এবং ১০ প্রজাতির বাদুড়-চামচিকা পাওয়া যায়। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত এখানে বিশাল সংখ্যায় বার্কিং ডিয়ার (মায়া হরিণ) হরিণ পাওয়া যেতো। কিন্তু আজ তাদের বসবাস খুবই কম। করোনাভাইরাসের কারণে শহরের রাস্তাগুলোতে যান চলাচল কম হওয়ায় বানরও পর্বতমালা থেকে নিচে নেমে এসেছে। তারা এফ-সিক্স ও এফ-সেভেনের বাড়িগুলোর ছাদে লটকানো কাপড় নিয়ে চলে যাচ্ছে।

অনেক নাগরিক পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন, দুষ্ট বানরগুলো থেকে তাদের রক্ষা করা হোক। এ ধারাবাহিকতায় মারগালা হিলস ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের প্রাণপুরুষ ড. আনিসুর রহমানের অভিমত একেবারে ভিন্ন। মারগালা পর্বতমালা দীর্ঘকাল ধরে পশুপাখি ও জীবজন্তুর আবাসস্থল ছিল। কিন্তু আমরা মানুষরা তাদের বাড়িতে অনুপ্রবেশ করে আগে জঙ্গল থেকে কাঠ চুরি করেছি। এরপর হরিণ শিকার শুরু করেছি। অতঃপর এখান থেকে রঙ-বেরঙের পাখি ধরে বেচাকেনা শুরু করেছি। দামানে কোহ ও পিরসোহাওয়াতে রেস্টুরেন্ট হওয়ার পর রাত পর্যন্ত ওই পর্বতমালায় যান চলাচলের উপস্থিতি পশুপাখি ও জীবজন্তুর শান্তি-নিরাপত্তা ধ্বংস করে দেয় এবং তাদের অনেকেই নিজেদের ঠিকানা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।

ড. সাহেব বলেন, করোনাভাইরাস আল্লাহর সতর্কতা। পর্বতমালা, বন-জঙ্গল ও বন-জঙ্গলে বসবাসকারী পশুপাখি ও জীবজন্তুর অধিকারের প্রতি খেয়াল করলে, আল্লাহও আপনার খেয়াল রাখবেন। ড. আনিসুর রহমান বলেন, মারগালা হিলস ম্যানেজমেন্ট বোর্ড জঙ্গলে জায়গায় জায়গায় ক্যামেরা লাগিয়ে রাখুক, যাতে প্রাণিকুলের পাশাপাশি তাদের ক্ষতিসাধনকারী ব্যক্তিদেরও নজরদারি করা যায়। তিনি বলেন, ইসলামাবাদের আশপাশের পর্বতমালায় চিতাবাঘের তিনটি জাতি স্থান করে নিয়েছে। কিছু দিন থেকে বারকিং ডিয়ার বা মায়া হরিণও দেখা যাচ্ছে। আমাদের তাদের থেকে ভীত হওয়ার পরিবর্তে তাদের সাথে জীবন অতিবাহিত করার পদ্ধতি শিখতে হবে। আমরা তাদের বাসভূমিতে অনুপ্রবেশ না করলে, তারাও আমাদের বাসভূমিতে আসবে না। আমরা সতর্ক হলে, তারাও সতর্ক হয়ে যাবে।
চিতা, হরিণ, বানর, তিতির ও মাছরাঙার আবাসভূমি জঙ্গল। জঙ্গল পাহাড়ে অবস্থিত। যে সময় লকডাউনের মাঝে শিথিলতা এনে নির্মাণ কার্যক্রমের ধারা বহাল করা হয়েছে, সে সময় মারগালা পর্বতমালায় পাহাড় ভেঙে ভেঙে পাথর সংগ্রহকারীরাও তাদের অবৈধ কার্যক্রম আবার শুরু করে দিয়েছে। মানুষ যখন বাদুড়-চামচিকা, জঙ্গল ও পাহাড় খেয়ে ফেলবে, তখন আবার এক নতুন মহামারী ছড়িয়ে পড়বে। করোনাভাইরাস অনেক মানুষ মেরে ফেলেছে। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে, এ ভাইরাস বায়ুদূষণ কমিয়ে দিয়েছে। আর এ ভাইরাস বন-জঙ্গলের প্রাণীদের জন্য হিতাকাক্সক্ষী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সর্বশ্রেষ্ঠ জীব তো মানুষ। বন-জঙ্গলের প্রাণীদের হিতাকাক্সক্ষী তো মানুষের হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আফসোস, মানুষ যখন শয়তানের রূপ ধারণ করেছে, তখন করোনাভাইরাস মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর আজাব এবং চিতা-বানরের জন্য রহমত হয়ে আবির্ভূত হয়েছে।

(পাকিস্তানের জাতীয় দৈনিক জং-এ ২০-০৪-২০২০ তারিখে প্রকাশিত নিবন্ধ) উর্দু থেকে তরজমা ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com

লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট,
প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us