মৃত্যু সংবাদে করণীয়

নাজির আহমদ | Jul 15, 2020 08:45 am
মৃত্যু সংবাদে করণীয়

মৃত্যু সংবাদে করণীয় - ছবি : সংগৃহীত

 

মৃত্যুর সংবাদ শুনে বলতে হয় ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’ বাংলা অর্থ : ‘আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চয়ই আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।’ এটি পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত বা বাক্যের অংশ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৫৬)। যে কারো মৃত্যুতে (এমনকি অমুসলমানের মৃত্যুতেও) অথবা যে কেউ বা নিজে বিপদ পড়লে অথবা অন্যের বা নিজের দুঃসংবাদ শুনলে এ বাক্যাংশটি পড়তে হয়। এটা ইসলামের সুন্দর আচারিত পদ্ধতি ও নিয়ম। এটি পড়লে যিনি পড়বেন তার সওয়াব হবে কুরআনের আয়াত হওয়ার কারণে। সহিহ হাদিস অনুযায়ী প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে নেকি বা সওয়াব পাওয়া যাবে। আয়াতটি তথা বাক্যটির অর্থ দেখুনÑ এটি অন্যের জন্য কোনো দোয়া নয় যা অনেকে অজ্ঞতাবশত মনে করে থাকেন। বরং এটি আল্লাহর জিকির তথা আল্লাহকে স্মরণ- এটির দ্বারা মহান প্রভু আল্লাহপাকের পরিচয় ও বড়ত্ব প্রকাশ পায়।

মৃত্যুতে কে কিভাবে ‘স্বস্তি’ পায়?

গভীরভাবে চিন্তা করুনÑ নিচের সহিহ হাদিসের আলোকে কেউ মরলে নিজে ‘স্বস্তি’ লাভ করে আবার কেউ মরলে মানুষ, দেশ, বৃক্ষ ও জীবজন্তু সবাই তার কাছ থেকে পরিত্রাণ পেয়ে ‘স্বস্তি’ বোধ করে। এখন আমাদের জীবন যদি এমন হয় যে আমাদের মৃত্যুতে মানুষ, দেশ, বৃক্ষ ও জীবজন্তু সবাই পরিত্রাণ পেয়ে ‘স্বস্তি’ বোধ করে, তাহলে আমাদের এ জীবনটা সত্যিই বরবাদ। তাই আমরা যারা জীবিত এমন জীবন গঠন করার চেষ্টা করা উচিত যাতে মরে আমরা লাভ করি ‘স্বস্তি’ আর মানুষ, দেশ, বৃক্ষ ও জীবজন্তু পরিত্রাণ পেয়ে ‘স্বস্তি’ বোধ না করে বরং কাঁদে।

হজরত আবু কাতাদাহ ইবনে রিবয়ী আনসারী রা: হতে বর্ণিত, তিনি হাদিস বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছ দিয়ে একটি মানুষের লাশ নিয়ে যাওয়া হলো। তখন রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘স্বস্তি লাভকারী এবং তার থেকে স্বস্তি লাভকৃত।’ সাহাবিগণ রা: জিজ্ঞেস করলেনÑ ইয়া রাসূলুল্লাহ সা:! ‘স্বস্তি লাভকারী এবং তার থেকে স্বস্তি লাভকৃত’-এর মানে কী? রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করলেন, ‘মুমিন বান্দা মৃত্যুবরণ করলে দুনিয়ার কষ্ট ও তাকলিফ থেকে পরিত্রাণ পেয়ে এবং আল্লাহর রহমত পেয়ে ‘স্বস্তি’ লাভ করে। আর বদকার বান্দা (পাপী ও জালিম) যখন মারা যায় তার কবল থেকে সব মানুষ, দেশ, বৃক্ষ ও জীবজন্তু সবাই (পরিত্রাণ পেয়ে) ‘স্বস্তি’ বোধ করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং: ৬১৪৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস নং: ১৫৭৯)

মৃত ব্যক্তিকে গালি দেয়া নিষেধ

ইসলামে অন্যকে গালি দেয়া সম্পূর্ণ হারাম। যেকোনো কারণেই হোক, কাউকে গালি দেয়ার অনুমতি নেই। হাসি-কৌতুক ও ঠাট্টাছলেও অন্যকে গালি দেয়া ইসলামের দৃষ্টিতে অশোভনীয়। মৃত ব্যক্তিদের গালি দিতে প্রিয় নবী সা: নিষেধ করেছেন। আয়েশা রা: হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সা: বলেছেন : ‘তোমরা মৃতদের গালি দিও না। কারণ, তারা তাদের স্বীয় কর্মফল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।’ (সহিহ বুখারি : ৬৫১৬)

গালি দেয়া, আর কর্মের সমালোচনা এক নয়

কেউ মারা গেলে তাকে কোনোভাবেই গালিগালাজ করা যাবে না। ইসলাম এটাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা বা না করা সম্পূর্ণ আপনার এখতিয়ার। মনে রাখা দরকার আপনার-আমার দোয়ায় কাউকে জান্নাত বা জাহান্নাম দিয়ে দেয়া হবে না। প্রত্যেককেই তার কৃতকর্মের ফলাফল যথাযথভাবে ভোগ করতে হবে বলে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনের বহু জায়গায় ঘোষণা দিয়েছেন। তবে অন্যের মৃত্যুতে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়া উচিত। এটি অন্যের জন্য কোনো দোয়া নয়। বরং এটা ইসলামের সুন্দর আচারিত পদ্ধতি ও নিয়ম যা দ্বারা মহান প্রভু আল্লাহ পাকের পরিচয় ও বড়ত্ব প্রকাশ পায়।

ব্যক্তিকে গালি দেয়া ঠিক নয়। কিন্তু চিহ্নিত কোনো জালিম বা সীমালঙ্ঘনকারী যার সিদ্ধান্তে বা কর্মকাণ্ডে হাজার বা লাখো মানুষ নিহত হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন অথবা দায়িত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে জনগণের টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে মেরে দিয়েছেন বা বিদেশে পাচার করেছেন এমন ব্যক্তি মারা গেলে তার ক্ষেত্রে কী করা হবে? তাকে গালি দেয়ার দরকার নেই। তবে তার কৃতকর্মের আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে। এর প্রয়োজন দু’টি কারণে। প্রথমত, তার মতো আরো যারা চিহ্নিত জালিম বা সীমালঙ্ঘনকারী আছেন তাদের শিক্ষা, অনুধাবন ও সংশোধনের জন্য। দ্বিতীয়ত, বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের জানা ও সতর্কতার জন্য। তাদের কৃতকর্মের আলোচনা-সমালোচনা না করে যদি শুধু জান্নাতের জন্য দোয়া করা হয়, তাহলে তাদের সমগোত্রীয়দের কাছে ভুল বার্তা যাবে। তাতে জাতি ও সমগোত্রীয়রা কোনো শিক্ষা তো নেবেই না বরং এগুলো কোনো ব্যাপারই নয় মনে করে আশকারা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
মহান আল্লাহ পাক তাঁর পবিত্র কুরআনে বড় বড় জালিমের (যেমন: ফেরাউন, হামান, আবু লাহাব, কারুণ, ছারেমী ও আজর প্রমুখ) নাম উল্লেখ করেছেন, ঘটনা বর্ণনা করেছেন ও ইতিহাস টেনেছেন নিশ্চয়ই আমাদের জানার জন্য, হৃদয়ঙ্গম করার ও শিক্ষা নেয়ার জন্য। সহিহ হাদিস থেকে প্রমাণিত নবী সা: ও সাহাবিরা কিছু কিছু জালিমের মৃত্যুতে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। মুসাইলামার মৃত্যুতে আবু বকর রা: সিজদাহ দিয়ে আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করেন। (সুনান, সাঈদ ইবনে মানসূর) মুখাদ্দাজ আল খারেজীর মৃত্যুতে খুশি হয়ে আলী রা: শুকরানা সিজদাহ দেন। (মুসনাদে আহমাদ)

সহিহ বুখারির শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার ইমাম ইবনে হাজার আসক্বালানী রাহ: তাঁর ‘লিসান আল-মিজাব’-এ একটা ঘটনা উল্লেখ করেন। ওয়াহাব আল-কুরাইশী নামের এক পথভ্রষ্ট মারা গেলে আবদুর রহমান ইবনে মাহদী বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ মুসলিমদের ওই পথভ্রষ্টের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।’ একজন ইমাম আহমাদকে রাহ: জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরকম আনন্দিত হওয়া কি পাপ?’ ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহ: জবাব দিলেন, ‘এমন কেউ কি আছে, এমন সংবাদ শুনে আনন্দিত হবে না?’ (আস-সুন্নাহ, আল-খাল্লাল) একজন বিদয়াতি গুরু মারা গেলে আল্লামা ইবনে কাসির রাহ: তাঁর বিখ্যাত ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ বইয়ে সেই ঘটনার বর্ণনা দেন এভাবে, ‘আল্লাহ মুসলিমদেরকে সেই পথভ্রষ্টের গোমরাহি থেকে রেহাই দিয়েছেন।’

তাছাড়া সহিহ বুখারির হাদিস (হাদিস নং : ৬১৪৭) থেকে জানা গেল যে নবী সা: বলেছেন, যখন জালিম মারা যায় তার কবল থেকে সব মানুষ, দেশ, বৃক্ষ ও জীবজন্তু সবাই (পরিত্রাণ পেয়ে) ‘স্বস্তি’ বোধ করে। মানুষের প্রশংসা ও দুর্নামের ভিত্তিতেও জান্নাত ও জাহান্নাম অবধারিত হতে পারে। আনাস রা: বলেন, কিছু লোক একটি মৃতদেহ নিয়ে পার হয়ে গেল। লোকেরা তার প্রশংসা করতে লাগল। নবী সা: বললেন, ‘অবধারিত হয়ে গেল।’ অতঃপর দ্বিতীয় আরেকটি মৃতদেহ নিয়ে পার হলে লোকেরা তার দুর্নাম করতে লাগল। নবী সা: বললেন, ‘অবধারিত হয়ে গেল।’ উমার ইবনে খাত্তাব রা: বললেন, ‘কী অবধারিত হয়ে গেল?’ তিনি বললেন, ‘তোমরা যার প্রশংসা করলে তার জন্য জান্নাত, আর যার দুর্নাম করলে তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে গেল। তোমরা হলে পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী।’ (বুখারি : ১৩৬৭, ২৬৪২, মুসলিম: ৯৪৯)

উপরের হাদিস ও দলিলের আলোকে কুখ্যাত জালিমদের বা সীমালঙ্ঘনকারীদের মৃত্যৃতে স্বস্তি প্রকাশ অন্যায় নয়। আর এই স্বস্তি প্রকাশ বলে কয়ে আসে না। এটা এমনিতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রকাশ পায়।

লেখক: ব্রিটেন প্রবাসী আইনজীবী, গবেষক ও বিশ্লেষক


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us