জিলহজের প্রথম দশকের করণীয়-বর্জনীয়

মুফতি আমিনুল ইসলাম | Jul 17, 2020 10:18 am
কাবাঘর

কাবাঘর - ছবি : সংগৃহীত

 

 

মুমিন জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, প্রতিটি দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর গুরুত্বপূর্ণ। কেননা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব আল্লাহর কাছে দিতে হবে। তাই মহররম থেকে জিলহজ ১২ মাসই ঈমানদাররা রাসূল সা:-এর তরিকায় আল্লাহর গোলামিতে কাটাবে। ১২ মাস যার আল্লাহর গোলামিতে কাটবে, সেই মুমিনের জন্য আল্লাহ্ তায়ালা নিজের পক্ষ থেকে বছরের কিছু সময়কে বোনাস হিসেবে অফার করেছেন। আসন্ন জিলহজ মাস সেই অফারের মধ্যে অন্যতম। কেননা আল্লাহর দেয়া সম্মানিত চার মাসের একটি হলো জিলহজ। জিলহজের প্রথম দশকের রয়েছে স্বতন্ত্র ফজিলত।

এই দশকের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। তাই তো আল্লাহ এই দশকের রাত্রীর শপথ করেছেন কুরআন কারিমে। ইরশাদ হয়েছে- ‘শপথ ফজরের, শপথ দশ রাত্রির।’ (সূরা ফাজর : ১-২)

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: ও মুজাহিদ রা:সহ অনেক সাহাবি, তাবেঈ ও মুফাসসির বলেন, এখানে ‘দশ রাত্রি’ দ্বারা জিলহজের প্রথম দশ রাতকেই বুঝানো হয়েছে। (তাফসিরে ইবনে কাসির ৪/৫৩৫)

 এই দশ দিনের নেক আমল আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত ইবনে আব্বাস রা: বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন- আল্লাহর কাছে জিলহজের ১০ দিনের নেক আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! সা: আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও (এর চেয়ে উত্তম) নয়? তিনি বললেন, না। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে হ্যাঁ, সেই ব্যক্তির জিহাদ এর চেয়ে উত্তম, যে নিজের জান-মাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য বের হয়েছে। অতঃপর কোনো কিছু নিয়ে ঘরে ফিরে আসেনি। (আবু দাউদ ২৪৩৮; বুখারি ৯৬৯)

এসব হাদিসের কারণে জিলহজের প্রথম দশকের আমলকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়। তাই এখানে এই দশকের কিছু করণীয়-বর্জনীয় আলোকপাত করা হলো।

১. সব ধরনের গুনাহ থেকে মুক্ত থাকা। কেননা ইরশাদ হয়েছেÑ ... সুতরাং এই মাসগুলোতে (জিলকদ, জিলহজ, মহররম, রজবে পাপাচার করে) তোমরা নিজেদের ওপর জুলুম করো না। (তাওবা-৩৬)

২. নখ-চুল না কাটা। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে- উম্মে সালামা রা: থেকে বর্ণিত, নবী কারিম সা: বলেছেন, যখন জিলহজের দশক শুরু হবে তখন তোমাদের মধ্যে যে কোরবানি করবে সে যেন তার চুল, নখ না কাটে। (মুসলিম-১৯৭৭)

এই হাদিসের ওপর ভিত্তি করে ফকিহরা কোরবানিকারীর জন্য নখ-চুল না কাটাকে মুস্তাহাব বলেছেন। তবে এ হুকুম তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে, যারা জিলকদের শেষে নখ-চুল কেটেছে। অন্যথায় নখ-চুল বেশি লম্বা হয়ে যাবে। যা সুন্নাতের খেলাফ। আর যে ব্যক্তি কোরবানি করবে না, তার জন্য এ হুকুম প্রযোজ্য কি না, এ ব্যাপারে কেউ কেউ বলেছেন, এ হুকুম শুধু কোরবানিকারীদের জন্য প্রযোজ্য। তাদের দলিল পূর্বোক্ত হাদিস। আর কেউ কেউ বলেন, কোরবানি যারা করবে না তাদের জন্যও। তাদের দলিল হলো নিম্নেœাক্ত হাদিস।
আবদুল্লাহ বিন আমর রা: থেকে বর্ণিত, নবী কারিম সা: বলেছেন, আমাকে কোরবানির দিবসে ঈদ (পালনের) আদেশ করা হয়েছে। যা আল্লাহ এ উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন।

এক সাহাবি আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানিহা থাকে (অর্থাৎ অন্যের থেকে নেয়া দুগ্ধ দানকারী উটনী) আমি কি তা কোরবানি করতে পারি? নবী কারিম সা: বললেন, না, তবে তুমি চুল, নখ ও মোচ কাটবে এবং নাভির নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর দরবারে তোমার পূর্ণ কোরবানি বলে গণ্য হবে। (আবু দাউদ ২৭৮৯; নাসায়ী- ৪৩৬৫) এই হাদিসে যেহেতু কোরবানির দিন চুল-নখ কাটার কথা আছে তাহলে এর আগে না কাটার দিকে ইঙ্গিত বুঝা যায়। এ কারণে কারো কারো মতে সবার জন্যই জিলহজের প্রথম দশকে নখ, গোঁফ ও চুল না কাটা উত্তম। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই, এ বিধানটি কোরবানিদাতার জন্য তাকিদপূর্ণ, তার জন্য তা সুন্নত।

৩. জিলহজের প্রথম ১০ দিন বেশি বেশি ইবাদত ও জিকির করা : হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছেÑ আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, আল্লাহ তায়ালার কাছে জিলহজের প্রথম দশকের আমলের চেয়ে অধিক মহৎ এবং অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সুতরাং তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি বেশি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার এবং আলহামদু লিল্লাহ পড়। (মুসনাদে আহমদ ৫৪৪৬; মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা ১৪১১০)

৪. জিলহজের প্রথম ৯ দিন রোজা রাখা। হাদিস শরিফে এসেছে, নবী কারিম সা: এই ৯টি দিবসে রোজা রাখতেন। (আবু দাউদ ২৪৩৭; মুসনাদে আহমদ ২২২৩৪; নাসাঈ ২৪১৬)

৫. ৯ জিলহজ রোজা রাখা মুস্তাহাব। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে- আবু কাতাদা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী ারিম সা: বলেছেন, ইয়াওমে আরাফার (৯ জিলহজ) রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, তিনি এর দ্বারা আগের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। (মুসলিম ১১৬২; তিরমিজি ৭৪৯; আবু দাউদ ২৪২৫)

এই হাদিসে বর্ণিত ইয়াওমে আরাফা দ্বারা জিলহজের ৯ তারিখ উদ্দেশ্য। এই তারিখের পারিভাষিক নাম হচ্ছে ইয়াওমে আরাফা। কেননা এই রোজা আরাফার ময়দানের আমল নয় বরং আরাফার দিন তো হাজীদের জন্য রোজা না রাখাই মুস্তাহাব। যেমন হাদিস শরিফে এসেছে, উম্মুল ফজল বিনতে হারেছ বলেন, তার কাছে কতক লোক ইয়াওমে আরাফায় রাসূল সা:-এর রোজার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করছিল। কেউ কেউ বলছিল তিনি রোজা আছেন। আর কেউ কেউ বলছিল তিনি রোজা নেই। উম্মুল ফজল একটি পেয়ালাতে দুধ পাঠালেন। নবীজী তখন উটের ওপর ছিলেন। তিনি দুধ পান করলেন। (মুসলিম ১১২৩)
আরাফার দিন আল্লাহর রাসূল রোজা রাখেননি। এ কারণে ফিকহবিদরা হাজীদের জন্য আরাফার দিন রোজা না রাখা উত্তম বলেছেন। আবু কাতাদা রা:-এর উক্ত হাদিস দ্বারা ইয়াওমে আরাফায় রোজা রাখা মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়। সুতরাং বুঝা গেল আবু কাতাদাহ রা:-এর হাদিসে ‘ইয়াওমে আরাফা’ দ্বারা ৯ জিলহজ অর্থাৎ ঈদের আগের দিনই উদ্দেশ্য। সুতরাং আমাদের দেশের চাঁদের হিসেবে যেদিন ৯ তারিখ হয় সে দিনই ইয়াওমে আরাফা হিসেবে রোজা রাখা মুস্তাহাব হবে। সৌদির হিসাবে আরাফার দিন অনুযায়ী ৯।

৬. তাকবিরে তাশরিক পড়া। ৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত মোট পাঁচ দিন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষ সবার জন্যই পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পর তাকবিরে তাশরিক বলা ওয়াজিব। (ফতোয়া শামী : ২/১৭৮) আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, আর তোমরা আল্লাহকে স্মরণ করো (আইয়ামে তাশরিকের) নির্দিষ্ট দিনগুলোতে।’ (সূরা বাকারা ২০৩)

৭. ১০ তারিখে সামর্থ্যবান ব্যক্তি কোরবানি করা। ইরশাদ হয়েছে, তুমি তোমার রবের জন্য সালাত আদায় করো এবং কোরবানি করো। (কাউসার-২)
‘রাসূলুল্লাহ সা: ঈদুল আজহার দিন নামাজ পরবর্তী খুতবায় বলেছেন, এই দিনের প্রথম কাজ হলো সালাত আদায় করা। এরপর নহর (কোরবানি) করা। (বুখারি-৯৫১, ৫৫৪৫, মুসলিম-১৯৬১)

আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামেয়া রাহমানিয়া দারুল ইসলাম, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us