জটিল বৈশ্বিক সমীকরণ ও বাংলাদেশ

ড. আবদুল লতিফ মাসুম | Oct 07, 2020 06:01 pm
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী - ছবি সংগৃহীত

 

পররাষ্ট্রনীতি বিশারদরা প্রায়ই বলে থাকেন, এটি হচ্ছে ‘অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সম্প্রসারিত অংশ’। আর জাতীয় নেতৃত্বই তা নির্ধারণ করেন। জাতীয় নেতৃত্বের দায়িত্ব জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ। এটি নীতিগত বিষয়। বাস্তব অর্থে জাতীয় স্বার্থের মহৎ শব্দাবলির আড়ালে ক্ষমতার স্বার্থই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এটাই স্বাভাবিক। ব্যক্তি, জাতীয় নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দল তখনই জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় নিবেদিত হতে পারবে যখন তারা ক্ষমতায় থাকবে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে তারা কি চাইবেন ক্ষমতাচ্যুত হতে? সুতরাং পররাষ্ট্রনীতি ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার স্বার্থেই পরিচালিত হয়; এটাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতার আলোকেই বাংলাদেশের আজকের পররাষ্ট্রনীতি ও সাম্প্রতিক বিতর্কের বিষয়টি আলোচিত হতে পারে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাথে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে আছে ভারতের সহায়তা। সে সময়ের স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনের উপর নির্ভর করতে হয়। ভারতের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘শান্তি ও মৈত্রী’ চুক্তির আলোকে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জিত হয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধের পরে ভারত-সোভিয়েত অক্ষশক্তিতে অবস্থান ভিন্ন অন্য চিন্তার ক্ষেত্রে বাস্তব ক্ষেত্রেই কোনো সুযোগ ছিল না। বঙ্গবন্ধুর আন্তর্জাতিক ইমেজ, সাহস ও স্বকীয়তায় ভিন্নতর প্রয়াস লক্ষ করা যায়। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ডে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। ‘সকলের সাথে মিত্রতা কারো সাথে নয় শত্রুতা’- পররাষ্ট্রনীতির এই বিঘোষিত নীতির তিনিই প্রবক্তা। এতদসত্ত্বেও বৃহত্তর মোড়কে বাংলাদেশের অবস্থান ভারত-সোভিয়েত আঁতাতেই রয়ে যায়। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনাবলি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সমীকরণ পাল্টে দেয়। বাংলাদেশ মার্কিন পক্ষপুটে অন্তর্ভুক্ত হয়।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভাষায় একে বলে- ‘প্যারাডাইম শিফট’ বা গুরুত্বপূর্ণ বাঁক পরিবর্তন। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে আবারো বাঁক পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে। ইতোমধ্যে নদী-সাগর-মহসাগরের স্রোতধারায় ঘটেছে অনেক পরিবর্তন। তখন আর সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই। ১৯৭১ এর শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনে যায় ভারতের মিত্র। ভারতের সাথে সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস ঘটে। জাতীয় নেতৃত্ব অবশ্য এবার সতর্কতার সাথে অগ্রসর হন। ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ বা নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা অনুযায়ী ভারত আঞ্চলিক শক্তির স্বীকৃতি পায়। সুতরাং এবারের পথচলা ঢাকা-দিল্লি-ওয়াশিংটন পরিক্রমায় পরিপূর্ণ মাত্রায় এই সংক্ষিপ্ত বিবৃতিটির প্রয়োজন ছিল সাম্প্রতিক সম্পর্ক বোঝাবার জন্য।

সর্বশেষ ঘটনা দিয়ে শুরু করি। গত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভারত-বাংলাদেশ ষষ্ঠ জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশন-জেসেসির মিটিং। পররাষ্ট্রনীতি মন্ত্রী পর্যায়ের এই বৈঠকটি ভার্চুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। কমিটি মিটিংয়ের পর গণমাধ্যমে এর তেমন গুরুত্ব বোধগম্য হয়নি। কোনো যৌথ বিবৃতি, সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে একজন পেশাদার কূটনীতিক দিল্লির এক নিউজ পোর্টালের উদ্ধৃতি দিয়ে দু’একটি ব্যতিক্রমী খবর দিয়েছেন। পোর্টালটির ভাষ্য মোতাবেক বৈঠকে এই প্রথমবারের মতো স্বীকার করা হয় যে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে ‘বিচ্যুতি এবং বিরতি’ রয়েছে। সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং সেটি পুনর্গঠন প্রয়োজন। সেখানে আরো সিদ্ধান্ত হয় যে, সম্পর্ক পুনর্গঠনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সাহায্য করবেন। কিভাবে সাহায্য করবেন তা বিস্তারিত না বলা হলেও বিশ্বাস করা হয় যে, কূটনৈতিক সখ্য, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে জয়শঙ্কর তার বাংলাদেশ প্রতিপক্ষকে বশীভূত করতে পারবেন। খবরটি ব্যতিক্রমী এ কারণে যে, এতদিন ধরে ভারতের কূটনৈতিক মহল এই টানাপড়েনের বিষয়টি স্বীকার করছিলেন না। বিশেষ করে পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা গত আগস্টে বাংলাদেশে আসেন আকস্মিকভাবে, তখনো বলা হচ্ছিল যে এটি স্বাভাবিক সফর। অথচ তিনি এসেছিলেন স্পেশাল বিমানে, স্পেশাল মেসেজ নিয়ে। প্রচলিত কূটনীতির বাইরে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকটি একঘণ্টা স্থায়ী হয়। সে বৈঠকে অন্য কেউ উপস্থিত ছিলেন না। কি বিষয়ে আলাপ আলোচনা হয়েছে তা প্রকাশিত হয়নি। সফরের ধরন-ধারণের কারণেই গুজবের শাখা-প্রশাখা প্রসারিত হয়। বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো এবং দক্ষিণ এশীয় ঘটনাবলি পর্যবেক্ষক শ্রী রাধা দত্তের মতে, ‘সফর নিয়ে কিছুটা স্বচ্ছতা অবশ্যই দরকার ছিল। ঠিক সময়ে জরুরি প্রশ্নের উত্তর মিললে এ ধরনের অহেতুক জল্পনা দানা বাঁধার কোনো অবকাশ থাকে না।’

পররাষ্ট্র সচিবের সফর নিয়ে এই বিতর্কের দায় ভারত ও বাংলাদেশ- কেউই এড়াতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক কূটনীতিক ও বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকারী হাইকমিশনার দেব মুখোপাধ্যায়। সরকারিভাবে সরাসরি না হলেও আসামের সিএএ এবং এনআরসি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতিবাচক মন্তব্য রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিষয়টির সমালোচনা করেছেন। যদিও ভারত সরকার বলছে : এটি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং বাংলাদেশকে কোনোভাবেই বিষয়টি বিব্রত করবে না। কিন্তু বিষয়টি সেভাবে আর থাকেনি।

বিজেপি নেতা অমিত শাহ আসামে অবস্থিত বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে বাংলাদেশ থেকে আগত অনুপ্রবেশকারী বলেছেন এবং তাদের বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপের হুমকি দিয়েছেন। এ ধরনের মন্তব্যে বাংলাদেশের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ। এ ধরনের মন্তব্য অহরহই করছেন ভারতের বিজেপি নেতারা। আর এসব মন্তব্য ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে দেয়াল তৈরি করছে। ভারতবিরোধী মনোভাবের আরেকটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন দেব মুখোপাধ্যায়। ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারত সরকারের ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা ওই দেশের (বাংলাদেশের) এক বিরাট সংখ্যক মানুষের মধ্যে রয়েছে। হতে পারে ১০ বছরের বেশি একটানা শাসন সরকারবিরোধী যে মনোভাবের জন্ম দিচ্ছে, সেটাই ভারতের দিকে ধাবিত হচ্ছে।’ (প্রথম আলো, ২ সেপ্টেম্বর ২০২০)

জেসিসির বৈঠকে ফিরে আসি। যেসব বিষয় সম্পর্কের ক্ষতি করছে সেসব বিষয়ে হয়তো সেখানে আলোচনা হয়নি। অথচ এসব বিষয় যেমন- হিন্দুত্ববাদ, বাবরি মসজিদ, কাঁটাতারের বেড়া, জাতীয় নিবন্ধন আইন (এনআরএ), নাগরিক পুনর্গঠন আইন (এনআরসি) এবং নেতানেত্রীদের বিরূপ মন্তব্য। এসব বিষয় আলোচিত হলে সম্পর্কের অবনতির ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যেত। যা হোক জেসিসিতে দৃশ্যমান বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে। এসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশকে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট দেয়া (নেপাল-ভুটানের জন্য), রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশকে সমর্থন দেয়া এবং ভারতীয় ঋণের মাধ্যমে পরিচালিত প্রকল্পসমূহের পর্যালোচনা। পুরনো বিষয়গুলোও আলোচনায় উঠে এসেছে, যেমন, অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন সমস্যা, সীমান্তে নাগরিক হত্যা, মাদক-চোরাচালান ও ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি। জেসিসিসহ অনেক বৈঠকে যেমন, সীমান্তবাহিনী প্রধানদের বৈঠকে বারবার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনা হবে। তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারেও অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির আশা দেয়া হয়েছে। এছাড়া আরো ছয়টি নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ও আলোচনায় এসেছে। এগুলো হলো- মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধারিয়া এবং দুধকুমার। ভারতীয় পক্ষ যৌথ নদী কমিশনকে সক্রিয় করতেও সম্মতি জানিয়েছে। ব্যবসা ও বিনিয়োগ নিয়েও আলাপ হয়েছে। ভারতীয় পক্ষ গতানুগতিক প্রতিশ্রুতির বাইরে নতুন কিছু বলেছে বলে জানা যায়নি। তবে ‘পরসী পহেলে’ কর্মসূচির আলোকে বাংলাদেশকে করোনাভাইরাস টিকা দিতে চেয়েছে। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশের জন্য টিকা গ্রহণ করলে টিকা প্রদানকারী দেশ ব্যবসায়িকভাবে ব্যাপকভাবে লাভবান হবে- মন্তব্য রাজনৈতিক পর্যবেক্ষদের।

জেসিসি বৈঠকের গতানুগতিক ইতিবাচক খবরের বাইরেও খবর আছে। সমুদ্রপথে অপরাধমূলক কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ, আঞ্চলিক সমুদ্র নিরাপত্তা রক্ষা ও সমুদ্র অর্থনীতির উন্নয়নে বঙ্গোপসাগরে যৌথ মহড়া শুরু করেছে ভারত ও বাংলাদেশের নৌবাহিনী। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভারতের কাছে বাংলাদেশের জোর দাবির কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। যখন দিল্লির কাছে ঢাকার এমনই প্রত্যাশা তখন ভারতের সেনাপ্রধান এবং পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা মিয়ানমান সফর করেছেন। দু’দিনের এ সফরে ভারতের প্রতিনিধি দলটি মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সাং সু চি এবং দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সাথে বৈঠক করেছেন বলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। একে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশ নিজেদের মধ্যে কানেক্টিভিটি, বাণিজ্য, উন্নয়ন প্রকল্প, জ্বালানি সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা, সংস্কৃতি এবং মানুষে মানুষে যোগাযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা শক্তিশালী করেছে।

এ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও সহযোগিতা এগিয়ে নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। করোনা মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশের পর এটাই ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের দ্বিতীয় বিদেশ সফর। ভারতের প্রত্যেক পররাষ্ট্র সচিবই দায়িত্ব নেয়ার পর সাধারণত মিয়ানমার সফর করেন। তবে সেনাপ্রধান ও পররাষ্ট্র সচিবের একত্র হয়ে মিয়ানমার সফরের ঘটনা এই প্রথম। বাংলাদেশ সফরের পরপরই এই সফর অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে উচ্চ পর্যায়ের এ সফর উদ্দেশ্যমূলক বলেই ভাবছেন বিশ্লেষকরা। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এ সফর মিয়ানমারের সঙ্গে দেশটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধের জেরে মিয়ানমারের গুরুত্ব ভারতের কাছে বেড়ে গেছে। এছাড়া ভারত বাংলাদেশকে দিয়ে মিয়ানমারকে এবং মিয়ানমারকে দিয়ে বাংলাদেশকে ব্যালেন্স করতে চায়। মূলত ভারত এক্ষেত্রে কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারে ভারতের যে পরিমাণ বিনিয়োগ ও অংশীদারিত্ব রয়েছে সেখানে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ও সেনাপ্রধানের সফর অস্বাভাবিক নয়।

ভারত-মিয়ানমার সম্পর্ক উত্তরোত্তর ঘনিষ্ঠতর হচ্ছে। বর্তমানে দেশটিতে ভারতের ৮০ কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। দু’দেশের মধ্যে জ্বালানি সহযোগিতা নিয়ে ১২০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ আলোচনা চলছে। প্রায় ২০ লাখ ভারতীয় মিয়ানমারে বাস করছে। উল্লেখ্য যে, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা যখন বিতাড়িত হচ্ছিল তখনো ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সফর করেছেন। সুতরাং এটা দৃশ্যমান যে ভারত মিয়ানমারে সার্বিক স্বার্থ দেখছে। বাংলাদেশ সেখানে একান্তই গৌণ হয়ে পড়েছে। সুতরাং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভারতের সহযোগিতার আশা কেবল দুরাশাই সৃষ্টি করবে।

বাংলাদেশের জন্য আরো অস্বস্তির খবর রয়েছে। বাংলাদেশের নিকটবর্তী বন্ধু ভারত। একটু দূরের প্রতিবেশী চীন। অনেক দূরের কিন্তু নির্ভরশীলতায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কাছে দূরের এই সমীকরণে বাংলাদেশের ত্রিশঙ্কু অবস্থা হয় কিনা প্রশ্ন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের। যুক্তরাষ্ট্রের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরা স্টোন গত মাসের ১৫ তারিখে এক ভিডিও সংযোগে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার রূপকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ চেয়েছেন। কয়েক দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মোকাবেলা ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় রূপকল্পে তিনিও বাংলাদেশের সহযোগিতা চেয়েছেন। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রূপকল্পের মূলে রয়েছে এই অঞ্চলে চীনকে তার প্রভাব বলয় থেকে দূরে রাখা।

গোটা বিশ্বব্যাপী চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশের জন্য তা বিব্রতকর। চীন যেভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও নিরাপত্তায় জড়িয়ে গেছে তাতে বাংলাদেশের আশঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় রূপকল্পে ভারতের একটি বিশেষ অবস্থান রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হচ্ছে ভারতকে দিয়ে চীনকে ঠেকানো। সবারই জানা কথা, চীন-ভারত শত্রুতা অনেক পুরনো। অতি সাম্প্রতিক সময়ে চীন-ভারত উত্তেজনা বেড়েছে। চীনের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রকল্প- বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-বিআরআইকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা ধরনের ফন্দিফিকির আঁটছে। চীনকে ঠেকানোর লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আসিয়ান জোটভুক্ত দেশগুলোর সাথে সামরিক সহযোগিতা অনেক বৃদ্ধি করেছে। এটি এখন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক অগ্রাধিকারের বিষয়। বাংলাদেশ যদিও সবার সাথে সখ্য এবং সহযোগিতার নীতি অনুসরণ করছে তবুও যখন সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে- তা বাংলাদশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে বাধ্য। একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক প্রশ্ন তুলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্বে কার পক্ষ নেবে বাংলাদেশ? বিষয়টি গুরুতর এবং জাতীয় নেতৃত্বের জন্য কঠিনতর পরীক্ষা।

সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বিব্রতকর অবস্থান পাকিস্তান প্রশ্নে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জুলাইয়ের শেষ দিকে ফোন করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ওই মাসের শুরুতেই ঢাকায় পাকিস্তানের নতুন হাইকমিশনার ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। দুই দেশের সম্পর্ক অনেক বছর ধরেই শীতল যাচ্ছে। তাই হুট করে পাকিস্তানের উদ্যোগে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে সীমান্ত নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীন ও নেপালের বিরোধের সংবাদের আলোকে বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের এমন যোগাযোগ সন্দিহান করে তুলেছে অনেককে। চীনের প্রভাবে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নতি কিনা এই প্রশ্ন তুলেছে কোনো কোনো মহল। ২০০৯ সালে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সম্পর্ক শীতল হতে থাকে। পরে একাত্তরের মাবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে ঘিরে দুই দেশের সম্পর্কের গুরুতর অবনতি ঘটে।

কয়েক বছর বিরতির পর পাকিস্তানের এই উদ্যোগকে নেতিবাচকভাবে দেখছে ভারত। এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বলেন, ‘দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আমরা সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই, শত্রুতা নয়। আর কূটনীতিতে চিরদিনের বন্ধু আর চির জীবনের শত্রু বলে কিছু নেই। কোনো দেশ ও কিংবা তার জনগণের এমন কিছু করা ঠিক নয় যাতে দুই দেশের সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টি হয়।’ প্রধানমন্ত্রী অবশেষে মন্তব্য করেছিলেন, ‘দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক চলবে ঝগড়াঝাটিও চলবে।’ কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, জানুয়ারিতে ঢাকায় আসার পর থেকেই পাকিস্তানের নতুন হাইকমিশনার বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে কাজ করছেন। ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণও বাংলাদেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।

পর্যালোচনান্তে আমরা দেখতে পেলাম, বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে পররাষ্ট্রনীতি ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক সমস্যায় আক্রান্ত। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিচ্যুতি এবং বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক উভয় সঙ্কটে রয়েছে। বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ক চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে সংবেদনশীল হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক। বাংলাদেশের অস্বস্তি, জনগণের ক্ষোভ এবং চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে দেশে, ভারতে এবং বিদেশে নানা বিতর্ক চলছে। লন্ডনের দ্য ইকোনমিস্ট ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে মন্তব্য করেছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ বিজেপি সরকারের মুসলিমবিরোধী এবং বাংলাদেশবিরোধী মনোভাবের কারণে দিল্লি থেকে বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকছে।

এ মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, কংগ্রেস বহু চেষ্টার বিনিময়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করেছে নরেন্দ্র মোদির নীতির কারণে তা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। এটা জাতির জন্য বিপজ্জনক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মন্তব্য করছেন যে, বিজেপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হিন্দুত্বের জিকির প্রতিবেশী দেশগুলোকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন করছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে এরা এতই ব্যস্ত যে, প্রতিবেশী দেশগুলোর বিষয়ে তারা যথাযথ খবর রাখছে না। যখন তারা জেনেছে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণে চীন অর্থায়নে রাজি হয়েছে তখনই কেবল ভারত সচিব ঢাকা ছুটে এসেছেন। ভারতীয় প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ ‘সোনালি অধ্যায়’, ‘অতি উচ্চতায়’ এমনকি রক্তের সম্পর্কের মতো অকূটনীতিসুলভ মন্তব্য করলেও আশ্বস্ত হচ্ছে না ভারত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জনমত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অনুকূলে নয়। যখন রক্তের সম্পর্কের কথা বলা হয় তখন তার উত্তরে জনগণ থেকে উত্তর আসে দূষিত রক্তের। যখন সম্পর্কের অতি উষ্ণতার কথা বলা হয় গণমাধ্যমে মন্তব্য আসে, অতি উষ্ণতায় কি হয়? একপর্যায়ে উবে যায়।

ভারতের বিভিন্নমুখী চাপ অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশের জাতীয় নেতৃত্ব কতটা ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবেন তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে চীন সফরের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমদূরত্ব এবং সবার মিত্রতা কারো শত্রুতা নয়- এ নীতির পুনরুল্লেখ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রনীতি বিশারদরা মনে করিয়ে দেন যে, জাতীয় শক্তি পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে নিয়ামক। জাতীয় শক্তির প্রধান উৎস জনগণ। জাতীয় নেতৃত্ব যদি জনগণের শক্তিতে শক্তিমান হয় তাহলে সে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ‘সরকার ও জনসাধারণের মধ্যে সহযোগিতা জাতীয় শক্তির একটি অন্যতম ভিত্তি। সরকারের বৈদেশিক নীতি এবং অভ্যন্তরীণ নীতি যাতে জনসমর্থন লাভ করে সেই দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রত্যেক সরকারের অবশ্য কর্তব্য।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Mal55ju@yahoo.com

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us