হজরত আয়েশার বিয়ে ও বয়স : একটি বিশ্লেষণ

আদিল সালাহি * অনুবাদ আবু জাফর | Nov 08, 2020 05:36 pm
হজরত আয়েশার বিয়ে ও বয়স : একটি বিশ্লেষণ

হজরত আয়েশার বিয়ে ও বয়স : একটি বিশ্লেষণ - ছবি সংগৃহীত

 

রাসূল সা:-এর সাথে বিয়ে হওয়ার সময় হজরত আয়েশা রা: ও তাঁর বয়স সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়েছে। এখানে আমরা বিভিন্ন প্রামাণিক বর্ণনা, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আয়েশার দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিভিন্ন ঘটনায় তাঁর প্রতিক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে সত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করব।

১. প্রথমেই আমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে, রাসূল সা: যখন আল্লাহর বাণী পান এবং তা প্রচার করতে শুরু করেন তখন আরবের অধিকাংশ লোক নিরক্ষর ছিল। রাসূল সা: নিজেও লিখতে বা পড়তে পারতেন না। তাছাড়া, আরবদের কোনো স্বীকৃত বর্ষপঞ্জি ছিল না। তারা বিভিন্ন বিষয়ের তারিখ নির্ণয় করত তাদের জীবনের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী বড় ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ফলে, বড় কোনো ঘটনা ঘটার পর তাদের নির্ণয় করা তারিখেরও পরিবর্তন হয়ে যেত। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, রাসূল সা: হস্তির বছরে জন্মগ্রহণ করেন বলে বলা হয়। এই হস্তির বছরটা হলো ওই সময় যখন ইয়েমেনের শাসনকর্তা আবরাহা কাবাগৃহ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে একটা বিরাট বাহিনী নিয়ে আসে- ওই বাহিনীর পুরোভাগে ছিল একটা হাতি।

আরবদের জন্ম ও মৃত্যুর কোনো নিবন্ধন ছিল না। সুতরাং, ওই সময় কোনো লোকের বয়স উল্লেখ করার সময় তা প্রায় সঠিক বলে গ্রহণ করা হতো। একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। রাসূলের সময়ে অনেকে প্রধান ছিলেন, যেমন রাসূলের দাদা আবদ আল-মুত্তালিব এবং দু’জন প্রসিদ্ধ কবি হাসান ইবন ছাবিত ও আল-নাবিঘা আল-জুয়াদি। তারা ১২০ বছর জীবিত ছিলেন বলে বলা হয়। তাদের কেউ ১১৫ বছর বা ১২৫ বছর জীবিত ছিলেন বলে বলা হয় না, বরং তারা সবাই ১২০ বছর করে জীবিত ছিলেন বলে সরলীকরণ করে বলা হয়। আবার, একই ব্যক্তির বয়স বিভিন্ন রকম বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

রাসূলের প্রথম স্ত্রী খাদিজা যখন রাসূল সা:কে বিয়ে করেন তখন তাঁর বয়স ৪০ বছর ছিল বলে প্রায় ক্ষেত্রেই বলা হয়। তবু তিনি ছয় সন্তানের জন্ম দেন। এতে ধরে নেয়া যায় যে, ওই সময় তিনি সন্তান জন্ম দেয়ার উৎকৃষ্ট সময়ে ছিলেন। ৪০ বছরের একজন মহিলা এক বা দুটি সন্তান জন্ম দিতে পারে, কিন্তু দশ বছরের বেশি সময়ে ছয়টি সন্তান জন্ম দেয়া একেবারে অসম্ভব। অন্যান্য একাধিক বর্ণনায় দেখা যায় যে, বিয়ের সময় তাঁর বয়স ছিল পঁয়তাল্লিশ, পঁয়ত্রিশ, ত্রিশ, আঠাশ এবং এমনকি পঁচিশ বছর। একই পুস্তকে এমন ভিন্ন ভিন্ন বয়সের কথা উল্লেখ থেকে আমরা ধারণা করতে পারি যে, উল্লেখিত সংখ্যার কোনোটিই চূড়ান্তভাবে বিশ্বস্ত নয়। তাছাড়া, প্রাথমিক যুগের আরব ও মুসলিম ঐতিহাসিকগণ সময়কালের চেয়ে অতি বেশি গুরুত্ব দিতেন ঘটনার ওপর। তারা প্রায়ই সময়কাল উল্লেখ না করে ঘটনা বর্ণনা করতেন। এর ফলে তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি এবং সময়ের বিষয়টি অস্পষ্ট হয়ে যায়।

এ অবস্থায় মানুষের বয়সের বিষয়টি সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। সাধারণ মত হলো এই যে, রাসূল সা: যখন আয়েশাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন তখন তাঁর বয়স ছিল ছ’বছর এবং তাঁর নয় বছর বয়সের সময় সত্যিকার বিয়ে সম্পন্ন হয়। আমরা মনে করি যে, এটা সঠিক নয়। রাসূল সা:-এর সাথে আয়েশার বিয়ের সময়ের বয়স নির্ধারণ করার প্রচেষ্টায় আমাদের প্রথমেই এটা বিবেচনা করা প্রয়োজন যে, বিয়ের আগে জুবায়র ইবন মুতইমের সাথে তার বাগদান হয়। তাঁর পিতা আবু বকরকে যখন বলা হয় যে, রাসূল তাঁকে (আয়েশাকে) বিয়ে করতে চান তখন তিনি বলেন : ‘মুতইম পরিবার ইতোমধ্যে তাদের পুত্রের জন্য তাঁর (আয়েশার) কথা বলেছে। আমি কৌশলে তা থেকে তাঁকে (আয়েশাকে) বের করে আনব।’ এ থেকে জানা যায় যে, ওই বাগদান ছিল অনমনীয়, কারণ তা বাতিল করার জন্য আয়েশার পিতাকে কৌশল অবলম্বনের প্রয়োজন ছিল। দুটো পরিবারের মধ্যে এটা শুধু সাধারণ আলোচনার বিষয় ছিল না।

এখন দেখা যাক, আয়েশাকে বিয়ে করার ধারণা রাসূলের কিভাবে হলো। রাসূল সা: খাদিজাকে বিয়ে করেন মধ্য-কুড়ি বছর বয়স বা তার আগে। তাঁরা একসাথে পঁচিশ বছর সুখে জীবনযাপন করেন। তাঁদের দুটি পুত্রসন্তান এবং চারটি কন্যাসন্তান হয়। শিশু বয়সেই ওই দুই পুত্রসন্তানের মৃত্যু হয়। রাসূলের মিশন শুরু হওয়ার সময় তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা জয়নাবের বিয়ে হয় আবু আল-আস ইবন আল-রাবির সাথে। তাঁর দ্বিতীয় কন্যা রুকাইয়া এবং তৃতীয় কন্যা উম্মে কুলসুমের বাগদান হয় উতবা ও উতাইবার সাথে- উতবা ও উতাইবা হলেন রাসূলের চাচা আবু লাহাবের দুই পুত্র। ওই বাগদান ভেঙে ফেলার জন্য আবু লাহাব তার দুই পুত্রকে নির্দেশ দেন এবং তারা তা-ই করে।

অতঃপর রুকাইয়াকে বিয়ে দেয়া হয় উসমান ইবন আফফানের সাথে। ইসলাম প্রচার শুরু হওয়ার পঞ্চম বছরে রাসূলের উপদেশ অনুযায়ী প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু মুসলিম আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। এদের মধ্যে উসমান ও রুকাইয়া ছিলেন। পাঁচ বছর পর, অর্থাৎ ইসলামী প্রত্যাদেশ শুরু হওয়ার দশম বছরে এবং মদিনায় মুসলিমদের হিজরতের তিন বছর আগে খাদিজা রা: মারা যান। তার মৃত্যুর পর প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিম হওয়া একজন মহিলা খাওলা বিনতে হাকিম উপলব্ধি করেন যে, খাদিজার মৃত্যু রাসূলের জন্য একটা বিরাট ক্ষতি। এর ফলে তার জীবনে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তিনি (খাদিজা) এমন একজন মহিলা ছিলেন যিনি রাসূলের জন্য একটা সুখী ও আরামদায়ক গৃহ নিশ্চিত করেন, যেখানে তিনি মক্কার অধিকাংশ লোকের তাঁর প্রতি তাদের দৃঢ় বৈরিতার কথা ভুলতে পারেন।

খাদিজা ছিলেন মহানবী সা:-এর প্রধান সহায়ক এবং তিনি তাঁকে সান্ত¡না ও উৎসাহ দেন। যা হোক, খাওলা রাসূলের কাছে যান এই প্রস্তাব নিয়ে যে তার একজন নতুন স্ত্রী প্রয়োজন। তিনি আগ্রহ দেখালে খাওলা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন : ‘আপনি কী একজন পরিণত মহিলা অথবা একজন কুমারী মেয়েকে পছন্দ করেন?’ খাওলার মনে কী আছে তা রাসূল সা: তাকে জিজ্ঞাসা করেন। খাওলা বলেন : ‘পরিণত মহিলা হলেন সওদা বিনতে জিম’য়া এবং কুমারী মেয়ে হলেন আপনার বন্ধুর কন্যা আয়েশা।’ রাসূল তাঁকে উভয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিতে বলেন। এর পরপরই রাসূল সা: সওদাকে বিয়ে করেন এবং তিন বছর পর অর্থাৎ মদিনায় হিজরত করার পর তিনি আয়েশাকে বিয়ে করেন।

খাওলা যখন আবু বকরের রা: কাছে ওই প্রস্তাব নিয়ে যান তখন তিনি স্পষ্ট করে বলেন যে, জুবায়র ইবন মুত’ইমের সাথে আয়েশার বাগদান তিনি ছিন্ন করবেন। এটা উল্লেখ করার বিষয় যে, রাসূল সা: বা আবু বকর রা: ও পরিবারের কেউ বলেননি যে আয়েশা বিয়ের জন্য কমবয়সী (অর্থাৎ তার বিয়ের বয়স হয়নি)। অথচ রাসূল সা: দু’বার এ ধরনের মন্তব্য করেন, যখন তাঁর দু’জন সাহাবি তার কনিষ্ঠা কন্যা ফাতেমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব করেন। এখন প্রশ্ন হলো : স্ত্রী মারা যাওয়ার পর রাসূলের ওপর এর ফলাফল অনুধাবন করে দূরদর্শী মুসলিম মহিলা খাওলা কী ছয় বছর বয়স্কা একজন শিশুকে বিয়ে করার জন্য তার কাছে প্রস্তাব করেছেন যিনি তার চার কন্যার মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠা কন্যার চেয়েও বয়সে কয়েক বছরের ছোট? এ ধরনের একজন শিশু কিভাবে খাদিজার ক্ষতিপূরণ করতে পারেন? এটাই কী অধিক বিশ্বাসযোগ্য নয় যে, তিনি যদি রাসূলের সা: গৃহে আসেন তাহলে তিনি রাসূলের ওপর অতিরিক্ত বোঝা হবেন? তবু খাওলা কল্পনা করেননি যে, রাসূল আয়েশাকে পছন্দ করলে বিয়ে বিলম্বিত করা হবে। তিনি এমন কিছু প্রস্তাব করেছিলেন যা বিলম্ব ছাড়াই কার্যকর হবে, যেমন ঘটেছিল সওদার ক্ষেত্রে।

তাছাড়া, যখন তিনি প্রস্তাব করেছিলেন তখন তার কোনো ধারণা ছিল না যে রাসূল সা: উভয় মহিলাকে বিয়ে করার জন্য পছন্দ করবেন। খাওলা এমন এক প্রস্তাব নিয়ে আসেন যা কোনো চিন্তাশীল ও পরিপক্ব মহিলা করতে পারেন, অর্থাৎ রাসূল এমন কাউকে বিয়ে করবেন যিনি তাঁকে এমন সান্ত¡না দিতে পারেন যা খাদিজা দিতেন। তাঁর সংক্ষিপ্ত তালিকায় দু’জনের নাম ছিল- তাদের মধ্য থেকে যেকোনো একজনকে পছন্দ করা যেতে পারে। এটা যদি সত্য হয় যে, আয়েশার বয়স তখন ছয় বছর ছিল, তাহলে ওই সময় ও প্রেক্ষাপটে তার নাম উল্লেখ একেবারে অস্বাভাবিক ছিল। ছয় বছরের একজন মেয়ের প্রয়োজন তার প্রতি যত্ন নেয়ার- ইতিহাসে অত্যন্ত কষ্টকর কাজে নিয়োজিত একজন লোকের যত্ন নেয়ার জন্য দায়িত্ব গ্রহণ নয়। এ কথা সবসময় স্মরণ রাখতে হবে যে, ওই সময় আয়েশার বয়স যদি ছয় বছর হতো তাহলে তিনি রাসূলের সব কন্যার মধ্যে কনিষ্ঠা কন্যার চেয়েও বয়সে কনিষ্ঠা হতেন- রাসূলের সা: সব কন্যার মধ্যে তখনো দুই কন্যা তাঁর সাথে বসবাস করতেন।

আয়েশার বয়সের আরেকটা যোগসূত্র হলো তাঁর ইসলাম গ্রহণের সময়কাল। রাসূলের বিস্তারিত জীবনীগ্রন্থে ইবন ইসহাক ‘প্রাথমিক দিনগুলিতে যেসব লোক আল্লাহর বাণীবাহকের বাণী গ্রহণ করেন’ শিরোনামে একান্নজনের নাম উল্লেখ করেন। এ তালিকায় কোনো শিশুর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আলী যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তাঁর বয়স ছিল দশ অথবা বারো। তাঁর নাম ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ওই তালিকায় যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাঁদের মধ্যে বহুসংখ্যক ছিলেন রাসূলের সাহাবি এবং তারা ইসলামের বাণী প্রচার শুরু হওয়ার পঞ্চম বছরে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। ওই সময় হিজরতকারীর সংখ্যা ছিল ১০১ জন, আর সব মুসলিমের সংখ্যা ছিল ২০০ জনের মতো। সুতরাং ধরে নেয়া যায় যে, তালিকায় যেসব লোকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় তারা ইসলাম প্রচারের পঞ্চম বছরের আগেই ইসলাম গ্রহণ করেন। ওই তালিকার আঠারো এবং উনিশ ক্রমিক নম্বরে উল্লেখিত নাম হলো ‘আসমা বিনতে আবু বকর এবং তাঁর বোন আয়েশা, যিনি ওই সময় কমবয়সী ছিলেন’ (ওই মন্তব্য হলো ইবন ইসহাকের)।

তালিকায় নামের অন্তর্ভুক্তির ক্রমধারার গুরুত্ব আমরা উপেক্ষা করতে পারি, কিন্তু এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, আয়েশা হলেন একমাত্র কমবয়সী ব্যক্তিত্ব যার নাম ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিয়ের সময় যদি
তাঁর বয়স ৯ বছর হয়ে থাকে তাহলে আমরা যে সময়ের কথা আলোচনা করছি সেই সময়ে তাঁর বয়স হতো এক বছর। আমাদের মন্তব্য করার কোনো প্রয়োজন নেই। যা হোক, অনেক সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে যে আয়েশা ইসলাম গ্রহণ করেন ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক পর্যায়ে। আমরা যদি ধরে নেই যে, ইসলাম গ্রহণের সময় তাঁর বয়স ছিল দশ বছর এবং ইসলাম প্রচারের পঞ্চম বছরেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, তাহলে বিয়ের সময় তাঁর বয়স হয় উনিশ বছর। তবু ইবন ইসহাক হয়তো বারো বছর বয়সের আয়েশার ইসলাম গ্রহণের কথা বলেন তার পিতামাতার ইসলাম গ্রহণের পরপরই। এ ক্ষেত্রে বিয়ের সময় তাঁর বয়স হয় কুড়ি বছরের চেয়ে কয়েক বছর বেশি। এটা যদি সত্য হয় যে, বিয়ের সময় আয়েশার বয়স ছিল নয় বছর তাহলে রাসূলের মদিনায় হিজরতের সময় তাঁর বয়স ছিল আট বছর। রাসূল যখন মদিনায় হিজরত করেন তখন তার পিতা আবু বকর রাসূলের সা: সাথে ছিলেন।


আয়েশার এ বর্ণনাটিও বিবেচনা করা যেতে পারে : ‘আল্লাহর বাণীবাহক আবুবকরের গৃহে আসতেন দিনের শেষে, সকালে অথবা সন্ধ্যার সময় এবং এটাই তার অভ্যাস ছিল। যা হোক, যেদিন তিনি মক্কা ও তাঁর জনগণকে ছেড়ে হিজরত করার জন্য আল্লাহর অনুমতি পান সে দিন তিনি আমাদের কাছে আসেন দুপুরের দিকে। এটি তাঁর জন্য খুবই অস্বাভাবিক ছিল। তাঁকে দেখে আবুবকর বলেন, ‘নিশ্চয়ই গুরুতর কিছু ঘটেছে যে জন্য আল্লাহর বাণীবাহক এ সময় এসেছেন। রাসূল সা: কামরার মধ্যে এলে আবু বকর নিজের স্থান তাঁর জন্য ছেড়ে দেন এবং রাসূল সা: সেখানে বসেন। আমি ও আমার বোন আসমা ছাড়া সেখানে আর কেউ ছিল না।
কিন্তু রাসূল সা: আবু বকরকে বলেন, এখানে যারা আছে তাদের সবাইকে বাইরে যেতে বলুন। আবু বকর বলেন, ‘আল্লাহর বাণীবাহক, এরা আমার দুই কন্যা। ঘটনাটা কী? রাসূল সা: বলেন, আল্লাহ আমাকে হিজরত করার নির্দেশ দিয়েছেন। আবু বকর বলেন, এই যাত্রায় আমি কি আপনার সঙ্গী হবো? রাসূল সা: বলেন - ‘হ্যাঁ, আমরা একসাথে যাবো। আল্লাহর শপথ, ওই দিনের আগে অর্থাৎ আবু বকরকে কাঁদতে না দেখা পর্যন্ত আমি কখনো উপলব্ধি করিনি যে, আনন্দে কেউ কাঁদতে পারে। তখন তিনি বলেন, রাসূল সা:! এখানে আমার দুটো চড়ার উট আছে এবং এ উদ্দেশ্যে আমি তা প্রস্তুত করে রেখেছি...। রাসূল সা:-এর মদিনায় হিজরত করার কিছু আগে আয়েশা রা: যা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তা-ই তিনি এখানে বলেন।

মদিনায় বসতি স্থাপনের এক বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় পর রাসূল সা:-এর সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের সময় তার বয়স যদি ৯ বছর হয় তাহলে যখন এই আলোচনা ও তার মনোভাব প্রকাশ পায় তখন তার বয়স ছিল ৮ বছর বা তার চেয়ে কম। সাত বা আট বছরের একজন শিশু কি তার পিতার আনন্দের বা দুঃখের কান্নার পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেন? এ ধরনের শিশুর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হয় তার পিতার মতো- সে উত্তেজিত হয় অথবা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তবু আয়েশা রা: নিশ্চিত ছিলেন, তার পিতা আনন্দে কাঁদছেন।
তাছাড়া, মক্কা থেকে চলে যাওয়ার বিষয়টি রাসূল সা: গোপন রাখতে আগ্রহী ছিলেন। লোকেরা যখন কোনো কিছু পরিকল্পনা করে এবং তা গোপন রাখতে চায় তখন তারা তা তাদের শিশু সন্তানদের জানতে দেয় না এই আশঙ্কায় যে, ওই গোপন বিষয় অন্যদের জানানোর বিপদ শিশুরা উপলব্ধি করতে পারেন না। বস্তুত, কুরাইশরা যখন জানতে পারে যে রাসূল সা: ও আবু বকর রা: চলে গেছেন তখন আবু বকরের গৃহে আসে আবু জেহেল। সে আবু বকর রা:-এর মেয়ে আসমাকে তার পিতা কোথায় গেছে তা জিজ্ঞেস করে। আসমা যখন বলেন, তার পিতা কোথায় গেছেন তা তিনি জানেন না, তখন আবু জেহেল তার মুখে চড় মারে। আয়েশা রা:-এর বয়স তখন আট বছর হলে রাসূল সা: ও তার (আয়েশার) পিতা তাকে সেখানে থাকতে দিতেন না এবং তারা চলে যাচ্ছেন এ কথাও জানতে দিতেন না।

অন্য একটি ঘটনায় আয়েশা রা:-এর মনোভাবের দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। ওই ঘটনায় তার মর্যাদা সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ওই ঘটনাটি হলো- আয়েশা রা: সম্পর্কে ভণ্ডরা একটি মিথ্যা গুজব ছড়ায়। ওই গুজবে বলা হয়, সাফওয়ান ইবন আল-মুয়াত্তাল নামে রাসূল সা:-এর একজন যুবক সাহাবির সাথে আয়েশা রা:-এর সম্পর্ক ছিল। একমাস ধরে ওই গুজব প্রচারিত হতে থাকে, কিন্তু ওই বিষয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য রাসূল সা: কিছু করতে পারেননি। ওই মাসের অধিকাংশ সময় আয়েশা রা: অসুস্থ ছিলেন এবং শুশ্রূষার জন্য তাকে তার পিতা-মাতার বাড়িতে পাঠানো হয়। রাসূল সা: তাকে দেখতে যান এবং বলেন, কোনো ভুল করে থাকলে তিনি যেন অনুতপ্ত হন। আয়েশা রা: তার পিতা-মাতাকে রাসূল সা:-এর সাথে কথা বলতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তারা বলেন, তারা কোনো বিষয়ে রাসূল সা:কে কিছু বলবেন না। আয়েশা রা: আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিছু বলতে অনিচ্ছুক ছিলেন এবং এ জন্য তিনি সবকিছু উপেক্ষা করেন। তিনি নিজের নির্দোষিতা সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত ছিলেন এবং আশা করেন, আল্লাহ তা সবার কাছে স্পষ্ট করে দেবেন। ওই মুহূর্তে রাসূল সা: কুরআনের প্রত্যাদেশ পান এবং ওই প্রত্যাদেশে আয়েশা রা: নির্দোষিতা সমর্থন করা হয়। বিশেষ এই পরিস্থিতিতে আয়েশার মনোভাবকে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। ওই ঘটনা ঘটে রাসূল সা:-এর মদিনায় হিজরতের পঞ্চম বছরে, অর্থাৎ আয়েশা রা:-এর সাথে তাঁর বিয়ের তিন অথবা চার বছর পরে। বিয়ের সময় তার বয়স যদি সত্যি ৯ বছর হয়ে থাকে তাহলে এসব ঘটনা ঘটার সময় তার বয়স হয়েছিল ১২ অথবা ১৩ বছর। বিষয়টি বিস্তারিতভাবে দেখা যাক। গুজবের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন একজন স্ত্রী- তাকে অভিযুক্ত করা হয় ব্যভিচারের। তার পক্ষে তার পিতা-মাতা একটি কথাও বলেননি। তার স্বামী হলেন আল্লাহর বাণীবাহক। তিনি এসে তাকে বলেন, তিনি যদি এমন কিছু করে থাকেন তাহলে তার অনুতপ্ত হওয়া এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। এসব চাপের মুখে ১৩ বছরের একটি মেয়ে কী মনে করতে পারে? তবু আয়েশা রা: সবকিছু উপেক্ষা করেন, নিজের নির্দোষিতায় দৃঢ় থাকেন।

অতঃপর আসমানি প্রত্যাদেশে তার নির্দোষিতা ঘোষিত হওয়ায় সবাই স্বস্তি পান। রাসূল সা: এ কথা তাকে বলেন। আয়েশা রা:-এর মা তাকে বলেন, ‘তার কাছে যাও’। এমন মনোভাব একজন মায়ের যখন নিজের কন্যা সম্পর্কে সব সন্দেহ দূরীভূত হয় এবং তার বিয়ে নিরাপদ থাকে। আয়েশা রা: তা উপেক্ষা করে বলেন, ‘না! আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি তার কাছে যাবো না। আমার নির্দোষিতা ঘোষণা করার জন্য আমি শুধু আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাব।’ এখানে আমরা একজন পরিপক্ব মহিলাকে দেখতে পাই যিনি তার স্বামীর সাথে বোঝাপড়া করছেন। আল্লাহর বাণীবাহক হিসেবে রাসূল সা: নয়, তিনি তাকে দেখেছেন তার স্বামী হিসেবে। তার কথায় দৃঢ় প্রতিবাদের ইঙ্গিত ছিল।

তিনি যেন বলছেন, ‘আমি দোষী এ কথা আপনি কিভাবে ভাবতে পারেন? আমার ওপর আপনার কি যথেষ্ট আস্থা নেই? আমার বিশ্বস্ততা নিয়ে অন্য লোকের কাছে আপনি কিভাবে জিজ্ঞেস করতে পারেন?’ এটা নিশ্চিতভাবে ১৩ বছরের একটি মেয়ের দৃষ্টিভঙ্গি নয়। এটা একজন পরিপক্ব মহিলার, কমপক্ষে ২০ বছরের বেশি বয়সের মহিলার দৃষ্টিভঙ্গি, যিনি তার স্বামীর কথার প্রতিবাদ করেছেন এবং নিজের সততা ও বিশ্বস্ততার ওপর জোর দিয়েছেন।

ইসলামের ইতিহাসে উহুদের যুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ওই যুদ্ধে মুসলিমরা গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব জ্ঞান লাভ করে। এ থেকে রাসূল সা:-এর সাহাবিরা এবং ভবিষ্যতের সব মুসলিম সম্প্রদায় শিক্ষালাভ করে যে, শুধু মুসলিম বলে ঘোষণা করলেই আল্লাহ তাদের বিজয় দান করেন না। আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার আগে তাদেরকে ভালো মুসলিম হিসেবে সব দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে। উহুদ যুদ্ধে মুসলিমরা প্রথম অবিশ্বাসীদের কাছে পরাজিত হয়। যুদ্ধের আগে রাসূল সা: তার সৈন্যবাহিনীকে পরিদর্শন করেন। তিনি সৈন্যদের মধ্যে কয়েকজন যুবককে দেখতে পান। ১৫ বছরের কম বয়সের সবাইকে তিনি মদিনায় ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

এক বা দুইজনের বয়স ছিল ১৪, তবু রাসূল সা: তাদেরকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। পরবর্তী বছরে তারা মুসলিম বাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে- ওই সময় অবিশ্বাসী ও ইহুদিদের মিত্রবাহিনী ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াসে মদিনা আক্রমণের চেষ্টা করে। রাসূল সা: যখন সামরিক অভিযানে যান তখন সৈন্যবাহিনীর সাথে বেশ কয়েকজন মহিলা যাত্রা করেন। তারা সহায়ক সেবাদান করেন, যেমন- আহতদের শুশ্রূষা ও সাহায্য করা। উহুদ যুদ্ধে তাদের কেউ কেউ মুসলিমদের সাথে সত্যিকারের যুদ্ধ করেন। অবিশ্বাসীরা যখন রাসূল সা:কে হত্যা করার প্রয়াস চালায় তখন তা প্রতিহত করতে নাসিবা বিনতে কাবের বীরত্বপূর্ণ কাজ সম্পর্কে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়।

মদিনায় রাসূল সা:-এর বসতি স্থাপনের তৃতীয় বছরের শাওয়াল মাসে উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়, অর্থাৎ ওই সময়টা ছিল আয়েশা রা:-এর বিয়ের দুই বা তিন বছর পর। বিভিন্ন শিরোনামে আল-বুখারি নিম্নলিখিত যে হাদিসটি বর্ণনা করেন তা বিবেচনা করা যেতে পারে : আনাস বর্ণনা করেন- ‘উহুদ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী যখন পশ্চাৎপসরণ করে এবং লোকেরা যখন রাসূল সা:-এর কাছ থেকে দূরে সরে যায় তখন আমি আয়েশা ও উম্মে সুলায়মকে দেখতে পাই তাদের পোশাকের নিচের অংশ (অর্থাৎ পোশাকের যে অংশ কোমরের নিচে ঝুলে থাকে) উঠানো অবস্থায় এবং আমি তাদের পায়ের নিচের অংশ দেখতে পাই। তারা তাদের পিঠে করে পানিভর্তি মশক (চামড়ার তৈরি পানির পাত্র) বহন করছিলেন এবং লোকদের পানি খাওয়ানোর জন্য প্রায় দৌড়াচ্ছিলেন পানি দিয়ে তাদের পাত্র আবার পূর্ণ করার আগে এবং মানুষের মুখে তা ঢেলে দেয়ার জন্য ফিরে আসার সময়’ (আল-বুখারি এবং মুসলিম বর্ণিত)। বিয়ের সময় আয়েশা রা:-এর বয়স যদি ৯ বছর হয় তাহলে ওই যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার সময় তার বয়স হয় ১১ বছর বা তার চেয়েও কম। সৈন্যবাহিনীতে অবস্থানের জন্য রাসূল সা: যখন ১৪ বছরের যুবক ছেলেদেরও অনুমতি দেননি তখন সেখানে অবস্থানের জন্য ১১ বছরের একটি মেয়েকে তিনি অনুমতি দেবেন, এটা কি আমরা কল্পনা করতে পারি?

আরেকটা বিষয় হলো, আয়েশা রা:-এর জ্ঞান তার বয়সের নির্দেশনা দেয়। তিনি তার গভীর জ্ঞান ও দৃঢ় মতামত প্রকাশের জন্য সুবিদিত ছিলেন। রাসূল সা:-এর জ্ঞানী সাহাবির মধ্যে কারো কারো সাথে তার মতানৈক্য প্রকাশে কখনো তিনি দ্বিধা করতেন না। বদর আল-দ্বীন আল-জারকাশি একটি গ্রন্থ রচনা করেন। ওই গ্রন্থে তিনি রাসূল সা:-এর অন্যান্য সাহাবি কোনো কোনো বিষয়ে যে মত বা সিদ্ধান্ত দেন সেসব বিষয়ে আয়েশা রা:-এর বিতর্কের ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। ওই গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেন- ‘এ গ্রন্থে আমি সেসব বিষয়ে আয়েশা রা:-এর (আল্লাহ তার ওপর সন্তুষ্ট হোন) মতামত তুলে ধরেছি যেখানে তিনি একাই অন্য সব পণ্ডিতের মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন, তা ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে অথবা রাসূল সা:-এর যথার্থ অভ্যাসের ভিত্তিতে অথবা অন্যের কাছে অজানা যুক্তিসম্মত জ্ঞানের ভিত্তিতে হোক না কেন এবং এমন সব বিষয় উল্লেখ করেছেন যেখানে তিনি তার সমসাময়িক পণ্ডিতদের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন অথবা যেসব বিষয়ে কোনো কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত পণ্ডিত ব্যক্তি তার সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন অথবা যেখানে তিনি (আয়েশা রা:) তার মতামতের অনুকূলে প্রমাণ উদ্ধৃত করেছেন অথবা যেখানে তিনি আরো জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।’

আল-জারকাশি অতঃপর ৫৯টি ঘটনার কথা উল্লেখ ও তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। রাসূল সা:-এর এমন সব বিশিষ্ট সাহাবির সাথে তিনি (আয়েশা রা:) দ্বিমত পোষণ করেছেন যাদের সংখ্যা ২৩ জনের কম নয়- এ সাহাবিদের মধ্যে উমর ইবনে আল-খাত্তাব, আলি ইবনে আবি তালিব এবং আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসও ছিলেন। ওই সময় মক্কায় শিশু মেয়েরা যে মৌলিক শিক্ষালাভ করত আয়েশা রা:ও তা পান। তবে তিনি এ জন্য উপকৃত হন যে, তিনি একটি উদারমনা পরিবারের সন্তান ছিলেন এবং তার পিতা ছিলেন রাসূল সা:-এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অতঃপর তিনি জ্ঞানলাভ করেন রাসূল সা:-এর কাছ থেকে। এটি উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই যে, তার জ্ঞান ছিল প্রধানত ইসলাম ও এর শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে। রাসূল সা:-এর সাথে বিয়ের সময় আয়েশা রা:-এর বয়স যদি ৯ বছর হয়ে থাকে তাহলে রাসূল সা: যখন ইন্তেকাল করেন তখন তার বয়স হয় ১৮ বছর। এই সময়কালে কম বয়সী শিক্ষার্থীরা তাই শেখে যা তাদের শিক্ষা দেয়া হয়। তারা যা শিখেছে তার সমালোচনামূলক মতামতের প্রকাশ ঘটে পরবর্তী পর্যায়ে। এ জন্য শিক্ষক ও ছাত্র উভয়ের চেষ্টার প্রয়োজন হয়। আয়েশা রা:-এর জ্ঞান থেকে প্রতীয়মান হয়, তিনি ছিলেন তেমনি একজন সমালোচনামূলক জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব- এর অর্থ হলো, সাধারণভাবে যা ধারণা করা হয় তার চেয়ে তার বয়স কয়েক বছর বেশি।

আয়েশা রা: কোন বছর জন্মগ্রহণ করেছিলেন তা কি আমরা নির্ধারণ করতে পারি? প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন, এটি সহজ নয়। কারণ আমরা আগেই বলেছি, বিভিন্ন ঘটনা ও মৃত্যুর তারিখ নিবন্ধন করার নির্দিষ্ট কোনো সূত্র আরবদের ছিল না। যা হোক, কিছু কিছু ইঙ্গিত থেকে এ ব্যাপারে উপলব্ধি করা যায়। প্রথম সূত্র হলো- ইসলামী বর্ষপঞ্জির তৃতীয় শতকের অত্যন্ত সম্মানিত ঐতিহাসিক আল-তাবারি। তিনি তার সুবৃহৎ ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেন, আয়েশা রা:-এর পিতা আবু বকরের চার সন্তান ছিল- তার দুই স্ত্রীর প্রত্যেকের গর্ভে দুটি করে সন্তান ছিল এবং তার সব সন্তানই জন্মগ্রহণ করে ইসলাম প্রচারের আগে। ইসলামের বাণীর প্রকাশ শুরু হওয়ার কমপক্ষে ১৪ বছর পর আয়েশা রা:-এর বিয়ে হয়।


দ্বিতীয়ত, এটা নিশ্চিত যে আয়েশা রা:-এর বোন আসমা ছিলেন আয়েশা রা:-এর চেয়ে ১০ বছরের বড় এবং তিনি (আসমা) মারা যান ’৭৩ হিজরি সালে। বর্ণিত আছে, তিনি কমপক্ষে ১০০ বছর জীবিত ছিলেন। আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না যে, তার (আসমার) বয়স ১০০ বছর ছিল অথবা দুই বোনের বয়সের পার্থক্য ছিল ১০ বছর। তবে এই দুই তথ্য যদি সঠিক হয় তাহলে ইসলাম প্রচার হওয়ার চার বা পাঁচ বছর আগে আয়েশা রা:-এর জন্ম হয় এবং বিয়ের সময় তার বয়স ছিল ১৮ বা ১৯ বছর।

আয়েশা রা:-এর জন্মের সময়ের আরেকটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই বর্ণনা থেকে যে, ২৮ বছর বয়সের সময় আবুবকর রা: বিয়ে করেন আয়েশা রা:-এর মা উম্মে রাউমানকে। রাসূল সা:-এর চেয়ে আবুবকর দুই বছরের ছোট ছিলেন। এর অর্থ হলো, ইসলামের বাণীর প্রচার শুরু হওয়ার সময় তার বয়স ছিল ৩৮ বছর। অন্য কথায়, তিনি তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে বিয়ে করেন ইসলাম প্রচার শুরু হওয়ার ১০ বছর আগে। তার আর কোনো সন্তান ছিল কি না যারা শিশুকালেই মারা যায়, এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। এটা মনে করা যৌক্তিক যে, বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে তার দুটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এর অর্থ হলো, ইসলাম প্রচার হওয়ার কমপক্ষে পাঁচ বছর আগে আয়েশা রা: জন্মগ্রহণ করেন এবং বিয়ের সময় তার বয়স হয় ১৯ অথবা ২০ বছর।
আমাদের কাছে এমন সব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও লোকেরা বারবার বলে যে, রাসূল সা:-এর সাথে তার (আয়েশার) বাগদানের সময় বয়স ছিল ছয় বছর এবং বিয়ের সময় ছিল ৯ বছর? এর উত্তর হলো এই, এই তথ্যটি পাওয়া যায় একটি হাদিসে। হাদিস গ্রহণযোগ্যতার বিষয় এবং প্রতিটি হাদিসের প্রামাণিকতা নিয়ে আমরা কতটা গুরুত্ব দেবো সে সম্পর্কে আমি আলোচনা করতে চাই না। যা হোক, আমরা বলতে পারি, প্রত্যেকটি হাদিসের দুটি অংশ আছে : বর্ণনাকারীদের পরম্পরাগত বর্ণনা এবং ওই বর্ণনার উদ্ধৃৃতি, যার উৎসরূপে আরোপ করা হয় রাসূল সা: অথবা তাঁর একজন সাহাবিকে। হাদিস পণ্ডিতরা প্রধানত পরম্পরাগত বর্ণনার ওপর মনোনিবেশ করেন, আর ইসলামী আইন বিজ্ঞানের পণ্ডিতরা (অর্থাৎ ফিক) পর্যালোচনা করেন প্রত্যেকটি হাদিসের মূল পাঠ। কোনো হাদিসের মূল পাঠ যদি ত্রুটিমুক্ত হয় তাহলে তা সঠিক বলে গ্রহণ করা হয়, তবে শর্ত হলো, পরম্পরাগত বর্ণনাও গ্রহণযোগ্য হতে হবে।

হাদিস পণ্ডিতরা বর্ণনাকারীদের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে অত্যন্ত পরিশীলিত পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যেন প্রতি পরম্পরাগত বর্ণনা ও সেই মোতাবেক প্রতিটি হাদিসের ধাপ বা শ্রেণী বিচার করা যায়। যে হাদিসে আয়েশা রা:-এর বিয়ের সময়ের বয়স ৯ বছর বলে উল্লেখ করা হয় তার প্রধান বর্ণনাকারীর মধ্যে আছেন হিশাম ইবনে উরউয়া ইবনে আল-জুবায়র ইবনে আল-আউয়াম। হাদিস পণ্ডিতরা হিশামকে বিশ্বস্ত বলে গণ্য করেন। তবে তারা সতর্ক করে দেন, পরবর্তী জীবনে ইরাকে থাকার সময় তিনি তার পিতার কাছ থেকে যা শুনেছেন তা বর্ণনায় সাধারণত অসতর্ক ছিলেন। এর অর্থ হলো, আগে হিজাজে থাকার সময় তিনি যা বর্ণনা করেন তা প্রামাণিক বলে গ্রহণযোগ্য, আর তার পরবর্তীকালের বর্ণনায় এমন কিছু আছে যা কাম্য নয়। আয়েশা রা:-এর বয়স সম্পর্কিত হিশামের কাছ থেকে আমরা যেসব বিবরণ পাই তা এই শ্রেণীর। সুতরাং আমরা বলতে পারি, ওইসব বর্ণনার আরো সুদৃঢ় প্রমাণ দ্বারা পাল্টা জবাব দেয়া হয়েছে এবং আমরা এ হাদিস যথার্থ প্রামাণিক বলে গ্রহণ করতে পারি না।

উপসংহার : এ সব সাক্ষ্যপ্রমাণ বিবেচনা করার পর আমরা এই বক্তব্য অর্থাৎ রাসূল সা:-এর সাথে বিয়ের সময় আয়েশা রা:-এর বয়স ৯ বছর ছিল তা প্রত্যাখান করতে বাধ্য হই। আমরা বলি, খুব সম্ভবত ওই সময় আয়েশা রা:-এর বয়স ছিল ২০ বছরের কাছাকাছি- হতে পারে এক বা দুই বছরের কম বা বেশি। আমরা যেসব প্রমাণ উল্লেøখ করেছি তার কোনো কোনোটা যৌক্তিক বিচারের ওপর ভিত্তিশীল এবং কোনো কোনোটার আছে দৃঢ় ভিত্তি, যেমন বিয়ের প্রস্তাব যেভাবে আসে এবং উহুদ যুদ্ধে তার (আয়েশার) উপস্থিতি। তবু অনেক লোক আছে যারা বলবে যে, ওই সময় আয়েশা রা:-এর বয়স ছিল ৯ বছর। এমন লোক তিন শ্রেণীর। প্রথমত, এক শ্রেণীর লোক আছে যারা ইসলামের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। তারা যেকোনো উপায়ে হোক রাসূল সা:-এর চরিত্রের কুৎসা করতে চায়। সন্দেহ নেই, এ ধরনের একটি বর্ণনা তাদের কাছে একটা বড় হাতিয়ার হিসেবে গণ্য হয়। এর আমরা কোনো উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব না। কারণ, তাদের শত্রুতা সবসময়। সত্যের প্রতি তাদেরকে অন্ধ করে রাখবে।

অন্য দুই শ্রেণীর লোক হলো মুসলিম। তাদের মধ্যে একদল আছেন যারা শিশুকালে যা শিখেছে তা তারা আঁকড়ে ধরে থাকে এবং পুরনো প্রতিষ্ঠিত তথ্যকে চ্যালেঞ্জকারী কোনোকিছু গ্রহণ করা তাদের জন্য কষ্টকর। অন্য একদল মুসলিমের মধ্যে আছে প্রথাগত পণ্ডিত। প্রামাণিক সঙ্কলনে অন্তর্ভুক্ত একটি হাদিসকে বাতিল করা তাদের জন্য কষ্টকর। উভয় গ্রুপের লোকেরা এ কথা বিশ্বাস করার পক্ষে যুক্তি দেখাতে কষ্টকর চেষ্টা করবে যে, আয়েশা রা:-এর বিয়ে হয় ৯ বছর বয়সের সময়। তারা এ যুক্তি দেখাবে যে, আরবের গরম আবহাওয়ায় মেয়েরা অত্যন্ত অল্প বয়সে বয়ঃসন্ধিপ্রাপ্ত হয়। তাদের প্রয়াস কোনো ফল বয়ে আনবে না। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা মতামতের পর্যালোচনাকে তারা দুঃসাধ্য মনে করা ছাড়া তাদের ওই যুক্তি আর কোনো কিছু প্রমাণ করবে না।

 

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us