হাফিজের ‘জায়নামাজ রাঙিয়ে দাও শরাবে’র গোপন কথা

মীম মিজান | Dec 03, 2020 05:11 pm
মহাকবি হাফিজ শিরাজী

মহাকবি হাফিজ শিরাজী - ছবি সংগৃহীত

 

মহাকবি হাফিজ শিরাজী (১৩১০ থেকে ১৩২৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে জন্ম আর ১৩৮৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষে অথবা ১৩৮৯ খ্রিষ্টাব্দের প্রারম্ভে মৃত্যুবরণ) কাব্যরস পিপাসুদের কাছে অনিবার্য এক নাম। তাঁর কাব্যের পঙ্ক্তিতে বিহার করে নিজের দুঃখ-যাতনা ভোলেন। প্রেমে বিভোর হন। কিন্তু তাঁর কবিতা না বুঝে তার সময়কালে যেমনটি তাঁকে কাফের ঘোষণা করে মৃত্যুবরণের পর সমাহিত করা নিয়ে যে জটিলতা দেখা দিয়েছিল। ঠিক তেমনই জটিলতা দেখা যাচ্ছে এখনো। কাব্যগাঁথার মর্ম বুঝতে অক্ষম কতিপয় ব্যক্তির অভিযোগের তীর যে, কেমন করে একজন মুসলিম কবি বলতে পারেন ‘জায়নামাজকে শরাব দিয়ে রাঙাতে!’ তিনি নাকি হাফেজে কুরআন! যার দরুণ হাফিজ নামেই খ্যাত!

এ বিষয়ের বিশ্লেষণের আগে যে অংশ নিয়ে অভিযোগ তাঁর মূল ফারসি ও সরল বাংলা জেনে নেয়া যাক। মূল ফারসি : ‘বে মেই সাজ্জাদেহ রাঙ্গিন কুন গারাত পীরে মাগান গুইয়াদ/কে ছ’লেক বিখবর না বুদ ঝে রাহ ও রাসমে মাঞ্জিলহা’। আর যার সরল বাংলা হচ্ছে : ‘জায়নামাজকে সোমরসে সিক্ত করো, যদি বৃদ্ধ মাতাল বলে/কেননা আল্লাহর পেয়ারা বান্দা ভালো করে জানেন, পথ ও গন্তব্যের নিয়ম-কলা’।

হাফিজ তার কবিতার মতোই নিজে ছিলেন একজন একনিষ্ঠ আল্লাহভীরু মানুষ। ছোট্টোবেলায় কুরআনের হাফেজ হন। যার ফলে তাঁর মূল নাম খাজা শামসুদ্দিন মুহাম্মদ শিরাজীর পরিবর্তে হাফিজ শিরাজী নামেই সমধিক পরিচিতি পান। তিনি কুরআনকে ১৪ সুরে পড়তে পারতেন। তাঁর মৃত্যুর ১০০ বছরেও কোনো গবেষক বা জীবনীকার তাঁর জীবনী গ্রন্থিত করেননি বলে অনেক বিষয়ই অজানা রয়ে গেছে। তদুপরি জানা যায়, তিনি কখনোই অনৈসলামিক কোনো কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তাঁর পক্ষে নিশ্চয়ই উচ্ছন্নে যাওয়ার আহ্বান করা শোভা পাবে না।

মূলত জায়নামাজকে শরাবে রাঙিয়ে দেয়া একটি উপমা। কাব্যকলায় যার উপমা যত বেশি শক্তিশালী তার কাব্য ততই বহুমুখী ও পাঠকনন্দিত। এ দিক থেকে হাফিজ শিরাজী শতভাগ সফল। তাঁর দেওয়ানের অন্যান্য গজলের মতো প্রথম গজলটিও প্রেমকেন্দ্রিক। তবে সে প্রেম বাহ্য দৃষ্টিতে কোনো নারীর প্রেম মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা স্রষ্টার প্রেম। এখানে স্রষ্টা প্রেমাস্পদ। আর আমরা হচ্ছি প্রেমিক।

প্রেমে পড়লে মনে হয় কোনো সুখের স্বর্গের বাসিন্দা আমি। কিন্তু এ প্রেম কিছু দিন পর কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নানাভাবে প্রেমের সিঁড়ির যাত্রীকে ভোগ করতে হয় যাতনা। তেমনি আল্লাহ প্রেমে মশগুল হলে অন্যরা মনে করবে উন্মাদ। নিজের খায়েশকে দমন করতে হয়। আরাম, আয়েশ ইত্যাদিকে ছাড়তে হয়।

প্রেমের পথের একজন ওস্তাদ থাকেন। যার কাছ থেকে সবক নিয়ে কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে হয়। কেননা তিনি এ পথে চলতে চলতে সিদ্ধিলাভ করেছেন। তাই তার জানা থাকে পথ ও গন্তব্যের যাবতীয় নিয়ম। সুফি ও মরমীবাদের ভাষায় যাকে গুরু বা সাঁইজি বলে। আর সাধারণ পরিভাষায় বলা হয় ইমাম বা নেতা। পথটি হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জিকির-আসকার, তাহাজ্জুদ, নফল ও সিজদাহ। গন্তব্য বা মঞ্জিল হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ। আর সন্তুষ্টি অর্জন হলেই তো আমরা ক্ষমা লাভ করে জান্নাতের বাসিন্দা হওয়ার পরম সৌভাগ্য অর্জন করব।

ইনি সেই ইমাম যিনি একনিষ্ঠ আল্লাহ প্রেমিক। ইনি সেই নেতা যিনি তার অনুসারীদের পথ ও গন্তব্যের সব বিষয় সুচারুভাবে বুঝিয়ে দিয়ে মঞ্জিলে মকসুদে উপনীত করান। কারণ তিনি নিজেও এ পথ ধরে চলেছেন। প্রত্যক্ষ করেছেন সব নিয়ম-কলা।

মহান আল্লাহর ঘোষণা- ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমার নবীর অনুসরণ করো; তা হলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ মার্জনা করবেন।’ (সূরা আলে ইমরান : ৩১) আল্লাহকে ভালোবাসার জন্য রাসূলুল্লাহর সা:-কে অনুসরণ করতে হবে। আবার রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনুসরণ করতে হবে নেতা বা ইমামের আনুগত্যের মাধ্যমে। যেমনটি আল্লাহ সরাসরি সূরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করছেন- ‘আল্লাহর আনুগত্য করো, তার রাসূলের আনুগত্য করো আর তোমাদের নেতা বা ইমামের আনুগত্য করো।’ আবার সূরা মুহাম্মদের ৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ আনুগত্য করার আদেশের পর বলছেন- ‘নিজেদের আমল নষ্ট করো না।’

সুতরাং আনুগত্য কতটা জরুরি! আনুগত্যে গড়িমসি হলে নিজ ভালোকর্ম বিনষ্ট হবে। তাই আনুগত্য করতে হবে কুণ্ঠাহীন। তবে কার আনুগত্য করব? যিনি আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা। যিনি প্রশ্নাতীত চরিত্রের অধিকারী। এমনই ব্যক্তিকে হাফিজ শিরাজী বলেছেন পিরে মাগান বা বৃদ্ধ মাতাল। এখানে কাব্যিক অলঙ্কার বিশ্লেষণ ও গজলের পূর্বাপর অর্থ একত্রিত করলে একটি স্পষ্ট ধারণা জন্মে যে, এখানে আল্লাহ প্রেমে দিওয়ানা ব্যক্তির সমাবেশের প্রধান হচ্ছেন বৃদ্ধ মাতাল। আসলেই মাতাল। আল্লাহর দিদার লাভের মাতাল। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাতাল। এ মাতালদের মধ্যে সব থেকে বেশি অভিজ্ঞতার অধিকারীই তিনি। তাই তার আদেশ মেনে চলা ফরজ। যেমনটি আল্লাহর আদেশ।

হাফিজের কবিতার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য যে, তিনি রেন্দি বা মাতাল হওয়াকে দুঃখ-কষ্ট ভুলে থাকার মাধ্যম হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। একজন মানুষ নেশাগ্রস্ত হলে যেমন তার চৈতন্য হারিয়ে দুঃখ-ব্যথা ভুলে যান তেমনি একজন একনিষ্ঠ মুমিন যখন দুনিয়াবি জ্বালা-যন্ত্রণা পান- আর সেগুলো ভোলার জন্য আল্লাহর ইবাদতে, জিকির-আসকারে মশগুল হন। আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে তৃপ্ত হন। তার আর থাকে না কোনো অভাববোধ, যাতনাবোধ। নিজেকে মনে হয় পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ। আল্লাহর প্রতি তার বেড়ে যায় আস্থা। যেমনটি আল্লাহ ঘোষণা দিচ্ছেন- ‘প্রকৃত মুমিন তারাই যখন তাদের কাছে আল্লাহর নাম নেয়া হয়, তখন তাদের অন্তর কেঁপে ওঠে। আর যখন তাদের কাছে তাঁর (আল্লাহর কুরআনের) আয়াত পাঠ করা হয় তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। তারা তাদের প্রভুর ওপরই ভরসা করে।’ (সূরা আনফাল : আয়াত ২-৪)
জায়নামাজ সোমরসে সিক্ত করার কথাটা রূপক। এর দ্বারা একনিষ্ঠ আনুগত্য করার কথা বলা হয়েছে।

একজন একনিষ্ঠ আল্লাহভক্ত আরেফ কখনোই জায়নামাজকে হারাম সোমরসে সিক্ত করতে বলবেন না! তিনি আল্লাহ প্রেমের শরাব বা তাহাজ্জুদ, নফল, জিকির-আসকার, সেজদাহকে বুঝিয়েছেন। যেগুলো জায়নামাজে বসে, দাঁড়িয়ে আদায় করতে হয়। এগুলোর মাধ্যমেই তো আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। আর এগুলো করতে বলবেন একজন আরেফ। তাই তার আনুগত্য করতে হবে দ্বিধাহীন।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us