ঘোর

ফাবিহা ফেরদৌস | Mar 08, 2022 01:27 pm
ঘোর

ঘোর - ছবি : সংগ্রহ

 

ক্লাসের সবচেয়ে শান্ত ছেলে কৌশিক তেজের সাথে বলল,

– স্যার, মোনার সাথে আপনার বয়সের ডিফারেন্স ৩০ বছর!

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,

– তো ?

কৌশিক আরো ঝাঁঝের সাথে বলল,

– সে আপনার মেয়ের বয়সী।

এবার আমি মুচকি হেসে বললাম,

– আমার মেয়ে অধরা, মোনার থেকে দুই বছরের বড়।

কৌশিক দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

– মেয়ের বয়সের চেয়ে ছোট একজনের সাথে ঘুরতে আপনার লজ্জা করে না ?

– না, করে না। কিন্তু মোনার যদি কোনো সমস্যা না থাকে, তবে তোমার সমস্যা কোথায়?

– মোনা একটা ঘোরের ভিতরে আছে, তাই বুঝতে পারছে না। মোনার সাথে আমার তিন বছরের এফেয়ার। ক্যাম্পাসের সবাই জানে। আমার ইয়ারমেটরা আপনার পিছনে থু থু ফেলে, কিন্তু সামনে কিছু বলার সাহস পায় না, আপনি ফেল করিয়ে দেবেন, তাই। কিন্তু আমি ফেলের ভয় পাই না। আমি কিছুতেই আপনাকে আমার ভালোবাসাকে ছিনিয়ে নিতে দেব না।

– মোনাকে আমি ছিনিয়ে নেব কেন ? মোনা নিজেই আমার কাছে এসেছে। তুমি বরং তোমার বোঝাপড়াগুলো মোনার সাথেই করো। আমার চেম্বারের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার রোগীগুলো অনেকক্ষণ হলো অপেক্ষা করছে। তোমাকে আর সময় দিতে পারব না।

কৌশিক রাগে গজ গজ করতে করতে বেরিয়ে যায়।

আমি মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান, প্রফেসর রাশেদ। মোনা, কৌশিক দুজনেই আমার মেডিকেলের পঞ্চম বর্ষের স্টুডেন্ট। মোনাকে আমি ক্লাসে প্রথমে খেয়াল করিনি। একদিন আমার চেম্বারে এসেছিল সামান্য পেটে ব্যথা নিয়ে। সেদিনই প্রথম পরিচয় ওর সাথে। এরপর কলেজের একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ওর সাথে যুগল কবিতা আবৃত্তি করি। সবাই জানত আমি দারুণ কবিতা আবৃত্তি করি।

তাই অনুষ্ঠানের আগে ওরা এসে অনুরোধ করলো, 'স্যার, আমরা অনুষ্ঠানে টিচার এবং স্টুডেন্টের যুগলবন্দিতে একটা কবিতা আবৃত্তি করতে চাই। আমাদের মোনাও দারুণ কবিতা আবৃত্তি করে স্যার। যদি আপনি একটু রাজি হতেন স্যার।'

তাকিয়ে দেখি, মোনা অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওকে না বলতে ইচ্ছা করলো না। রাজি হয়ে গেলাম। অনুষ্ঠানটা দারুণ হয়েছিল। মোনার যে এত গুন, জানতাম না। যেমন আবৃত্তি করে, তেমন নাচ, গান ।

এরপর থেকেই মোনাকে ক্লাসে খেয়াল করতাম। প্রজাপতির মতো মেয়েটা। সারাক্ষণ ছটফট করে। শুধু আমি যখন পড়ানো শুরু করতাম, তখন আশ্চর্যজনকভাবে চুপ হয়ে যেতো। আমি জানি, আমি খুব ভালো পড়াই। কিন্তু ওর চোখ দেখে আমি বুঝতাম, আমার পড়া নয়, ও যেন আমাকে গিলছে। আমার স্ত্রী সোমা যখন আমার প্রেমে পড়েছিল, তখন ঠিক এমনই দৃষ্টি থাকতো ওর চোখে।

আমার স্ত্রী সোমা পাঁচ বছর আগে মারা গেছে। দুই বছর আগে আমার একমাত্র মেয়ে অধরাকে বিয়ে দিয়েছি। অধরা এখন স্বামীর সাথে অস্ট্রেলিয়াতে সেটেল হয়েছে। অধরা খুব মন খারাপ করে আমার জন্য। অধরা বলে, 'বাবা, ওখানে তো আমাদের আপন কেউ নেই। তোমার নিশ্চয়ই একা একা লাগে? তোমার তো চাকরির পঁচিশ বছর হয়ে গেছে। তুমি স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে আমার কাছে চলে আসো। অথবা আর একটা বিয়ে করে ফেলো।' আমি হেসে দিয়ে বলি, 'একা একা লাগবে কেন? আমার রোগীরা আছে না?' কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, একা একা লাগে। রাতে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করে না। জীবনটা কেমন জানি একঘেয়েমি হয়ে যাচ্ছিলো।

মোনার এই প্রেম পূর্ন দৃষ্টি, তাই আমার ভালো লাগত। ওয়ার্ডে ইচ্ছা করেই ওকে প্রশ্ন বেশি করতাম। ও দারুণ জিনিয়াস। আর সম্ভবত আমাকে ইমপ্রেস করার জন্যই আগে থেকে পড়ে আসত। মাঝে মাঝেই আমার রুমে এটা সেটা পড়া বুঝতে আসত। আমি বুঝতাম, আসলে পড়া বুঝতে নয়, আমার কাছে আসার জন্যই ও আসত। আস্তে আস্তে মোনার সাথে এক ধরণের সম্পর্ক হয়ে গেল আমার। আমরা একসাথে চাইনিজ খেতে যাই, নদীর পাড়ে ঘুরতে যাই, একসাথে আবৃত্তি করি।

মোনা বলেছে, কৌশিকের সাথে তার সম্পর্ক ছিল, কিন্তু আমাকে দেখার পর থেকেই সে বুঝতে পেরেছে, সে আসলে আমাকে চায়। আমার সাথে দেখা না হলে তার অস্থির লাগে। সে রাতে ঘুমাতে পারে না। আমি তাকে বুঝিয়েছি, আমাদের মধ্যে বয়সের পার্থক্য অনেক। তার বাড়ি থেকে কখনোই রাজি হবে না। আর সে নিজেও এখন ঘোরের মধ্যে আছে। পরে এক সময় ঘোর কেটে যাবে।

কিন্তু মোনা আমার সাথে একমত হয় না। ওর বাড়ি থেকে কেউ রাজি হয় না, কিন্তু মোনা বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। আমি অধরাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আমি বিয়ে করলে ওর কোন আপত্তি আছে কিনা। অধরা বললো, 'কী যে বলো বাবা! আমার কত বড় দুঃশ্চিন্তা শেষ হবে, তুমি জানো না।'

একদিন নিজেরা নিজেরাই বিয়ে করে ফেললাম। পরে অনুষ্ঠান করে অফিসের সবাইকে দাওয়াত দিয়েছি। মোনার ইয়ারের সবাইকেও দাওয়াত দিয়েছিলাম। সবাই এসেছিল, কৌশিক ছাড়া। আর মোনার বাড়ি থেকেও কেউ আসেনি।

বিয়ের পরে দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিল। মোনা পুতুল খেলার মত করে সংসার সাজাচ্ছিলো। পুরানো সব ফার্নিচার বাতিল করে গর্জিয়াসভাবে ঘর সাজালো। এর ভিতরেই মোনা ফাইনাল পরীক্ষায় পাশ করে ডাক্তার হয়ে গেল।

মোনার গাইনি ওয়ার্ডের ব্যস্ততার কারণে আমাদের পুতুল খেলার সংসারে ছন্দ পতন হলো। মোনাকে আগের মতো আর পাওয়াই যায় না। আমার প্রজাপতিটা কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল। ভেবেছিলাম, গাইনি ওয়ার্ড শেষ হলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু যখন আমার মেডিসিনে প্লেসমেন্ট হলো, তখন আসল সমস্যাটা বুঝতে পারলাম। কৌশিকেরও আমার ওয়ার্ডেই প্লেসমেন্ট। আমি খেয়াল করে দেখেছি, মোনা কেমন করুণ দৃষ্টিতে তাকায় কৌশিকের দিকে। ওর চোখের ভাষা আমি পড়তে পারি। স্পষ্ট অনুতপ্তের ছাপ সেখানে।

মোনার সাথে আগের মতো ঘুরতে যাই। কিন্তু সে ঘোরাতে কোনো প্রাণ থাকে না। মোনা চেষ্টা করে, আগের মতো সাবলীল হতে, কিন্তু হতে পারে না। আমি বুঝতে পারি, অসম বয়সী একজনের প্রেমে পড়ে সে ভুল করেছে। প্রজাপতিটা কাচবন্দী বাক্সের মধ্যে ছটফট করে। মুক্তির উপায় জানে না।

আমি একদিন ওকে সরাসরি প্রশ্ন করলাম, 'তুমি কি কৌশিককে মিস করছো ?' মোনা ‘না’ সূচক মাথা ঝাকালো। কিন্তু ওর চোখে পানি ! আমি আরো নরমভাবে বললাম, 'কৌশিক কি জানে, যে তুমি ওকে এখনও ভালোবাসো?' মোনা প্রবলভাবে ‘না‘ সূচক মাথা ঝাকাল।

ঠিক কী করা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না। ঢাকাতে আমার একটা তিনতলা বাড়ি আছে ভাড়া দেয়া। ওটা মোনার নামে লিখে দিলাম। মোনার ইন্টার্নি শেষ হয়েছে। ওকে বললাম,

– আমি চাকরি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে আমার মেয়ে অধরার কাছে চলে যেতে চাই। তুমি কি আমার সাথে যাবে?

– না।

– আমার ঢাকার তিনতলা বাড়িটা তোমার নামে লিখে দিয়েছি। তুমি যেকোনো একটা ফ্ল্যাটে নিজে থেকে, বাকিগুলোর ভাড়া দিয়ে চলতে পারবে। আর ডিভোর্স পেপারে সিগনেচার করে রেখেছি। তুমি চাইলেই নিজে সিগনেচার করে ডিভোর্স কমপ্লিট করে কৌশিককে বিয়ে করতে পারো।

দেখি মোনা এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন ফেরেস্তাকে দেখছে। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। আমি ফেরেস্তা নই। আমার চোখে দারুণ কষ্ট। আমি সেই কষ্ট, মোনাকে দেখতে দিতে চাইনি। আমি চাকরি ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া চলে এলাম।

দীর্ঘ সাত বছর অস্ট্রেলিয়াতে আছি। মোনার সাথে কোনো রকম যোগাযোগ করিনি। আসলে দেশের সাথেই কোনো রকম যোগাযোগ নাই। মোনাও আমার সাথে যোগাযোগ করেনি। জানি, ক্ষণিকের মোহে পড়ে যে জীবনের সাথে সে জড়িয়ে গিয়েছিল, সেই জীবনকে সে ভুলতে পেরেছে। নিশ্চয়ই কৌশিকের সাথে সুখে আছে সে।

গতমাসে আমার বন্ধু ডা. শফিক এসেছিল অস্ট্রেলিয়া। বলল, এইমাসে আমাদের মেডিকেল কলেজে আমাদের ইয়ারের পুনর্মিলনী খুব ধুমধাম করে পালন করা হবে। আমি যেন অবশ্যই যাই। আমারও কেন জানি খুব দেশে যেতে ইচ্ছা করছিল। তাই রাজি হয়ে গেলাম। ঢাকায় পৌঁছেই ফোন করব না, করব না করেও ফোন দিলাম মোনাকে। জিজ্ঞাসা করলাম, ওর সাথে দেখা করা যাবে কিনা। মোনা বলল, তোমার বাড়িতেই আছি, চলে এসো।

বিকালে গেলাম মোনার বাসায়। দোতলার একটা ফ্ল্যাট, খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। ও অবশ্য বরাবরই ঘর সাজাতে পছন্দ করে। জিজ্ঞাসা করলাম,

– কৌশিক কেমন আছে?

– ভালো আছে।

– তোমার ছেলেমেয়ে হয়নি?

– হ্যাঁ, হয়েছে। একটা ছেলে।

এমন সময় রুমে একটা বাচ্চা ছেলে ঢুকল। আমাকে দেখে অবাক হয়ে তাকাল। জিজ্ঞাসা করলাম,

– তোমার নাম কি বাবা?

– আনান রাশেদ।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,

– কী বললে! আবার বলো।

– আনান রাশেদ।

আমি মোনার দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। মোনা বলল,

– তুমি চলে যাওয়ার পরে তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে কৌশিককে বিয়ে করার কথা ছিল আমার। কিন্তু তখনই জানতে পারি, আমি প্রেগনেন্ট। কৌশিক বলেছিল, 'কোনো সমস্যা নেই। বাচ্চাটাকে আমার বাচ্চা হিসেবে মানুষ করব, কেউ বুঝতে পারবে না।' কিন্তু আমি রাজি হইনি। কৌশিককে জোর করে আমার বান্ধবী তুলির সাথে বিয়ে দিয়েছি। ওরা খুব সুখে আছে। আমার এবং আনানের খোঁজখবরও রাখে।

কৌশিক বহুবার বলেছে, তোমাকে যেন খবর দিই। কিন্তু তোমাকে খবর দেয়ার মতো মুখ আমার ছিল না। তোমার ভালো মানুষীর সুযোগ আমি বারবার নিতে পারি না। প্রথমে ভেবেছিলাম, তোমার বাড়িটাও নেব না। কিন্তু আনানকে ভালোভাবে মানুষ করার জন্য তোমার এই সাপোর্টটুকু নেয়ার আমার দরকার ছিল। আমি এখন বিএসএমএমইউতে এমডি থিসিস পার্টে আছি। তোমার বাসাতে থাকার কারণে আমার কোর্সটা করতেও সুবিধা হয়েছে।

মোনার কোনো কথাই আমার কানে ঢুকছিল না। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে আনানকে জড়িয়ে ধরলাম। প্রথমবার অধরাকে কোলে নেয়ার সময় যেমন উত্তেজনা কাজ করছিল, ঠিক তেমনই উত্তেজনা কাজ করছে আমার ভিতরে। আমি
ফিসফিস করে আনানকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'তুমি কি জানো, আমি তোমার বাবা?' আনান বললো, 'জানি তো। তোমার অনেক ছবি আছে আমার কাছে। আম্মু বলত, একদিন তুমি অবশ্যই আমাকে দেখতে আসবে।'

আমি শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আনানকে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us