অনন্য নজির সেই সিরাজের

অন্য এক দিগন্ত ডেস্ক | Dec 29, 2020 01:33 pm
মোহাম্মদ সিরাজ

মোহাম্মদ সিরাজ - ছবি সংগৃহীত

 

মাত্র কিছু দিন আগে বাবাকে হারিয়েছেন। তবে দেশে ফিরে বাবাকে শ্রদ্ধা জানানোর থেকে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ভারতের জার্সি পরে বাবার লড়াইকে সম্মান জানাতে চাওয়া মোহাম্মদ সিরাজ মঙ্গলবার গড়লেন অনন্য রেকর্ড। প্রথম ভারতীয় বোলার হিসেবে অভিষেক ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ৫ উইকেট নেয়ার তালিকায় ঢুকে পড়লেন তিনি।

শ্রীলঙ্কার পেসার লাসিথ মালিঙ্গা ২০০৪ সালে অভিষেক ম্যাচ খেলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। সেই ম্যাচে ২ ইনিংস মিলিয়ে তিনি নেন ৬ উইকেট। সিরাজ নিলেন ৫টি। প্রথম ইনিংসে তিনি ফিরিয়েছিলেন মার্নাস লাবুশানে এবং ক্যামেরুন গ্রিনকে। দ্বিতীয় ইনিংসে সিরাজের শিকার ট্রাভিস হেড, গ্রিন ও নাথান লায়ন। অসি স্পিনার লায়নের উইকেট নেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মঙ্গলবার সিরাজ ঢুকে পড়লেন মালিঙ্গাদের এই তালিকায়।

শেষ ৫০ বছরে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অভিষেক হওয়া বোলারদের মধ্যে মাত্র ৪ জন ৫ বা তার বেশি উইকেট নিয়েছেন। ১৯৮৬–৮৭ সালে ইংল্যান্ডের ফিলিপ ডেফ্রিটাস এবং ১৯৯৮–৯৯ সালে ইংল্যান্ডের আরেক পেসার অ্যালেক্স টিউডর এই কীর্তি গড়েছিলেন।

সিরাজের কৃতিত্ব আরো বেশি কারণ মেলবোর্নে দ্বিতীয় ইনিংসে উমেশ যাদব মাত্র ৩.৩ ওভার করে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন চোটের কারণে। ভারতের পেস অ্যাটাকের দায়িত্ব এসে পড়ে বুমরা এবং সিরাজের ওপর। সেই দায়িত্ব দারুণভাবে সামলে দিলেন তিনি। তাঁদের দাপটেই জয়ের পথ সহজ হয়ে যায় ভারতের জন্য।

এক অদম্য পেসার

বস্তিতে জন্ম। বাবা ছিলেন অটোচালক। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। এমন পরিবেশ থেকে একজন যুবকের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্প বেশ অকল্পনীয়। কিন্তু মেধা, চেষ্টা আর নিবিড় অধ্যাবসায়ে সব বাধা দূর করে আলোর পথে এগিয়েছেন। মন জয় করে নিয়েছেন সবার। আইপিএল দিয়ে লাইমলাইটে আসা, এরপর ভারতের টি-২০ দলে ২০১৭ সালে অভিষেক, দুই বছর পর ওয়ানডেতেও। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে এবার সাদা পোশাকেও অভিষেক হলো সুঠাম দেহের অধিকারী তরুণ পেসার মোহাম্মদ সিরাজের। শনিবার ভোরে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট ক্যাপ পড়লেন ভারতের হয়ে। স্বপ্ন পূরুণের পথে এগিয়ে গেলেন আরেক ধাপ।

বস্তি থেকে ভারতের জাতীয় দলে। দীর্ঘ এই পথ পরিক্রমা মোটেও সহজ ছিল না সিরাজের। কন্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে আজকের সিরাজ। তার উঠে আসার গল্প রূপকথার কাহিনীকেও হার মানায়।

হায়দরাবাদের ফার্স্ট ল্যান্সার বস্তিতে জন্ম সিরাজের। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন বড় ক্রিকেটার হবে। কিন্তু অটোচালক বাবার পক্ষে ক্রিকেটের সরঞ্জাম কিনে দেয়ার ক্ষমতা ছিল না। তবুও ছেলের ইচ্ছেপূরণের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন মোহাম্মদ ঘাউস। দুই কিলোমিটার দূরে স্পোর্টস কোচিং ফাউন্ডেশনে নিয়ে যান সিরাজকে। কিন্তু সেখানে বেতন দেয়ার ক্ষমতা ছিল না তার।

তবুও সিরাজের পরীক্ষা নেয়ার জন্য অনুরোধ করেন ছোটবেলার কোচ সাইবাবা-কে। খুদে সিরাজের বোলিং দেখেই চমকে ওঠেন কোচ। সিরাজের বাবাকে সেই কোচ বলেন, ‘তোমার ছেলের মধ্যে দারুণ প্রতিভা রয়েছে। ওকে আমার হাতে তুলে দাও।’ সে দিন থেকেই শুরু হয় যাত্রা।

সিরাজ নিজেও কতটা সাহসী, তার উদাহরণও দিলেন ছোটবেলার কোচ। তিনি বলেন, ‘অনূর্ধ্ব-১৪ বিভাগের ম্যাচে ব্যাট করার সময় ইয়র্কার আছড়ে পড়ে সিরাজের পায়ে। মাঠ থেকে বেরিয়ে আসার পরে দেখি চোটের জায়গাটা নীল হয়ে গিয়েছে রক্ত জমাট বেঁধে। ভেবেছিলাম, এই ম্যাচে ওর পক্ষে বল করা সম্ভবই না। অথচ আমাদের বোলিং শুরু হওয়ার পাঁচ ওভারের মধ্যেই হঠাৎ এসে বলে আমি বল করব। বলেছিলাম, ভেবে দেখ। পা তো এখনো ফুলে আছে। নাছোড়বান্দা সিরাজ মাঠে নামলই। এমনকি ছোট স্টেপে বল করে তিন উইকেট নিয়ে জিতিয়ে দিল আমাদের।’

গরীব বাবার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল আজকের সিরাজ। ২০১৭ সালে প্রথম লাইম লাইটে আসা তার। আইপিএল নিলামে রাতারাতি কোটিপতি বনে যান তিনি। সিরাজকে দুই কোটি ৬০ লাখ ভারতীয় রুপিতে কিনে নেয় সানরাইজ হায়দরাবাদ। এতোটা তারকা খ্যাতি পেয়েও পুরোনো কষ্টের দিনগুলো ভুলতে পারেননি সিরাজ।

সেই স্মৃতি মনে করে সিরাজ তখন বলেছিলেন, ‘বাবা আমাকে প্রতিদিন ৭০ রুপি দিতেন হাত খরচার জন্য। যাতে এটা দিয়ে আমি অনুশীলন ও ম্যাচ খেলতে পারি। তিনি যা উপার্জন করতেন সেটা থেকে এই অর্থ আমার জন্য ছিল অনেক। ওই ৬০-৭০ রুপি আমি স্কুটির পেট্রল কেনার জন্য খরচ করে ফেলতাম। কারণ ওটাই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। জানতাম কোন জায়গা থেকে আমি উঠে এসেছি।’

কিন্তু যার জন্য এতোকিছু, সেই বাবাই এখন না ফেরার দেশে। গত নভেম্বর মাসে সিরাজ তখন অস্ট্রেলিয়ায় ভারত দলের সাথে। বাবার মৃত্যুর খবর পান দলের অনুশীলন শেষে। ভারতীয় বোর্ড তাকে প্রস্তাব দেয় এই পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর। কিন্তু সেই প্রস্তাবে রাজি হননি সিরাজ। বাবা মোহাম্মদ ঘাউস সারা জীবন লড়াই করে অর্থ উপার্জন করেছেন শুধুমাত্র তার ছেলেকে দেশের জার্সিতে দেখবেন বলে। বাবার সেই স্বপ্নের কথা মাথায় রেখে সিরাজ জানিয়ে দেন, দেশে ফিরবেন না।

সিরাজের এই মনের জোরই আজ হয়তো তার সব চেয়ে বড় শক্তি। সাথে তো আছেই অদম্য এক বাবার আশীর্বাদ।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us