আসল কাশ্মীরী শাল কী, কিভাবে চিনবেন?

মাসুদ আলম | Feb 16, 2021 05:31 pm
আসল কাশ্মীরী শাল কী, কিভাবে চিনবেন?

আসল কাশ্মীরী শাল কী, কিভাবে চিনবেন? - ছবি সংগৃহীত

 

কাশ্মীরী শাল বা সোয়েটারের প্রতি সব শ্রেণির মানুষের অনেক আকর্ষণ লক্ষ্য করেছি ছোটবেলা থেকে, আমাদের পরিবারেও সেটা দেখেছি। এক সময় আমিও কিনার চেষ্টা করেছি, ভারতীয়দের মাধ্যমে ভারত থেকে আনিয়েছি....সবই বৃথা, সবই নকল ছিল।

মার্কেটের সব বিক্রেতাই বলতো এটাই আসল, কিন্তু মন ভরতো না। তাই একদিন জানার চেষ্টা করলাম- আসল কাশ্মীরী শালের রহস্য কি? বেশ কিছুটা পড়াশোনা করলাম, তথ্য সংগ্রহ করলাম, ডকুমেন্টারি দেখলাম, এক বিদেশি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারের সাথে কথা বললাম...শিখলাম, জানলাম এবং তারপর আমার সম্পূর্ণ ধারণাই পাল্টে গেল!

পাঠক, আমি আজকে আপনাদের বলবো আসল কাশ্মীরী শাল কী এবং কিভাবে আপনি খাঁটি কাশ্মীরী শাল/চাদর/সোয়েটার/পুলওভার কোট/মাফলার বা অন্য কোনো কাপড় চিনবেন?

সেটা জানলে আপনি হয়তো একটা "কারেন্ট শক্" খেতে পারেন!
'কাশ্মীরী শাল' মানে ভারত-পাকিস্তানের "দখলকৃত" কাশ্মীরের তৈরি কোনো শাল না!
অর্থাৎ কাশ্মীরী শাল বা অন্য পোশাক পৃথিবীর অন্য দেশের তৈরিও হতে পারে! এবং বাস্তবে সেটাই হয়।
কাশ্মীরী পোশাক ইংল্যান্ড ইটালি মঙ্গোলিয়া অস্ট্রেলিয়া চীন বা অন্য দেশের তৈরিও হতে পারে। তাহলে আপনি নিশ্চয়ই এখন প্রশ্ন করছেন- তাহলে নাম কেন কাশ্মীরী হলো?
আসুন ঠান্ডা মাথায় উত্তরটা একটু জেনে নেই!

হিমালয়ের পাশ্ববর্তী অঞ্চল, ইনার মঙ্গোলিয়া, ইটালির উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চল, ইংল্যান্ডের পাহাড়ি অঞ্চল এবং অষ্ট্রেলিয়ান পাহাড়ি অঞ্চল গুলোতে এক জাতের লম্বা পশম বিশিষ্ট ছাগল পাওয়া যায়, যেগুলোকে বলে ক্যাপরা হিরকাস (Capra Hircus ) ছাগল।

এই ছাগল গুলোর কতোগুলো বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলো অন্য সকল পাহাড়ি ছাগল থেকে আলাদা। যেমন- এদের গায়ের পশম খুবই চিকন এবং সিল্কি। বন্য পরিবেশে মাইনাস 40°C তাপমাত্রায়ও এরা দিব্যি বেঁচে থাকে যেখানে অন্য অনেক ছাগল (ভেড়া নয়) মাইনাস 10/15°C-এ বন্য পরিবেশে মারা যায়। এবং এই ক্যাপরা হিরকাস ছাগল গুলো সমুদ্র সমতল থেকে চার হাজার মিটার উচ্চতার পাহাড়ের পাথুরে পরিবেশেও এগুলোকে বিচরণ করতে দেখা যায়।

১৩ শ' শতকে বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পলো মঙ্গোলিয়ায় অনেক উঁচুতে পাহাড়ের গুহায় এসব ছাগলের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন।
এই ক্যাপরা হিরকাস ছাগল গুলো এখন অনেক দেশেই বাণিজ্যিক ভাবে খামারে পালন করা হয় অর্থাৎ উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই এগুলোকে গৃহপালিত (domesticated) করা হয়েছে।
ফলে এখন প্রাকৃতিক পরিবেশে বন্য (wild) ছাড়াও অনেক দেশে এসব ছাগল পাওয়া যায়।
দু'ভাবে এসব ছাগল থেকে পশম সংগ্রহ করা হয়-

১) মেশিন দিয়ে গায়ের সকল লোম ছেঁটে (shearing) মান অনুযায়ী বাছাই করা হয়, তারপর পশমকে ধুয়ে, গরম পানিতে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সিদ্ধ করে, রং মিশিয়ে এবং শুকিয়ে সুতা তৈরি করা হয়।*

২) খামারে পালিত তবে উন্মুক্ত পরিবেশে পালিত এসব ছাগলের লোম মানুষের চুল আঁচড়ানোর মতো ধীরে ধীরে আঁচড়ালে মূল পশমের নিচে থাকা আরেক ধরনের খুব সুক্ষ্ম কিছু লোম/পশম পাওয়া যায় এবং সেগুলো সংগ্রহ করে সুতা তৈরি করা হয়।*

এভাবে একটি প্রাপ্ত বয়ষ্ক ছাগল থেকে সারা বছরে সর্বোচ্চ দেড় শ' গ্রাম (১৫০ গ্রাম) পশম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী কেশমির পশমের থিকনেস হতে হবে ৯০ মাইক্রনের কম।

এই দুই প্রকার সুতাকে বলা হয় কেশমির (Cashmere)- কাশ্মীর নয়।

খেয়াল করুন, অন্যান্য ছাগল, ভেড়া, উট, খচ্চর, লামা, গুয়ানাকো,আলপেকা, ইয়াক ইত্যাদি পশু থেকে সংগৃহীত পশমের সুতাকে উল (Wool) বলা হলেও ক্যাপরা হিরকাস ছাগল থেকে সংগৃহীত লোমকে বলা হয় কেশমির! যদিও এগুলোও এক ধরনের উল।

সুতরাং কেশমির পাওয়া যায় এমন জাতের ছাগলকে বলা হয় কেশমিরি ছাগল (Cashmere goat)!

কাশ্মীর অঞ্চলে এসব ছাগলকে "পশমিনা" ছাগল বলে ডাকা হয় এবং সেগুলো থেকে তৈরি পোশাককে (শাল বা সোয়েটার) বলে পশমিনা শাল। কেশমিরি ছাগলের জাতের কাছাকাছি আরেকটি জাত হলো আঙ্গুরা ছাগল, তবে এগুলোর লোম খসখসে হয়- সেগুলো থেকে তৈরি হয় নকল কাশ্মীরী পণ্য। আঙ্গুরা ছাগলের পশম থেকে তৈরি পোশাককে বলে- আঙ্গুরা শাল ইত্যাদি।

কেশমির (Cashmere) যাকে অনেকে উচ্চারণ করে কাশমিরি বা কাশ্মীরী- এখান থেকেই মূলত ছড়িয়েছে "কাশ্মীরী শাল"! যার ফলে Made in England কোনো সোয়েটার দেখলেও অনেকে হেসে বলে- ইংল্যান্ডে তৈরি হলে আবার কাশ্মীরী হলো কিভাবে! (যদিও অনেকেই মনে করেন যে কাশ্মীর নাম থেকেই কেশমির নামটি এসেছে, যুক্তিসঙ্গতও বটে।)

২০০০ সালে আমি ঢাকা বাইতুল মোকাররামের ফুটপাত থেকে তিন শ' টাকায় একটি ব্যবহৃত সোয়েটার কিনেছিলাম। লেখা ছিল মেইড ইন ইংল্যান্ড, 100% CASHMERE.

যাহোক উপরে এক তারকা (★) চিহ্নিত সুতা থেকে তৈরি কাপড় চোপড়- হলো সাধারণ মানের কেশমিরি শাল (কাপড়), যা তৈরী হয় অভিজাত শ্রেণীর জন্য। অর্থাৎ অনেক বেশী দামি কাপড় হওয়ায় তারাই এগুলোর আসল খদ্দের।

দুই তারকা- অতি অভিজাত বা বিশ্বখ্যাত ধনি ব্যাক্তিদের জন্য স্কার্ফ/মাফলার, কোট, পুল ওভার, সোয়েটার, সার্ট, হাত মোজা ইত্যাদি তৈরি হয়। আসলে অনেক দামী কাপড় চোপড় তারাই তো কিনবে!
বর্তমানে পৃথিবীর উৎকৃষ্ট মানের অর্থাৎ কম্বিং কেশমিরের মোট উৎপাদনের ৭০ ভাগ চীন, ১৮ ভাগ মঙ্গোলিয়া এবং বাকি ১২ ভাগ সারা বিশ্বে উৎপাদিত হয়।

আমার দেখা একটি ইটালিয়ান কেশমিরি মাফলারের দাম প্রায় ৮৭ হাজার টাকা (৩৭৫০ দিরহাম) এবং মহিলাদের একটি পুল ওভার কোটের দাম দশ লাখ টাকা প্রায় (৪৩ হাজার দিরহাম+৫% ট্যাক্স)

অনেক হয়েছে, আসুন এবার আসল কেশমিরি শাল বা কাপড় চেনার কিছু কৌশল জেনে নেই-
* স্টিকারে ইংরেজিতে লিখা থাকবে 100% CASHMERE. (small letter-এ নয়)
* শাল/ চাদর/ মাফলার সাধারণত এক বা সর্বোচ্চ দুই পাকের (Ply) সুতার তৈরি হবে।
* অন্যান্য উলের কাপড়ের চেয়ে খুবই নরম কোমল ও সিল্কি।
* সুতার তন্তু গুলো খুবই চিকন (thick) যা ৩০ মাইক্রনের কম হয়।
* কাপড় থেকে পশম খুলে আসবে না বা খসে পড়বে না।
* অনেকটুকু কাপড় মুষ্টিবদ্ধ করে চাপ দিয়ে ছেড়ে দিন, কোনো ভাঁজ পড়বে না।
* হাতের তালুর উল্টা পিঠে কাপড়টি লাগিয়ে আস্তে করে আরেক হাতে টানতে থাকুন, খুব মিহি শীতল অনুভূত হবে, খসখসে নয়।
* দুই পরত কাপড় একসাথে ঘষা দিন, তুলনামূলক বেশি পিচ্ছিল মনে হবে।
* তুলনামূলক ওজনে হালকা এবং পাতলা কাপড় হলেও অধিক গরম (more heat resistant), যা পশমের বিশেষত্বের কারণে।
* একেবারে খালি গায়ে পরিধান করলেও কোনো প্রকার চুলকানি বা অস্বস্তি হয় না!
* ঠোঁটের সাথে আস্তে করে ঘষা দিন, মকমলের মতো অনুভূত হবে! (লিপস্টিক লাগানো থাকলে দোকানে এই চেষ্টা করবেন না)
* গরম পানিতে ভিজালে ভ্যাপসা গন্ধ ছড়াবে।
* কখনোই খুব উজ্জ্বল চকচকে রংয়ের হবে না।

সর্তকতা
শুধুমাত্র বেবি শ্যাম্পু দিয়ে ধুতে হবে, সম্ভব না হলে সাধারণ শ্যাম্পু দিয়ে, হাতে ধুবেন মেশিনে নয়, চিপবেন না শুধু ঝুলিয়ে রেখে শুকাতে দিন। এই তো ব্যস্...


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us