টিকা আবিষ্কার করে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছিলেন যে দুই বিজ্ঞানী

মনীষা মুখোপাধ্যায় | Feb 25, 2021 01:14 pm
টিকা আবিষ্কার করে লাঞ্ছনার শিকার!

টিকা আবিষ্কার করে লাঞ্ছনার শিকার! - ছবি সংগৃহীত

 

করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারকদের ধন্য ধন্য করছে বিশ্ব। তবে মড়কের টিকা আবিষ্কার এই প্রথম নয়। এর আগেও নানা সময়ে বিভিন্ন মারণরোগের টিকার উদ্ভাবন দেখেছে দুনিয়া। টিকার জেরে কোটি কোটি প্রাণ বাঁচলেও আবিষ্কারকদের বরাত মোটেই ফুল্লকুসুমিত ছিল না। বরং অনেক অপমান, গঞ্জনা, লাঞ্ছনার পথ পেরিয়ে সেই সব টিকা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

১৯০২ সালে এক অজানা জ্বরে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। ম্যালেরিয়ার সঙ্গে এর তফাৎ কোথায় সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না চিকিৎসকরা। কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজের (অধুনা নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ) অন্ধকার খুপরির মতো ঘরে বসেই কালাজ্বর নিয়ে তার গবেষণা শুরু করলেন উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। পানির অব্যবস্থা। চরম আর্থিক প্রতিকূলতা। প্রযুক্তিগত অসুবিধা। তবু তাদের কাবু করে একদিন বুঝে ফেললেন এই রোগের প্রধান কারণ বেলেমাছি। ১৯২২ সালে আবিষ্কার করে ফেললেন কালাজ্বরের টিকা ইউরিয়া স্টিবামাইন। দেখিয়ে দিলেন এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।

কিন্তু দেখালেই শুনছে কে? যা বিশ্বের তাবড় চিকিৎসক পারেননি, তা কিনা পেরে বসলেন ‘কলকেতার’ এক বঙ্গসন্তান! ছোঃ! পাত্তাই দিল না চিকিৎসকমহল। ১৯২৩ সালে ন’জন রোগীর শরীরে ইউরিয়া স্টিবামাইন দিয়ে তাদের সুস্থ করে তুললেন উপেন্দ্রনাথ। নাম ছড়ালেও ব্রিটিশ সরকার তখনো ওই ওষুধ নিয়ে খুঁতখুঁতে। সুকুমার রায় এই একই রোগে আক্রান্ত হলেও পেলেন না ওষুধ। কেন কে জানে! ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে চিন্তিত সকলেই। ‘পাগল’, ‘শয়তান’, ‘স্বেচ্ছাচারী’ চোখা চোখা বাক্যবাণ ততদিনে নাজেহাল করেছে উপেন্দ্রনাথকে। পেয়েছেনে প্রাণনাশের হুমকিও। পানি এতদূর গড়িয়েছিল যে, আসামের গভর্নর স্যার জন খের এগিয়ে এসে গোটা আসামে এই ওষুধ প্রয়োগের নির্দেশ না দিলে খুন হয়ে যেতে পারতেন উপেন্দ্রনাথ! আসামে সাফল্যের পর সারা দেশ তেতো গেলার মতো করে মেনে নিল এই সেরা আবিষ্কার। এলো নাইটহুড সম্মান, মিন্টো পদক, জোনস পদক। কিন্তু কোন এক অদ্ভুত রহস্যে ১৯২৯ সালে নোবেলের জন্য মনোনয়ন পাওয়ার পরেও তার হয়ে টুঁ শব্দ করেনি নোবেল কর্তৃপক্ষ।

গুটিবসন্তের ভ্যাকসিনই পৃথিবীর প্রথম টিকা। তবু ডাঃ জেনারের ‘দাগি দৈত্য’ অর্থাৎ ‘স্পেকল্‌ড মনস্টার’-এর টিকা আবিষ্কারের পরের দিনগুলো সহজ ছিল না। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পরও, লন্ডনে দরজায় দরজার ঘুরে প্রচারের পরেও প্রথমে কাউকে রাজি করাতে পারেননি টিকা নিতে।

একজন গোয়ালিনির থেকে জেনার শুনেছিলেন, একবার গো বসন্ত হলে আর নাকি গুটিবসন্ত হচ্ছে না। গোয়ালিনি বলে তার কথা উড়িয়ে দেননি তিনি। বরং গবেষণায় প্রাণপাত করেন সেই কথার ওপর ভিত্তি করেই। ১৭৯৬ সালের মে মাসে এক গোয়ালিনির শরীরের গো বসন্তের ক্ষত থেকে পুঁজ সংগ্রহ করে তা প্রয়োগ করেন তার বাগানের মালির আট বছরের ছেলের ওপর। জ্বর, মাথাধরার মতো কিছু অসুস্থতা এলো। কিন্তু ধীরে ধীরে মারণ অসুখ থেকে সে সুস্থ হয়ে উঠল। প্রাণে বাঁচাতে পেরে উৎফুল্ল জেনার তার কিছু দিন পর ছেলেটির শরীরে গুটিবসন্তের রস প্রবেশ করাল। কিন্তু জেনারের পরিকল্পনামাফিকই কাজ হয়। আরো নানাজনের গুটিবসন্ত এই একই উপায়ে ভালো করলেও রয়্যাল সোসাইটিতে জেনারের পাঠানো ভ্যাকসিন-বিষয়ক গবেষণাপত্র গ্রহণযোগ্যতা তো পেলই না, উল্টে ছিঁড়ে ফেলে দেয়া হলো আস্তাকুঁড়েতে। পাগলের প্রলাপ বকছেন, একথাই প্রচারিত হলো।

জেনারকে ফরাসি বিপ্লবের সময় ‘র‌্যাডিক্যাল’ গোষ্ঠীর প্রেরণ করা গুপ্তচর হিসেবেও চিহ্নিত করেন অনেকে। অসুস্থ পশুর শরীর থেকে পুঁজরস মানুষের শরীরে দেয়া তখন ঘোর অনাচার! অমানবিক। তাচ্ছিল্য, অপমান, অসম্মান দগদগে হয়ে লেগে জেনারের গায়ে। তাকে নিয়ে আঁকা হচ্ছে ব্যঙ্গচিত্রও। নিজের চিকিৎসক সমাজই ব্রাত্য একঘরে করে দিয়েছে তাকে। জেনারকে মারার জন্য খোঁজ শুরু হলো। দেশে পালিয়ে বাঁচলেন জেনার। দেশে ফিরে ভ্যাকসিন নিয়ে আবারো কাজ শুরু করলেন তিনি। নিজের এগারো মাসের শিশুসন্তানকেও ভ্যাকসিন দিলেন। ভালো করলেন অজস্র মানুষকে। তারপর থেকে এলো স্বীকৃতি, পুরস্কার, সম্মান।

সূত্র : বর্তমান


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us