ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু | Feb 25, 2021 01:48 pm
‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার’

‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার’ - ছবি সংগৃহীত

 

আট মাস আগে ভারত-চীন সীমান্ত সঙ্কট শুরু হওয়ার পর থেকে অস্ট্রেলীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাংবাদিক নেভিল ম্যাক্সওয়েল এর কথা বারবার মনে পড়েছে। গতবছর ৯৩ বছর বয়সে তিনি মারা গেছেন। ১৯৬২ সালে সংঘটিত ভারত-চীন যুদ্ধের ওপর তার লেখা ‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার’ গ্রন্থটি তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি দিয়েছিল। কিন্তু বইটির কারণে ভারতে তিনি কঠোরভাবে সমালোচিত। গ্রন্থে তার দেখানো ভারতের সামরিক দুর্বলতাগুলো ভারতের কোনো সরকার স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেনি এবং মিলিটারি হাইকমান্ড বিব্রত হয়েছে। কিন্তু চীন সরকার তার প্রশংসা করেছে। ১৯৭১ সালে বেইজিং এ এক সরকারি ভোজসভায় উপস্থিত ছিলেন লন্ডনের দ্য টাইমস রিপোর্টার নেভিল ম্যাক্সওয়েল। প্রধানমন্ত্রী ঝাউ এনলাই ও পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলী ভূট্টো তাদের আসন থেকে ম্যাক্সওয়েলের টেবিলে আসেন এবং দোভাষীর মাধ্যমে বলেন, “মি: ম্যাক্সয়েল, আপনার বই সত্যের প্রতি অনেক অবদান রেখেছে এবং চীন তা থেকে উপকৃত হয়েছে।” একজন রিপোর্টারের জন্য এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে! পরবর্তীতে ম্যাক্সওয়েল বলেছেন, “এ ঘটনা আমার স্মৃতিতে গভীর ছাপ রেখেছে।” বইটি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সেতুবন্ধন স্থাপনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হয়। হেনরি কিসিঞ্জার চীনের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, “বইটি পড়ার পর আমার মনে হয়েছে আমি আপনাদের সাথে কাজ করতে পারবো।” ১৯৭২ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চীন সফরকালে তিনি বইটি পড়েছেন বলে ঝাউ এনলাইকে জানান এবং ম্যাক্সওয়েলের তুলে ধরা যুক্তিকে যথার্থ বলে স্বীকার করেন।

ভারত-চীন যুদ্ধ চলাকালে ওই সময়ে দিল্লিতে কর্মরত অন্যান্য বিদেশী গণমাধ্যমের রিপোর্টারদের মধ্যে একমাত্র নেভিল ম্যাকওয়েলই যুদ্ধ পরিস্থিতির ওপর ভারতের সরকারি ভাষ্যের ওপর নির্ভর না করে তার নিজস্ব সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য ও বিশ্লেষণ পাঠাতেন দ্য টাইমসে। যার পরিণতিতে তাকে কার্যত ভারত থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়।

১৯৭০ সালে ‘ইন্ডিয়া’র চায়না ওয়ার’ প্রকাশিত হওয়ার পর ভারত সরকার নেভিল ম্যাক্সওয়েলের বিরুদ্ধে ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ ভঙ্গ করার অভিযোগ আনে এবং ব্রিটিশ সরকার তাকে পরামর্শ দেয় গ্রেফতার এড়ানোর জন্য ভারত সফর না করতে। আট বছর তিনি আর ভারতে যাননি। মোরারজি দেশাইয়ের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহার করা হলে তিনি আবার ভারতে যান। কিন্তু এখনো ভারতীয় রাজনৈতিক মহল ও গণমাধ্যমে তিনি বিতর্কিত ও সমালোচিত। ভারত ১৯৬২ সালের যুদ্ধকে চীনের ‘বিশ্বাসঘাতকতা ও সম্প্রসারণবাদের’ সৃষ্টি বলে যে অভিযোগ করে ম্যাক্সওয়েলের গ্রন্থে তা খণ্ডন করে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, “এ যুদ্ধ ছিল মূলত ভারতের সৃষ্টি এবং সে কারণেই এটি ছিল ‘ভারতের চীনা যুদ্ধ’। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল বইটির বিষয়বস্তুর প্রধান সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন ভারতের টপ ক্লাসিফাইড দলিল ‘হ্যান্ডারসন ব্রুকস-ভগত রিপোর্ট’, যাতে ভারতের সামরিক বিপর্যয়ের কারণগুলো তুলে ধরা হয়েছিল, যার একটি কপি ম্যাক্সওয়েল সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। চীন থেকে কোনো তথ্য লাভ করা কঠিন বলে ১৯৬২ সালের যুদ্ধ সম্পর্কে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যায়ন জানতে তাকে মূলত চীনের সরকারি বিবৃতির ওপর নির্ভর করতে হয়েছে এবং সেসব তথ্যের যথার্থতা যাচাই করারও সুযোগ ছিল না।

নেভিল ম্যাক্সওয়েলের সাথে যখন আমার পরিচয় হয় তখন আমার জানা ছিল না তিনি কত বড় মাপের সাংবাদিক। ১৯৮৮ সালে আমি রয়টার্স ফাউন্ডেশনের ফেলোশিপ পাওয়ার পর ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য হিসেবে আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সাথে তার বন্ধু অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানকে পৌঁছে দেয়ার জন্য আরেকটি চিঠি দিয়েছিলেন। ওই বছরের শেষ দিকে তার সাথে আমার দেখা হয় স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে তিনি গিয়েছিলেন রয়টার্সের পরবর্তী বছরের ফেলো নির্বাচনের সভায় যোগ দিতে এবং তার তিন দিনের অবস্থানকালে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ ও আলোচনা হয়। দ্য টাইমস এর প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লিতে অবস্থানকালে ষাটের দশকে তার ঢাকা সফরের স্মৃতি সম্পর্কে বলেন। তার সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি তখন জানা হয়নি, এমনকি তার বহুল আলোচিত বইটি সম্পর্কেও কেউ আমাকে কিছু বলেনি। ম্যাক্সওয়েলের সাথে আর কখনো আমার দেখা হয়নি, যোগাযোগও ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসার তিন বছর পর ১৯৯২ সালে তার ‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার’ পাঠ করে তার সম্পর্কে এবং ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের বিস্তারিত জানার সুযোগ হয় নয়াদিল্লিতে।

কমনওয়েলথ টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামের আওতায় নয়াদিল্লিতে ভারতীয় পার্লামেন্টের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব পার্লামেন্টারি অ্যান্ড কন্সটিটিউশনাল স্টাডিজ’ এ আরেকটি ফেলোশিপ করার জন্য যাই। ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরির পরিসর ছোট হলেও উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক ইতিহাসের ওপর প্রকাশিত গ্রন্থ ও দুর্লভ দলিলপত্রে সমৃদ্ধ। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর ওই সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং অন্যান্য দেশে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত এত বিপুলসংখ্যক বই ছিল, যা আমি বাংলাদেশের কোনো সরকারি লাইব্রেরিতে দেখিনি। লাইব্রেরি অবাধে ব্যবহার ও যেকোনো সংখ্যক বই বাড়িতে নিয়ে আসার স্বাধীনতা ছিল আমাদের। খাতায় এন্ট্রি করে নিলেই হলো।

বই ঘাঁটার সময় একদিন নেভিল ম্যাক্সওয়েলের ‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার’ হাতে পড়ে। যেহেতু লেখক আমার পরিচিত, অতএব আগ্রহের সাথে বইটি নিই এবং থ্রিলার পড়ার মতো মুগ্ধতায় মাত্র পাঁচ দিনে প্রায় পাঁচশ পৃষ্ঠার বই পড়ে শেষ করি। বইটি পড়ার পূর্ব পর্যন্ত ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধ সম্পর্কে এত দিন পর্যন্ত শুধু জানা ছিল যে যুদ্ধে ভারতকে পরাজিত করতে চীনকে কোনো বেগ পেতে হয়নি। চীনের অগ্রাভিযানের খবরে এমন আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল যে ভারত সরকার এমনকি আসামের চীন সীমান্তবর্তী শহরগুলো থেকে প্রশাসন ও জনগণকে নিরাপদ স্থানে হটে আসার পরামর্শ দিয়েছিল। অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ভারতীয় বাহিনী পিছু হটতে শুরু করলে চীন একতরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে এবং তাদের বাহিনীকে আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার আদেশ দেয়। ভারতের সরকারি হিসেবে ওই যুদ্ধে তাদের ১,৩৮৩ জন সৈন্য নিহত, ১,০৪৭ জন আহত ও ১,৬৯৬ জন নিখোঁজ হয়েছিল। কিন্তু হ্যান্ডারসন ব্রুকস-ভগত রিপোর্টে ভারতীয় পক্ষে ২,০০০ এর অধিক সৈন্য নিহত এবং ৪,০০০ এর অধিক সৈন্যকে যুদ্ধবন্দী করা হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৫,০০০ হাজার সৈন্যের একটি ডিভিশনকে অপমানজনকভাবে পিছু হটতে হয়েছিল।

‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার’ গ্রন্থে দুই দেশের মধ্যে দুই হাজার মাইলের অধিক অচিহ্নিত সীমান্ত নিয়ে বিরোধের বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। ভারত বরাবর দাবি করছে যে, উভয় দেশের সীমান্ত হচ্ছে ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের চিহ্নিত ‘ম্যাকমোহন লাইন,’ এবং চীন তা অতিক্রম করে লাদাখ এলাকায় ৪৩,০০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করে রেখেছে। চীন কখনো ম্যাকমোহন লাইনকে দুই দেশের সীমান্ত হিসেবে গ্রহণ করেনি। তারা ১৯৫৯ সাল থেকে চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত বলতে বোঝায় ‘লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’ যা উভয় দেশের দীর্ঘ সীমান্তের শুধু পূর্ব দিকে ম্যাকমোহন লাইনের সাথে অভিন্ন। চীনের সম্প্রসারণবাদী উদ্যোগ প্রতিহত করতে জওয়াহেরলাল নেহরুর ‘ফরওয়ার্ড পলিসি’ অনুযায়ী ভারত ১৯৬২ সালে ম্যাকমোহন লাইন পর্যন্ত যতদূর সম্ভব এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধে। ওই বছরের জুন মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনী ম্যাকমোহন লাইনের উত্তরে ‘নামকা চু’ উপত্যকায় ধোলা নামে একটি স্থানে সীমান্ত চৌকি স্থাপন করার পর ২০ সেপ্টেম্বর থেকে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির সাথে ভারতীয় বাহিনীর ছোটখাটো সংঘর্ষ চলতে থাকে। মূল যুদ্ধ শুরু হয় ২০ অক্টোবর এবং যুদ্ধ থাগলা রিজ থেকে উত্তর দিকের প্রায় ৬০০ মাইল সীমান্তজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। ২১ নভেম্বর পর্যন্ত মাসব্যাপী যুদ্ধে চীনের বিপুল বাহিনীর মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে ভারতীয় বাহিনীকে পিছু হটতে হয়।

ভারত চীনের এ হামলাকে তাদের পিঠে ছুরিকাঘাত বলে বর্ণনা করে। কিন্তু চীনের ব্যাখ্যা ছিল যে, তাদের ভূখণ্ডে ভারতের অভিযান প্রতিহত করতে তাদেরকে পাল্টা হামলা চালাতে হয়েছে। যুদ্ধের প্রথম দিকে নেভিল ম্যাক্সওয়েল পাশ্চাত্যের অন্যান্য সাংবাদিকের মতো প্রায় দ্বিধাহীনভাবেই ভারতীয় ভাষ্য গ্রহণ করেছেন। কিন্তু গভীরভাবে দুই দেশের সঙ্ঘাতের ওপর পড়াশোনা করার পর তিনি সীমান্ত সঙ্কটের ওপর চীনের বক্তব্যকেও তার রিপোর্টে স্থান দিতে শুরু করেন, যা ভারত সরকারকে ক্ষুব্ধ করে। তিনি তার গ্রন্থে তুলে ধরেন, ভারত কিভাবে চীনকে যুদ্ধে প্ররোচিত করেছিল। আগেই উল্লেখ করেছি, ম্যাক্সওয়েলের গ্রন্থের মূল তথ্যসূত্র ছিল ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত ‘হ্যান্ডারসন ব্রুক-ভগত রিপোর্ট’। ১৯৬৩ সালে রিপোর্টটি তৈরি করেন লে. জেনারেল হ্যান্ডারসন ব্রুক ও ব্রিগেডিয়ার প্রেমেন্দ্র সিং ভগত (পরবর্তীতে লে. জেনারেল)। অতি গোপনীয় রিপোর্টটি কিভাবে ম্যাক্সওয়েলের হাতে পড়ল, তা নিয়ে অনেক কথা থাকলেও সন্দেহের তীর ছিল লে. জেনারেল হ্যান্ডারসন ব্রুকসের দিকে। কারণ হ্যান্ডারসন ছিলেন অস্ট্রেলীয় বংশোদ্ভূত এবং ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীতে রয়ে যান এবং তার সাথে অস্ট্রেলীয় বংশোদ্ভূত ম্যাক্সওয়েলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। দুই খণ্ডের রিপোর্টের প্রথম খণ্ড ম্যাক্সওয়েল সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন।

হ্যান্ডারসন ব্রুকস-ভগত রিপোর্টে চীনের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনা অভিযানের চুলচেরা মূল্যায়ন করতে গিয়ে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণে ব্যর্থতার পেছনে মুখ্যত রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দায়ী করা হয়েছে। যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া চীনের মতো বিশাল এক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় বেসামরিক প্রশাসন ও সামরিক নীতিনির্ধারকদের ত্রুটিগুলোও তুলে ধরা হয়েছে। নেহরু সরকারের উচ্চাভিলাষী ‘ফরোয়ার্ড পলিসি’ বাস্তবায়নের নামে নতুন ভূখণ্ড অধিকার ও চীনের সৈন্যদের সেসব এলাকা থেকে উচ্ছেদ করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সামনে ঠেলে দেয়ার পরিণতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে রিপোর্টে। সেই সাথে যথেষ্ট প্রস্তুতি ছাড়া সীমান্তে বিরাজমান অবস্থা রাতারাতি পাল্টে দেয়ার চেষ্টার অর্থ চীনকে উসকানি দেয়ার শামিল বলে সীমান্তে নিয়োজিত সেনাধ্যক্ষরা বারবার সতর্ক করলেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেনাবাহিনীর ওপর তাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টটি প্রকাশের জন্য বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক মহল থেকে দাবি উঠলেও সব সরকার সেটিকে স্পর্শকাতর এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর ভেবে প্রকাশ করেনি। ২০১০ সালের পর সূত্র গোপন রাখার অনুরোধ জানিয়ে নেভিল ম্যাক্সওয়েল ভারতের প্রধান কয়েকটি সংবাদপত্রে তার ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে রিপোর্টটি পাঠান। কিন্তু কোনো সংবাদপত্র তা প্রকাশ করেনি।

অতএব ম্যাক্সওয়েল তাগিদ অনুভব করেন যে তিনি যদি রিপোর্টটি প্রকাশ না করেন তা হলে এটি হয়তো কখনো আলোর মুখ দেখবে না। ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ তিনি তার ব্লগে রিপোর্টটি প্রকাশ করেন এবং তার বিরুদ্ধে ভারতে আরেক দফা সমালোচনার ঝড় ওঠে। তিনি আশাবাদ পোষণ করেছেন যে, ভারত সরকার রিপোর্টের কোনো অংশ বাদ না দিয়ে বা সম্পাদনা না করেই উভয় খণ্ডই প্রকাশ করবে। তার ব্লগে রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের সাবেক সাংবাদিক ও বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব সিডনির ‘সিডনি ডেমোক্র্যাসি নেটওয়ার্কের’ সিনিয়র রিসার্চ ফেলো দেবাশীষ রায় চৌধুরী ম্যাক্সওয়েলের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এ সাক্ষাৎকারেও তিনি ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনকে নয়, বরং ভারতকেই আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই ভারত আন্তর্জাতিক রীতি উপেক্ষা করে একতরফাভাবে সীমান্ত নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং নেহরু ও তার সহযোগীরা চীনের সাথে আলোচনা করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে বিবেচনা না করে নিজেরাই মানচিত্রে তাদের চূড়ান্ত আন্তর্জাতিক সীমান্ত নির্ধারণ করে নেন, এমনকি আকসাই চিন নামে একটি এলাকা ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেন, যার ওপর ব্রিটেনও কখনো অধিকার দাবি করেনি।

হ্যান্ডারসন ব্রুক-ভগত রিপোর্টে ১৯৬২ সালে চীনের কাছে স্বাধীন ভারতের চরম সামরিক বিপর্যয়ের জন্য যাদেরকে অভিযুক্ত করেছে এবং নেভিল ম্যাক্সওয়েল একইভাবে তার ‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার’ এ স্থান দিয়েছেন, তারা হচ্ছেন; প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন, ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডাইরেক্টর বি এম মল্লিক, ওই এলাকায় যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য দায়িত্বশীল চিফ অব জেনারেল স্টাফ লে. জেনারেল বি এম কাউল, পররাষ্ট্র সচিব এম জে দেশাই, ডাইরেক্টর মিলিটারি অপারেশনস ডিকে পালিত। রিপোর্টটি প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু ও সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল পিএন থাপারের ভূমিকা সম্পর্কে নীরব। এর কারণ হিসেবে ম্যাক্সওয়েল বলেছেন, ১৯৬২ সালের বিপর্যয়ে নেহরু এবং থাপারকেই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। চীনের একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণার একদিন পর ১৯৬২ সালের ২২ নভেম্বর জেনারেল থাপার পদত্যাগ করেন। নেহরু তার প্রস্তুতিহীন ‘ফরোয়ার্ড পলিসি’কে কৌশলগতভাবে মারাত্মক ভুল ছিল বলে অনুশোচনার মধ্যে ছিলেন এবং চীনের কাছে পরাজয়ের দুই বছর পর ১৯৬৪ সালে ভগ্নহৃদয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

ব্রুকস রিপোর্টে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে কৃষ্ণ মেননের দায়িত্ব পালনের ধরণকে ‘বিস্ময়কর’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঊর্র্ধ্বতন সামরিক অফিসারদের সাথে বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলোকেও গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতেন না। কৃষ্ণ মেননের জীবনী লেখক জয়রাম রমেশ তার সম্পর্কে বলেছেন, “১৯৬২ সালের বিপর্যয়ের জন্য তাকে সঠিকভাবে বা ভুলভাবে তাকে দায়ী করা হয়। কিন্তু তিনি একমাত্র অভিযুক্ত ব্যক্তি নন। বিশ্বের সর্বত্র সামরিক বিপর্যয়ের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দোষারূপ করা হয়। এর ধারাবাহিতায় কৃষ্ণ মেনন অভিযুক্ত হতে পারেন।” তিনি ম্যাক্সওয়েলের ‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার’ গ্রন্থের উল্লেখ করে বলেন, গ্রন্থটি কৃষ্ণ মেননের রাজনৈতিক জীবনে এবং ভারতের সামরিক কৌশলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে এই গ্রন্থটি। এই যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধ ছিল না, বরং এটি ছিল চীনের যুদ্ধ। মাও জে দং ভারতকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। যুদ্ধে পরাজয়ের তীব্র সমালোচনার মুখে তাকে পদত্যাগ করতে হয়।

যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের কারণে আরেকজন ব্যক্তিকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল, তিনি চীনের বিরুদ্ধে ১৯৬২ সালের যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী প্রধান সামরিক অফিসার লে. জেনারেল বি এম কাউল। ব্রুকস রিপোর্টে জেনারেল কাউলের যুদ্ধ পরিকল্পনা ও নেতৃত্বের ব্যর্থতার জন্য তাকে পরোক্ষভাবে দোষারূপ করা হয়। যদিও রিপোর্টে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশ করার না করার নীতি অনুসরণ করা হয়েছিল, কিন্তু জেনারেল কাউলের ব্যতিক্রম ছিলেন। তাকে সরাসরি আক্রমণ করা হয়েছে যে, বিভ্রান্তিকর গোয়েন্দা তথ্যের ওপর নির্ভর করে তিনি সৈন্যদের জন্য অসম্ভব এক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিলেন। ‘ফরোয়ার্ড পলিসির বাস্তবায়নে চীন কোনো প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করবে না মর্মে রাজনৈতিক ধারণার মধ্যে তিনিও মগ্ন হয়েছিলেন। তা ছাড়া চিফ অব জেনারেল স্টাফের পদ শূন্য রেখে তিনি ‘নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি (নেফা) নামে খ্যাত বর্তমান অরুণাচল প্রদেশে সদ্য গঠিত ফোর্থ কোরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর কারণ হিসেবে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফোর্থ গঠনের পেছনে জেনারেল কাউলের উদ্দেশ্য ছিল কোরের প্রধান স্টাফ অফিসারদের দ্রুততার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ করানো। কিন্তু সরাসিরি যুদ্ধ লড়ার অভিজ্ঞতা নেই এমন কাউকে কোনো কোর গঠন বা বড় ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত করানো যেতে পারে না।

বি এম কাউলের ভূমিকার সমালোচনায় ম্যাক্সওয়েল আরো এক ধাপ এগিয়ে গেছেন এবং ম্যাক্সওয়েলের সাথে সুর মিলিয়েছেন “হিমালয়ান ব্লান্ডার”-এর লেখক ব্রিগেডিয়ার জন পরশুরাম দালভি, যিনি ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারতের সেভেনথ ইনফেন্ট্রি ব্রিগেডের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন এবং চীনের হাতে যুদ্ধবন্দী হয়েছিলেন। তিনি যুদ্ধে ভারতের লজ্জাজনক পরাজয়ের জন্য জেনারেল কাউলকে দায়ী করেছেন। কাশ্মিরি সূত্রে কাউলের সাথে নেহরুর পারিবারিক সম্পর্কের কারণে তিনি সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ পদ বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে দালভি অভিযোগ করেন। যখন যুদ্ধ অত্যাসন্ন তখন তাকে যুদ্ধ প্রস্তুতির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার চেয়ে যে কাজগুলো তার অধীনস্থ অফিসারদের দ্বারা করা সম্ভব, সেসব কাজ করতে তিনি হেলিকপ্টারে উঠে চলে যেতেন। তার যুদ্ধের প্রকৃত অভিজ্ঞতা ছিল না বলেও বর্ণনা করেছেন অনেক ঊর্র্ধ্বতন সেনা অফিসার।

লে. জেনারেল বি এম কাউল সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করার পর “দ্য আনটোল্ড স্টোরি” নামে আত্মজীবনীমূলক যে গ্রন্থটি রচনা করেন, আমার দিল্লি অবস্থানকালে সেটিও পড়ার সুযোগ হয়। জীবনের বহু ঘটনা বর্ণনার সাথে পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার এই গ্রন্থের বহুলাংশ জুড়ে ১৯৬২ সালের চীনের সাথে যুদ্ধে বিপর্যয়ের কারণে তাকে যেভাবে দোষারূপ করা হয়েছে তা খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে, স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীকে রাজনীতিকরণ করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। স্বাধীন ভারতের প্রথম কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল স্যার রবার্ট লকহার্ট প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুর কাছে সেনাবাহিনীকে সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা উপস্থাপন করলে তিনি তাকে উত্তর দিয়েছিলেন, “আমাদের কোনো যুদ্ধ পরিকল্পনার প্রয়োজন নেই। আমাদের নীতি হচ্ছে অহিংস। আমরা কোনো সামরিক হুমকি দেখছি না। আপনি সেনাবাহিনীর আকার ছোট করতে পারেন। আমাদের নিরাপত্তার প্রয়োজন মেটাতে পুলিশই যথেষ্ট।” সামরিক বাহিনীর প্রতি রাজনৈতিক নেতৃত্বের এ ধরনের উদাসীনতার কারণে যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়া একটি বাহিনীর যে ধরনের প্রস্তুতি থাকা উচিত ছিল কাউল তা থেকে বঞ্চিত ছিলেন বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

জেনারেল বি এম কাউলের “দ্য আনটোল্ড স্টোরি” ম্যাক্সওয়েলের “ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার” এর তিন বছর আগে প্রকাশিত হলেও, ম্যাক্সওয়েল হ্যান্ডারসন ব্রুকস-ভগত রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃত করে ‘দ্য টাইমসে’ কাউলকে দোষারূপ করে যে রিপোর্টগুলো করছিলেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট লঙ্ঘনের জন্য ম্যাক্সওয়েল এবং সরকারি আমলাদের কঠোর সমালোচনা করেন, যারা বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে গদগদ হয়ে সব গোপনীয়তা প্রকাশে উদারতা প্রদর্শন করেন। ম্যাক্সওয়েলকে ভর্ৎসনা করতে ভারতের সাংবাদিকরাও পিছিয়ে ছিলেন না। হ্যান্ডারসন ব্রুকস রিপোর্ট প্রকাশ করার কারণে ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ এর সাবেক সম্পাদক শেখর গুপ্ত নেভিল ম্যাক্সওয়েলের ওপর এক হাত নিয়েছেন। ম্যাক্সওয়েলের ব্লগে হ্যান্ডারসন ব্রুকস রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পাঁচ দিন পর ২০১৪ সালের ২২ মার্চ এক নিবন্ধে তিনি বিষোদগার করেছেন, “কী করে একজন নির্বোধ, ভারতীয় আতিথেয়তার প্রতি অকৃতজ্ঞ শ্বেতাঙ্গ ১৯৬২ সালের আগ্রাসনের জন্য ভারতকে দোষারূপ করার ধৃষ্টতা দেখায়?

কিভাবে তার সাহস হয় জওয়াহেরলাল নেহরু, এমনকি সমমনা কমিউনিস্ট কৃষ্ণ মেননকে অপমান করার? তিনি কেমন মানুষ যে তিনি ভারতীয় সৈনিকদের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন, যারা প্রচণ্ড প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছেন। আরো বেশি অপমানজনক যে, কিভাবে তিনি এ যুদ্ধকে ‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার’ বলার ধৃষ্টতা দেখান? ... যারা ম্যাক্সওয়েলকে হ্যান্ডারসন ব্রুকস-ভগত রিপোর্ট সরবরাহ করতে সহযোগিতা করেছে, তাদেরকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।”


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us